হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদ

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মাহমুদ হাসান

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের রমনা এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। মোগল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মিত হয়। মসজিদটি হাইকোর্টের পেছনে এবং তিন নেতার মাজারের পূর্ব পাশে অবস্থিত। এর চত্বরে হাজী শাহবাজের সমাধি অবস্থিত। হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ নামের পাশাপাশি এ মসজিদ হাজী খোওয়াজা শাহবাজ মসজিদ, জিনের মসজিদ, তিন গম্বুজ মসজিদ, লাল মসজিদ, জোড়া মসজিদ ইত্যাদি নামেও পরিচিত।

মূল মসজিদটি মাটির অনুচ্চ এক মঞ্চের ওপর দণ্ডায়মান। আয়তকার মসজিদটি বাইরের দিক থেকে দৈর্ঘ্যে ২০.৭৩ মিটার ও প্রস্থে ৭.৯২ মিটার, দেওয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১.২২ মিটার। এর চার কোণায় ৪টি বুরুজ আছে যেগুলো ছাদবেড়ি পর্যন্ত অষ্টকোণাকার এবং এর ওপর থেকে গোলাকার রূপ ধারণ করে ছাদ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেছে। প্রতিটি বুরুজ নিয়মিত বিরতিতে আলংকরিক পট্টি দ্বারা নকশা করা আর চূড়াদ- শিরাল নিরেট অণুগম্বুজ দিয়ে সজ্জিত। বুরুজগুলোতে কারুকাজ করা পট্টি ও ছাদবেড়িতে ‘মার্লন’ নকশায় শোভিত। পূর্ব দেওয়ালের কেন্দ্রীয় দরজার দু’পাশে ও উভয় পাশের দরজার অন্য পাশে আরও দুটি মোট চারটি, উত্তর ও দক্ষিণ পাশের দরজার দু’পাশে দুটি এবং পশ্চিম দেওয়ালে পূর্ব দেওয়ালের মতো চারটি সরু বুরুজ কার্নিশের সামান্য ওপরে উঠে শেষ হয়েছে।

আঙিনা অতিক্রম করে মসজিদে প্রবেশ করার জন্য পূর্ব দেওয়ালে ৩টি বহুপত্র বিশিষ্ট খিলান দরজা আছে। মাঝেরটি তুলনামূলক বড় এবং কাল পাথরের চৌকাঠ দিয়ে গঠিত। পাশের দুটি মাঝেরটি থেকে খানিকটা ছোট। তিনটি প্রবেশপথই পরপর দুটি খিলান দ্বারা গঠিত। পূর্ব দেওয়ালের খিলানগুলো সামনের দিকে সামান্য অভিক্ষিত, খাঁজকাটা ও ভেতরের দিকের তুলনায় একটু উঁচু আর ভেতরেরগুলো চারকোণাকার। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেওয়ালের ভেতরের দিকে পূর্ব দেওয়ালের খিলানপথগুলোর মুখোমুখি তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি বড় এবং বাইরের দিকে উৎগত। এর পাশে ইসলামিক চিরায়ত ধারায় তিন ধাপবিশিষ্ট একটি মিমবার আছে। মিমবারটি কালো পাথরের তৈরি এবং এর সর্বোচ্চ ধাপটি সারিবদ্ধভাবে ফুলের নকশা কাটা। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও প্রবেশপথের অভিক্ষিত কাঠামোর উভয়পাশে ছোট ঠেসবুরুজ ছাদবেড়ি ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং চূড়াদ- কলশ ও ছোট গম্বুজ দ্বারা সজ্জিত। ঠেসবুরুজগুলোর ভিত্তি কলশ নকশায় শোভিত। মিহরাব খিলানের খিলান গর্ভ বর্শা ফলক নকশায় সজ্জিত এবং ফুলের নকশা কাটা। মিহরাব ও খিলানপথ বাদ দিলে এই মসজিদের গায়ে মোগল স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য খিলান খোপ/আয়নাখোপী নকশার পলেস্তরা করা। প্রত্যেক দরজার ওপর সুন্দর খাঁজকাটা ও দরজার সর্বোচ্চ অংশ পত্রাকারে শেষ হয়েছে। মসজিদে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন ভিত্তির সামনের দেওয়ালের নিচে অলংকৃত পাথর বসানো আছে। প্রতিটি দরজার সামনে মেঝের খানিকটা অংশে পাথর বসানো এবং চৌকাঠ ও পাথরের তৈরি।

ইটের জোড়াস্তম্ভ থেকে ওপরের দিকে উঠে একটি প্রশস্ত আড়াআড়ি খিলান মসজিদের ভেতরের অংশকে তিনটি বর্গাকার (প্রতি বাহুর পরিমাপ ৫.১৮ মিটার) অংশে বিভক্ত করেছে। প্রতিটি অংশের ওপর একটি করে মোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত তিন গম্বুজ মসজিদের দু’ধরনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, এর প্রথমটি যার তিনটি গম্বুজই সমান আকার-আকৃতির ও দ্বিতীয়টি যার মাঝের গম্বুজটি অপর দুটি থেকে তুলনামূলক বড়। বোঝাই যাচ্ছে এই মসজিদ প্রথম ধরনটির সঙ্গে মিলে যায়। মূলত এ ধারার ঢাকায় এটিই একমাত্র মসজিদ। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চল যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের ফিরোজপুর গ্রামের শাহ নেয়ামত উল্লা ওলি মসজিদ (স্থাপিত : ১৮ শতকের মধ্যভাগ), বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকারটোলা গ্রামের খন্দকারটোলা মসজিদ (স্থাপিত : ১৬৩২ খ্রি:), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলা সদরের আরিফাইল গ্রামের আরিফাইল মসজিদের (স্থাপিত : ১৬৬২ খ্রি:) সঙ্গে এর মিল রয়েছে। অন্চ্চু কাঁধযুক্ত ড্রামের ওপর স্থাপিত এসব গম্বুজের ওপর পদ্ম ও কলস চূড়া রয়েছে। কেন্দ্রীয় গম্বুজের ভেতরের ভিত্তিমূলে কোনা বের হওয়া ইটের অভিক্ষেপ ও এর ওপর পেঁচানো দড়ির মতো নকশা করা হয়েছে। গম্বুজ কেন্দ্রে স্তরীকৃত রোজেট নকশা দেখতে পাওয়া যায়।

আড়াআড়িভাবে স্থাপিত খিলানগুলোর ভার-বহনকারী জোড়া-স্তম্ভ ও মিহরাব খিলানের খিলান গর্ভের বর্শা ফলক নকশা এ মসজিদকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিতে সক্ষম হয়েছে। কেননা, জোড়া-স্তম্ভ ও বহু-খাঁজ সংবলিত খিলান উত্তর-ভারতীয় মোগল স্থাপত্যরীতিতে দৃশ্যমান। আর এখানে যে তা অনুকরণ করা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।