পক্সিক্ষরাজ

জানে আলম মুন্সী

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আরজু মিয়া খুব ভোরে তার নতুন রিকশাটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। কষ্টের পৃষ্ঠে বহু দিনের জমানো অর্থ দিয়ে কেনা তার এই নতুন রিকশা। রিকশাটা আজই প্রথম রাস্তায় নামায় আরজু মিয়া। আজ তার মন খুব উৎফুল্ল। আজ তার এক মাত্র মেয়ে ময়নার বিয়ের সমন্দ নিয়ে মেহমান আসবে বাসায়। তাই তো একটু সকাল সকাল নতুন রিকশাটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল আরজু মিয়া। সকাল থেকে প্যাসেঞ্জার ও ভালোই পাইল সে। সকাল ১০টা না বাজতেই ৬০০ টাকা ইনকাম হয়ে গেছে। আরজু মিয়ার খুশির সীমা নাই। চৈত্র মাসের দুপুর। প্রচণ্ড রোদ। এই রোদের মধ্যে পায়ে ঠেলা রিকশা চালানো বড়ই পরিশ্রমের কাজ। পিচঢালা রাস্তায় পা পড়লে মনে হয় পা পুড়ে যায়। আরজু মিয়ার রিকশাটা নতুন হলেও পায়ের স্যান্ডেলটা বেশ পুরোনো। তলা ক্ষয়ে গেছে। দুপুরের এই তপ্ত রাস্তায় যখন তার পা পুড়ে, তখন আরজু মিয়া বুঝতে পারে না পায়ে স্যান্ডেল আছে কি নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে আরজু মিয়ার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। রিকশা নতুন হলেও আরজু মিয়া চালক হিসাবে নতুন নয়। ২৫ বছর এই ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। পাক্কা ড্রাইভার সে। এত দিন সে ভাড়ায় অন্যের রিকশা চালাত। এখন তার নিজের রিকশা হয়েছে। আজ থেকে আর তাকে এক টাকাও জমা দিতে হবে না মহাজনকে। সূর্যটা পূর্ব দিক হতে একটু একটু করে মাথার উপরে আসছে। গরমে আরজু মিয়া একটু দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারপরও তার মনোবল ভাঙে নাই। সে তার পক্সক্ষীরাজকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় দাঁপিয়ে বেড়ায়। তার নতুন রিকশার নাম পক্সক্ষীরাজ। পক্সক্ষীরাজের যখন জন্ম হয় তার বন্ধুরা তাকে পঙ্খিরাজকে জন্মাতে নিষেধ করছিল। কারণ এখন আর কেউ প্যাডেল ঠ্যালা রিকশায় উঠতে চায় না। আবার উঠলেও ভাড়া দেয় কম। আরজু মিয়া তাদের কথা না শুনে পায়ে ঠ্যালা রিকশাই বানালেন। কেননা ইঞ্জিনচালিত রিকশা বানাতে অনেক টাকা লাগে। এই মুহূর্তে তার হাতে তত টাকা নেই। প্রচণ্ড রোদে আরজু মিয়া হাপসে গেছে। তাই তো সূর্যটা মাথার উপর না আসতেই সে ভাবছে দুপুর হয়ে গেছে। তার হাতে থাকা পুরোনো ঘড়িটায় সময় দেখল আরজু মিয়া। এগারোটা চল্লিশ। সে ভাবলো আর ঘণ্টাখানেক রিকশা চালিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাবে। ভালো লাগলে বিকালে বের হবে না লাগলে নাই। ভাপসা গরম। কোথাও একটু বাতাস নাই। রাস্তার পাশে কোথাও একটাও গাছ নাই যে কোনো গাছের ছায়ায় আরজু মিয়া তার পক্সক্ষীরাজকে নিয়ে একটু দাঁড়াবে। আজ পক্সক্ষীরাজের জীবনের প্রথম দিন। এই দিনে তাকে বেশি কষ্ট দিতে চায় না আরজু মিয়া। শহরের রোদ বড় নির্দয়। গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে যায়। আরজু মিয়া এই রোদের মধ্যেই একটা টিপ নিয়ে টিকাটুলি থেকে সেগুনবাগিচা গেল। সেগুনবাগিচা নামটা শুনেই ভালো লাগল তার। সে মনে করছে সেগুনবাগিচা জায়গাটা গাছ গাছালিতে ভরা এক বিশাল বাগান। সেখানে গেলে হয়তো কোনো বৃক্ষছায়ায় দাঁড়িয়ে পক্সক্ষীরাজকে একটু বিশ্রাম দেয়া যাবে। কিন্তু সেগুনবাগিচায় যে একটাও সেগুনগাছ নেই তা জানা ছিল না আরজু মিয়ার। এখানে এসে দেখে কোনো গাছই নেই। না সেগুন, না রেন্ট্রি। এখানে শুধু উঁচা উঁচা দালানকোঠা আর রাস্তায় দামি দামি গাড়ি। আরজু মিয়া রাস্তার পাশে একটি অফিসের গেটের সামনে বিল্ডিংয়ের ছায়ায় দাঁড়াল। অফিসের গেট দেখে বুঝা যায় এটা কোনো বড় অফিসারের অফিস। একটু না দাঁড়াতেই ২-৩ জন সিকিউরিটি গার্ড এসে তার পক্সক্ষীরাজের মাথায় লাঠি দিয়ে টাস করে একটা বারি মারে আর মুখে বলে- এখান থেকে ভাগ। পক্সক্ষীরাজ ব্যাথা পেল কি না বুঝা গেল না। কিন্তু আরজু মিয়ার কলিজা ফেটে গেল। আরজু মিয়া দারোয়ানের ব্যবহারে প্রচণ্ড কষ্ট পেল। রিকশা চালায় বলে তাকে তুই করে বলবে? তার সখের পক্সক্ষীরাজের মাথায় বাড়ি মারবে? অন্তত তুমি করে বলতে পারত। পক্সক্ষীরাজকে না মারলেও পারত। অফিসে চাকরি করে বলে তারা মানুষকে এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে? কি আর করার প্রতিবাদ করার ভাষা কিংবা সাহস নাই আরজু মিয়ার। তাই তো সাথে সাথে আরজু মিয়া তার পক্সক্ষীরাজকে নিয়ে আবার চলতে শুরু করল। (চলবে)