আমার দেখা (পর্ব-১)

জুলাইয়ের রক্তাক্ত সংগ্রাম

জিয়া উদ্দিন আয়ান

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

৩ জুলাই ২০২৪, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ঢাকা আরিচা মহাসড়কে মানববন্ধনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের যাত্রা শুরু। দফায় দফায় সড়ক অবরোধ বাংলা ব্লকেডের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের কোটা বিরোধী আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে। কোটা না মেধা? মেধা, মেধা.... স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ। আন্দোলনের সম্মুখ সারি থেকে জ্বালাময়ী স্লোগান আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে প্রতিনিয়ত ছাত্রলীগের হুমকির স্বীকার হতে হয়। ১২ জুলাই আন্দোলন শেষে হলে ফিরেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ছাত্রলীগের রোষাণলে পড়ি। তারা হুমকি দিয়ে আমার কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কমিটিতে আমার নাম থাকায় হলে ছাত্রলীগের ব্লকের রুমে ডেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করার জন্যে হুমকি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৩ জুলাই বিকালে ঢাকা আরিচা মহাসড়কে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষাণলে পড়ি। সব হুমকি-ধমকি বাধা বিপত্তি ছাড়িয়ে যৌক্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাই। ১৪ জুলাই রাতে তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার! কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার! স্লোগানে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ২ জন শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য রুমে আটকে রাখে ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরবর্তীকালে আমরা বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল প্রাঙ্গণে গিয়ে স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদ জানাই। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা হলের ছাদ থেকে আমাদের ওপর ইট-পাটকেল মারা শুরু করে। এ সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। ১৫ জুলাই ২০২৪ জাহাঙ্গীরনগরের কালরাত। ঐদিন সন্ধ্যায় ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মিছিল শুরু হয়। পরবর্তীকালে সেই মিছিলে বঙ্গবন্ধু হল প্রাঙ্গণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীরা। এ সময় নারী শিক্ষার্থীসহ অনেকেই গুরুতর আহত হয়। মেয়েদেরকে পিটিয়ে শরীররের স্পর্শকাতর জায়গায় ধরে বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত করা হয়। অনেক শিক্ষার্থী আহত বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে ভর্তি হয়। রাত ১০টায় শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের অতর্কিত হামলার বিচারের দাবিতে উপাচার্য বাসভবনের গেইটের সামনে জড়িত হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বহিরাগত ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীযোগে অস্ত্রশস্ত্র, ছুড়ি, লাঠিসোঁটা, রামদা, পেট্রোলবোমা নিয়ে উপাচার্য বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে ঐ সময় অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে ভিসি বাসভবনের গেইটের ভিতরে আশ্রয় নেয়।

এক্ষেত্রে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকে। রাত আড়াইটায় বিভিন্ন হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ডাকে আমরা লাঠিসোঁটা নিয়ে সবাই একযোগে বের হয়ে ভিসি বাসভবনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচবার জন্য যায়। প্রায় হাজারো শিক্ষার্থীদের আগমনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ভিসি বাসভবনসহ পুরো ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের আগমনের মধ্য দিয়ে ভিসি বাসভবনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত মৃত্যুকুপ থেকে বেঁচে ফিরে। পরবর্তীতে পুলিশের জলকামানে বাধার কারণে দফায় দফায় আমরা ইটপাটকেল ছুরি। ঐদিন রাতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থেকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হই। ১৫ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। ১৬ জুলাই ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়িত হয়। সেদিনও স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। ঐদিন সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় প্রশাসনের হল ভ্যাকেন্ট ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা। হল বন্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টা রুখে দাড়াতে আমরা ১৭ জুলাই সকাল হতেই রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে থেকে প্রতিবাদ করি। ঐ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় গেইটের বাহিরে পুলিশ, বিজিবি ও সাজোয়াঁযান মোতায়েন ছিল। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তে রেজিস্ট্রারের হল ভ্যাকেন্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রারের ওপর জুতা নিক্ষেপ করে এবং ভিতরে সব দরজা ভেঙে ফেলে। হল ভ্যাকেন্ট সিদ্ধান্তের কারণে উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের রেজিস্ট্রার ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

(এরপর আগামী মঙ্গলবার)