কোথা থেকে এলো এই কালরাত? কারা এ কালরাতের শ্রষ্টা? একবার যদি হাতের কাছে পাইতামণ্ড এই বঁটি দিয়া কোপ দিয়া তার মাথা ঘাড় থেকে আলাদা করে ফেলতাম। দাঁতে দাঁত কাটে শিউলি। শত্রুর কথা মনে পড়তেই শিউলির মাথা গরম হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা ঠান্ডা করে আক্ষেপ করে সে। - আমি তো এই কালরাতের অপেক্ষায় ছিলাম না। আমি ছিলাম হাবিলদার নুর ইসলামের সাজানো বাগানে ফুটে থাকা শিউলি ফুল। সেই ফুল থেকে কীভাবে এই কালরাতে এসে পৌঁছালাম! হায়রে কপাল, হা-হুতাস করে শিউলি। - এই কালরাতের ইতিহাস জীবনেও ভুলতে পারব না আমি। যদি হাবিলদার নুর ইসলাম জীবনে বেঁচে থাকে, যদি কোনো দিন আবার দেখা হয়, একান্তে কথা হয় দুজনার- তবে এই স্মৃতির কথা বলে বলে সারা রাত জাগিয়ে রাখব তাকে। শুধুকি তাই? এবারে যদি ফিরে আসে- তাহলে তাকে পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলবে শিউলি। এত টেনশনের চাকরি তার আর করতে হবে না। চলে যাবে গ্রামে। নিজের মতো করে সংসার সাজিয়ে মনের আনন্দে দিন কাটবে তাদের। তখন আর তাদের ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতে হবে না করো। কত রকম স্বপ্ন ভাসে শিউলির মনে।
দুপুর ১২টা। এখনোও হা. নুর ইসলামের কোনো খবর নাই। রান্না করা, খাবার খাওয়া, কোনো কিছুতেই মন নাই শিউলির। ছোট্ট ছেলেটি বার বার মা মা বলে চিৎকার করছে। বাচ্চাকে কোলের মধ্যে আগলে ধরে মা শিউলি। গ্রাম থেকে আসা ছোট ভাই মধুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তার মুখের দিকে তাকানো যায় না।
বাড়ি থেকে শিউলির মা তার ছোট ভাই মধুকে পাঠিয়েছে শিউলিকে এবং তার নাতি মাহিকে নানা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিছু দিন পরেই তাদের গ্রামে বৈরাগীর বাজারে বৈশাখী মেলা বসবে। নানা রকম উৎসব হবে গ্রামে। নাতিকে নিয়ে সে উৎসব যাবে নানি, এমনই কথা হয়েছিল নুর ইসলামের সাথে।
জামাইকে যেভাবেই হোক নিয়ে যাওয়ার জন্য বার বার মধুকে বলে দিয়েছে শিউলীর মা। কালরাত, যুদ্ধ এসব কথা বোঝার মতো এখনো তেমন বয়স হয়নি মধুর।
সবে মাত্র ৭ম থেকে ৮ম শ্রেণিতে উঠল। তাছাড়া ঢাকা শহরে নতুন এসেছে সে। এই শহরে কিছুই চেনে না, জানে না, কোথায় যাবে নুর ইসলামকে খুঁজতে? কীভাবে তার বোনকে একটু সাহায্য করবে, এ বিষয়ে কোনো ধারনা নাই তার। বোনের দু-চোখে অশ্রু ঝরছে আর সে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে শিউলির দিকে।
হায়রে নিষ্ঠুর পৃথিবী! মনের আবেগ প্রকাশ করার ভাষাও জানা নাই মধুর। চোখের অশ্রু মোছা ছাড়া আর কোনো কাজই নাই তার।
শুধু কি মধু! এমন শত শত মধুর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এক রাতে। প্রতিবেশীরা শিউলিকে যতই সান্ত¡না দেয়, শিউলির মন ততই উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কোনো সান্ত¡নাই স্থির করতে পারছে না তাকে। সে এখন পাগলের মতো ছটফট করছে। আর এক দৃষ্টিতে এর ওর দিকে তাকিয়ে থাকছে।
উদ্দেশ্য একটাই হাবিলদার নুরের একটা খবর বের করা। রাস্তায় কং কাসেমের সাথে দেখা হলো শিউলির। কাসেম তাড়াহুড়া করে পূর্ব দিক হইতে পশ্চিম দিকে ছুটে যাচ্ছিল। শিউলির সাথে কথা বলার সময় নাই কাসেমের। সে শুধু এটুকু বলল-
-পাকিস্তানি আর্মিরা রাজারবাগে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। কে মরেছে, কে যে বেঁচে আছে, এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না। যতটুকু জানতে পারছি, বহু পুলিশ মারা গেছে। আবার কেউ কেউ জীবন নিয়ে পালিয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারা পাকিস্তানি মিলিটারিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমি ও তাদের সাথে একজন। রাজারবাগের উত্তর পাশে বাড়ির ছাদে আমরা মেশিনগান ফিট করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি।
- এখন সময় নাই ভাবি, পরে কথা হবে। বলেই দ্রুত চলে গেল কাসেম।
পাকিন্তান হানাদার বাহিনী এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ হায়নার দল। মনে মনে গালি দেয় শিউলি। এরা কি মানুষ! না জানোয়ার। মুখে কয় মুসলমান, আসলে এরা হারামির জাত। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে শিউলি। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। কখন যে বাড়িতে মিলিটারি চলে আসে। একবার মাসুম বাচ্চার কথা ভাবে। আবার নুরের কথা মনে পড়ে।
এদিকে হাবিলদার মোস্তফা বার বার শুধু অনুরোধ করেই যাচ্ছে শিউলিকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। তার পরিবার এবং শিউলির পরিবারকে এক সাথে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর। ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সকাল সকাল রওয়ানা করলে দিনে দিনে পৌঁছনো সম্ভব। গাড়িতে সদর ঘাট যেতে পারলে, অল্প-সময় লাগবে বিক্রামপুর পৌঁছাতে। সদরঘাট থেকে স্টিমার বা নৌকা কোনো একটা তো পাওয়া যাবে। স্টিমারে উঠিয়ে দিয়েই ফিরে আসবে মোস্তফা। কিন্তু সদরঘাট যাওয়ার মতো গাড়ি জোগাড় করাই তো মুশকিল।
এই মুহূর্তে রাস্তায় কোনো গাড়ি ঘোড়া দেখা যাচ্ছে না। তবে কি হেঁটেই যেতে হবে। হেঁটে যদি যেতে হয় তাহলে রাতে রওয়ানা করাই ভালো। এমন পরকিল্পনা থেকেই মোস্তফার এই অনুরোধ। মোস্তফার এই সীদ্ধান্তের বিষয়ে নতুন কোনো মতামত নাই শিউলির। সে যাবে না। একদিন একরাত পার হয়ে গেল। অথচ নুর ইসলামের কোনো খবর নাই। নুর ইসলামের খবর না নিয়ে কি করে ঢাকা ছাড়বে সে?
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। এখন আর শিউলির নিজের সিধান্ত নেয়ার মতো মন-মানসিকতা নেই। একে একে বাড়ির সবাই বাড়ি ছেড়ে যে যার মতো গ্রামে চলে গেল। বাকি রইল শুধু শিউলি ও তার দুধের শিশু মাহি। সাথে গ্রাম থেকে আসা ছোট ভাই মধু।
এই মুহূর্তে বাইরে আর হা. মোস্তফার গলার আওয়াজ শোন যাচ্ছে না। তবে কি মোস্তফা ভাই চলে গেল? মনে হয় এতক্ষণে মস্তফা ভাইর পরিবার নিয়ে চলে গেছে। শিউলি আরো উদাসীন হয়ে পড়ে। এতক্ষণ হা. মোস্তফা ও তার পরিবারের সাথে ভালো-মন্দ দুয়েকটা কথা বলতে পারত। এখন তাও বলতে পারবে না। শিউলি একবার ভাবছে মোস্তফার পেছন পেছন হাঁটা শুরু করবে। আবার ভাবছে হাবিলদার যদি এসে তাদের না দেখে, তাহলে সে মনে ভীষণ কষ্ট পাবে। আরেকটু অপেক্ষা করি। আরেকটু অপেক্ষা করি। এমন ভাবতে ভাবতে আবার হা. মোস্তফার গলার আওয়াজ শোনা গেল।
দরজার বাইরে থেকে নিচু গলায় ডাকছে-
- ভাবি, ভাবি, ও শিউলি ভাবি, একটা গাড়ি পাইছি। জলদি চলে আসেন। আপনাদের সদরঘাট নামাই দিবে। গাড়িওয়ালার সাথে আমার কথা হইছে। শিউলি কি যেন বলতে চেয়েছিল। হা. মোস্তফা শিউলির কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়া বলল-
- আর কথা বাড়িয়েন না ভাবি, চলে আসেন। আমার পরিবার গাড়িতে বসে আছে। নুর ইসলাম আসলে আমি তাকে বুঝিয়ে বলব। চলেন তো, তা না হলে সবাই বিপদে পড়ব। এমন কি জীবনও যেতে পারে। শিউলি একটু নমনীয় হয়ে কোনো কথা না বলে মোস্তফার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে।
- কোথায় মায়ের দেয়া শাক-সবজি, কোথায় পুকুরের ছোট মাছ, কোনো কিছু খেয়াল নাই শিউলির। সে এক কাপড়ে বাচ্চা আর ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় হাবিলদার মোস্তফার সাথে। তারপর একটি ভাড়া করা চার চাক্কার গাড়িতে মোস্তফার পরিবারের সাথে যোগ হয় শিউলি।
গাড়ি চলছে। রাস্তায় কোনো জনমানব নাই। ছিপছিপে হ্যাংলা পাতলা একটি ছেলে ড্রাইবারের ছিটে বসা। বার বার এদিক ও দিক তাকাচ্ছে আর তাড়াহুড়া করে গাড়ি টানছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে জলপাই রংয়ের গাড়ি সা-সা করে দ্রুত গতিতে এপাশ ওপাশ দিয়ে চলে যায়। শিউলির মন আঁতকে ওঠে, হয়তো এই বুঝি তার হাবিলদার এসে পিছন থেকে ডাক দিবে তাকে, হয়তো বলবে-
‘তোমরা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছ কেন? নিজের ঘরবাড়ি রেখে কেউ পালায়? ভয় নেই। আমি আছি। দেখি কোন নেড়ি কুত্তার বাচ্চা তোমাদের গায়ে হাত দেয়। একটা একটা করে গুলি করে মারব। আমার এলএমজির গুলি একটাও মিস হয় না (অসমাপ্ত)