হাদিস বিচারে পশ্চিমা একাডেমিয়ার অবিচার

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হাদিসের প্রতি পশ্চিমা একাডেমিয়ার আগ্রহ সপ্তদশ শতকে শুরু হলেও ঊনিশ শতককে ধরা হয় হাদিস অধ্যয়নের ‘গঠনমূলক’ সময়কাল হিসেবে। কোরআনের তুলনায় হাদিস অধ্যয়নে পশ্চিমের বিলম্বিত সাড়া একটি লক্ষ্যযোগ্য বিষয়। কিন্তু চরিত্রগতভাবে উভয় সাড়ায় অমিল ছিল কম। মিলের মূলে আছে উভয়ের যথার্থতার প্রতি অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যান।

হাদিস প্রশ্নে অস্বীকৃতিমূলক অবস্থান ঘোষণা করেন বার্থেলেমি ডি’হারবেলট (১৬২৫-১৬৯৫)। ফরাসি এই চিন্তক প্রাচ্যবাদে কর্তৃত্বসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব। প্যারিসে জন্ম তার, পড়াশোনা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্পেনিশ অনুপ্রেরণায় প্রাচ্য ভাষা অধ্যয়নে নিয়োজিত হন। ইতালির বিভিন্ন বন্দর তখন মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সে সব বন্দরে তার যাতায়াত ছিল বেশ। ইতালিতে তিনি পরিচিত হন ডাচ এক্টিভিস্ট হলস্টেনিয়াসের (১৫৯৬-১৬৬১) সঙ্গে, গ্রিক পণ্ডিত লিও অ্যালাটিয়াসের (১৫৮৫-১৬৬৯) সঙ্গে। দেড় বছর পর ফ্রান্সে ফিরেন। অচিরেই রাজার সেক্রেটারি এবং প্রাচ্য ভাষার দোভাষী হিসেবে নিয়োগ পান। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি অধ্যয়নে তার মনোযোগ আরও জোরদার হয়। কয়েক বছর পরে যখন ইতালি গেলেন, তাসকানির গ্র্যান্ড-ডিউক দুই নম্বর ফার্ডিনান্ড তাকে দিলেন ইসলাম ও প্রাচ্য সম্পর্কিত প্রচুর পা-ুলিপি। যেগুলোর অধিকাংশই ছিল একান্ত বিরল। ইতালির আদালতে তাকে যুক্ত করার চেষ্টা হলেও শেষ অবধি ফরাসি রাজার কাছে তিনি ফিরে যান। ১৬৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর প্যারিসে মৃত্যুর আগ অবধি প্রাচ্য-ভাষা অধ্যয়ন ও ইসলাম গবেষণায় তিনি পালন করেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা।

হারবেল্টের ঘৃণাভাষ্য

তার বিশ্বকোষ গ্রন্থ Bibliothèque orientale ou Dictionnaire universel-এ রয়েছে হাদিসের ওপর মতামত। পশ্চিমা দুনিয়ায় কয়েক শতাব্দী ধরে একে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শ্রেষ্ঠ আকরগ্রন্থ বলে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। কিন্তু গ্রন্থটি মূলত ছিল হাজ্জী খলিফার (১৬০৯-১৬৫৭) কাশফুজ জুনুন আন আসামিল কুতুব ওয়াল ফুনুন গ্রন্থের অনুবাদ। মুসলিম উৎস থেকে ধার করতেন বার্থেলেমি। কিন্তু ইসলামকে আক্রমণের প্রশ্নে চরমপন্থি ছিল তার কলম। মহানবী (সা.) সম্পর্কে তার অবস্থান হলো নেতিবাদী। তিনি তাঁকে (সা.) মিথ্যাবাদী হিসেবেই চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন।

তার মানসিকতার অবয়ব ধরা পড়ে তার রচনায়। যাকে কোনোভাবেই পণ্ডিতসুলভ অভিব্যক্তি বলার সুযোগ নেই। বরং সেখানে দেখা যায় প্রচণ্ড ফেনায়িত ক্ষোভ। বার্থেলেমি ইসলামের সবকিছুকেই আক্রমণ করেছেন। তার বয়ান হাদিসের ঐশী যোগসূত্রকে যেমন অস্বীকার করে, তেমনি এর ঐতিহাসিক মূল্যকেও করে অস্বীকার। আমরা যদি হারবেল্টের বয়ান লক্ষ্য করি, বিষোদ্গারে পরিপূর্ণ বাক্যাবলির মুখোমুখি হবো। বিবলিওথেক ওরিয়েন্টালে মহানবীর (সা.) পরিচয় দিতে গিয়ে মাহোমেত শিরোনামে তার ভাষ্য হচ্ছে- ‘এই হলো কুখ্যাত প্রতারক মাহোমেট, এক বিদ্রোহী বিশ্বাসের রচয়িতা ও প্রতিষ্ঠাতা, যা একটা ধর্মের রূপ নিয়েছে। আমরা যাকে বলি মুহাম্মাদাডান।’

ইসলাম শিরোনামে তার যে রচনা, সেখানে একই রকম বিদ্বেষ, একই হিংস বয়ান- ‘আল কোরআনের অনুবাদক আর মোহামেডান আইনের অন্যসব পণ্ডিত এই মিথ্যা পয়গাম্বরকে যেসব প্রশংসামূলক অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন, সেগুলো বস্তুত এমন আখ্যা, যা আর্য, পলিসীয়, পলিয়সয়নিস্ট আর অন্যসব ধর্মদ্রোহীরা প্রয়োগ করেছে যিশু খ্রিস্টকে তার পবিত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে।

এই যে সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান, যার পেছনে ঐতিহাসিক সত্যের কোনোই সমর্থন নেই, সেখান থেকে নতুন বাঁক নিল পশ্চিমা পণ্ডিতি পরিসরের হাদিস অস্বীকার। যেখানে মহানবী (সা.) সম্পর্কে জ্ঞানকর্ম হিসেবে প্রচলিত কাজও জ্ঞান-প্রজ্ঞার ন্যূনতম দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রাখছিল না। বরং তা হয়ে উঠছিল সত্যকে অবজ্ঞা ও অন্ধ অন্ধকারের দলিল।

যুক্তিহীন বিকারের উত্তরাধিকার

নমুনা হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত মাহোমেট : দ্য ট্টু নেচার অব ইম্পোস্টার গ্রন্থটি। লেখক হামফ্রি প্রিঅড। নবীজী (সা.) সম্পর্কে হামফ্রির বিরক্তিকর মিথ্যার নমুনা লক্ষ্য করা যাক-

প্রথম জীবনে খুবই উচ্ছৃঙ্খল, লাম্পট্যময় দিন কাটিয়েছেন তিনি। আরবদের চলতি রীতিতেই তার আনন্দ ছিল ধ্বংসে, লুটপাটে, রক্তপাতে। এ জীবনে অভ্যস্ত ছিল আরবরা। ... তার সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল উচ্চাভিলাষ ও লালসা। সাম্রাজ্য গড়ার জন্য যে পন্থা তিনি অবলম্বন করেন, তা থেকেই প্রথমটির ইশারা পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয়টিকে প্রমাণ করে তার স্ত্রীদের সংখ্যা। আর আসলেই তার ধর্মের গোটা কাঠামোজুড়ে আছে এই দুই বিষয়।’

ক্যারেন আর্মস্ট্রং হামফ্রের রচনার চরিত্রকে চিত্রিত করেছেন অতীতের সব যুক্তিহীন বিকারের পুনরাবৃত্তি হিসেবে। যুক্তিহীন বিকার চলে আসছিল বহু শতকের ওপার থেকে। সেই যে স্পেনিশ প্রিস্ট ইউলোজিও এবং পল অ্যালভারো, যারা শুরু করেছিল নবী অবমাননার আন্দোলন, অষ্টম শতক থেকে সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা পরে আর থামল কই? কেবলই মাত্রায় এসেছে স্বাতন্ত্র, নতুনত্ব।

স্পেনে সূচিত সেই আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিল নবীজির জীবনীর নামে শত্রুতার উদ্যমে চিৎকৃত মিথ্যাপূর্ণ এক গ্রন্থ, যা রচিত হয় প্যাম্পলনার নিকটবর্তী লেয়ারের মনস্টারিতে। ‘খ্রিস্টান বিশ্ব তখন ইসলামি মহিরুহের মুখোমুখি হয়ে থরথর কম্পমান ছিল। রাজনৈতিক হুমকি ছাড়াও ইসলামের উত্থান একটা চিন্তাজাগানো ধর্মীয় জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছিল: ঈশ্বর কেমন করে ধর্মহীন এই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা হতে দিলেন? তাহলে কি আপন জনগণকে তিনি ত্যাগ করলেন?’ গ্রন্থটিতে ছিল শঙ্কাভরা কল্পকাহিনি। যার দাবি হলো মহানবী (সা.) ছিলেন মিথ্যা নবী, যিশুর পথ থেকে পৃথিবীকে ভুল দিকে হাঁকিয়ে নেয়ার জন্য নবী হওয়ার ভান করেন। তার শিক্ষা লাম্পট্য, মিথ্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, হত্যার উস্কানি ও খ্রিস্টবিশ্বাসের ব্যর্থ অনুকরণ মাত্র।

হারবেল্টের ভাষ্যে এই মিথ্যার প্রতিধ্বনি কি আমরা শুনিনি? এমনই আওয়াজ আমরা শুনেছি ক্রুসেডের সময় রচিত সং অব রোল্যান্ডে, সেখানে মুসলিমদের দেখানো হয়েছে মূর্তিপূজক হিসেবে। যারা দেবতা অ্যাপেলো, টারভাজান্ট আর মাহোমেটের পূজা করে! তারপর উদ্ভট প্রচারণার মাত্রা কমিয়ে মিথ্যাকে সত্যের মতো করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে বটে। তবে তার ধরন কেমন, তা জানা যাক ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের জবানিতে। পরবর্তী পশ্চিমারা মহানবী (সা.) সম্পর্কে যা প্রচার করে, এর সারবস্তুকে তিনি সাজিয়েছেন আপন ভাষায় : সহজ-সরল আরবদের হাত করা এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের গির্জা ধ্বংস করার জন্য ভুয়া ‘অলৌকিক’ ঘটনার সৃষ্টিকারী একজন জাদুকর তিনি। ... একটা সাদা ষাঁড় এলাকার জনগণকে সন্ত্রস্ত করার পর অবশেষে মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আরবদের জন্য আনীত কোরানসহ উপস্থিত হয়েছে- পবিত্র গ্রন্থখানা ষাঁড়ের দুই শিঙয়ের মাঝখানে অলৌকিকভাবে শূন্যে ভাসছিল। ... মুহাম্মদ (সা.) একটা প্রশিক্ষিত ঘুঘুকে তাঁর কান থেকে মটরদানা খেতে দিতেন। যাতে মনে হয় পবিত্র আত্মা তাঁর কানে কানে কথা বলছে। ... তিনি মৃগী রোগী ছিলেন ... তার ওপর ‘অশুভ আত্মা’র প্রভাব রয়েছে। ... সারজিয়াস নামের ধর্মত্যাগী এক মঙ্ককে ন্যায়সঙ্গতভাবে খ্রিষ্টরাজ্য থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল- আরবে মুহাম্মদের (সা.) সঙ্গে সে সাক্ষাৎ করে ওখানে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে নিজের ভ্রান্ত ধারণা মুহাম্মদকে (সা.) শিক্ষা দেয় সে। ’

মিথ্যার এই যে বেসাতি, সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে পশ্চিমের মহানবীর (সা.) সমালোচনার প্রধান ধারা। ‘মানুষের জানা যত বিকৃতি আছে সবই আরোপ’ করেছে মহানবীর (সা.) ওপর। দাবি করেছে ‘মানুষকে তার সবচেয়ে জঘন্য প্রবৃত্তি সন্তুষ্ট করার উৎসাহ দিয়ে তাদেরকে তিনি আপন ধর্মে আকৃষ্ট করতেন।’ তাদের মনের কামনার সঙ্গে মানানসই একটা পরিণতি দিয়ে সাজানো হয়েছে মহানবীর জীবনের সমাপ্তিকে। সেটা হলো ‘এক অশুভ খিঁচুনির সময় একপাল শূকর তাঁকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। ’

এসব কল্পকাহিনি বর্ণনার ধারা শুধু ধর্মালোচক বা জীবনী লেখকদের মধ্যে ছিল, তা নয়। দান্তের মতো কবিও দ্য ডিভাইন কমেডিতে নরকের অষ্টম ধাপে মহানবীকে প্রতিস্থাপন করেন! পিটার দ্য ভেনারেবল, অ্যাক্ট অব ক্ল্যানির সুর কিছুটা শান্ত ও কম উত্তেজিত ছিল বটে। ইসলাম মূর্তিপূজার ধর্ম, এই মিথ থেকে তারা সরে আসতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এটি মিথ্যা ও ভ্রষ্ট এক বিকৃতি, সেই অবস্থানে দৃঢ় ছিল তাদের কণ্ঠস্বর। জন ওয়াইক্লিফ, নিকোলাস অব কুসা থেকে নিয়ে বার্থেলমির সোচ্চারতায় ছিল একই প্রতিধ্বনি।

রেনান থেকে স্যাচাও

মানসিকতার এই কেন্দ্র থেকে জন্ম নেয় যে হাদিসদৃষ্টি, সে হাদিসকে মিথ্যার সমাহার হিসেবে দেখবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রেনেসাঁ-পরবর্তী পশ্চিমা দুনিয়ায় হাদিস অধ্যয়ন সেই উত্তরাধিকারকে এড়াতে পারেনি। প্রভাবশালী ফরাসি গবেষক আর্নেস্ট রেনান (১৮২৩-১৮৯২)-এর হাদিস দৃষ্টি একই মোহনায় মিলিত হয়। তিনি দেখান হাদিস কম মনোযোগের যোগ্য। কারণ এর ঐতিহাসিক মূল্য কম। নির্ভরযোগ্যতা ভঙ্গুর ও সংশয়পূর্ণ। একজন প্রাচ্যবিদ এবং সেমেটিক পণ্ডিত, সেমেটিক ভাষা ও সভ্যতার বিশেষজ্ঞ, ধর্মের ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, বাইবেলের পণ্ডিত এবং সমালোচক হিসেবে রেনান আপনকালে উচ্চতর শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি লাভ করেন। ISLAM AND SCIENCE ফরাসি L'ISLAMISME ET LA SCIENCE, (১৮৮৩) গ্রন্থে তিনি মুসলিমদেরকে ইসলামের প্রথম শিকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মুসলিম দুনিয়া ভ্রমণ করে তার চোখ দেখে ধর্মান্ধতা আর সন্ত্রাস। বইটিতে স্পষ্ট দাবি করেন মুসলিমদের কল্যাণ নিহিত আছে ইসলাম থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্যে। তার বিখ্যাত উক্তি- To liberate the Muslim from his religion is the best service that one can render him. মানে মুসলিমদের তাদের ধর্ম থেকে মুক্ত করাই হচ্ছে তাদের দেয়ার মতো সর্বশ্রেষ্ঠ সেবা। অতএব হাদিস থেকে মুসলিমদের আস্থা ও বিশ্বাসকে মুক্ত করা তার জন্য জরুরি হবে, এটাই স্বভাবিক।

জরুরতের এই উপলব্ধি ছিল পশ্চিমা হাদিস দৃষ্টির কেন্দ্রে। একে সে পরবর্তি সময়ে বর্জন করেনি। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় যে, পশ্চিমা একাডেমিয়ায় হাদিস চর্চা ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে অচিরেই। কারণ ইসলামের বোঝাপড়ায় হাদিসকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রধানত ঐতিহাসিক বিবেচনা ছিল এর মূলে। ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি মনোযোগও ছিল কমবেশি। তবে হাদিসের নির্ভরযোগ্যতার সমালোচনা করার পাশাপাশি ইসলামি ইতিহাসের আইনি প্রতিষ্ঠান ও ধারাগুলোর ওপর তদন্ত করার অভিপ্রায় হাদিস চর্চার লক্ষ্য হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল।

ইসলামের উদ্ভব ও বিকাশের বিশ্লেষণে, এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিকরণে প্রাচ্যবাদ মূলত অস্বীকৃতির কাছ থেকে প্রেরণা নিয়েছে। হাদিস সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্যগুলোতে বস্তুনিষ্ঠতার তালাশ সাধারণত ব্যর্থচেষ্টায় পরিণত হয়।

মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী পূণর্গঠন ও পুনর্পঠনের প্রাচ্যবাদী প্রয়াসের অগ্রদূত গুস্তাভ ওয়েইল (১৮০৮-১৮৮৯) অ্যালওয়েজ স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৫৬) বস্তুনিষ্ঠতা দেখাতে চেয়েছেন, যা প্রকারান্তরে হয়ে উঠেছে ভান করা ব্যাপার, পুরোনো বক্তব্যের নরোম নবায়ন। উইলিয়াম ম্যুর (১৮১৯-১৯০৫) দাবি করেছিলেন ইসলামি উৎসসমূহের ওপর সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করবেন। দ্য লাইফ অব মাহোমেট গ্রন্থে কোরআনের পাশাপাশি হাদিসকে তিনি নবীজীবনীর প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু গ্রন্থের পাতায় পাতায় অপ্রমাণিত আরোপকে এড়াতে পারলেন না তিনি। ফলে স্যার সৈয়দ আহমদের ভাষায় তার রচনাকর্ম হয়ে উঠল ‘ইসলামকে সংশয়জীর্ণ করার কৌশলী প্রপাগান্ডা মাত্র।’

উইলিয়াম মুইর হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা শনাক্ত করার জন্য কিছু মানদণ্ড নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী হাদিস গবেষণায় প্রাচ্যতাত্ত্বিক বয়ান যে সুগঠিত অবয়ব লাভ করে, এর গেটওয়ে গড়ে দেন স্প্রেংগার-মুইর!

ইসলামি আইনের উদ্ভব এবং এর বিকাশের আলোচনায় হাদিসের প্রাসঙ্গিকতাকে বিশ্লেষণে আনেন জার্মান প্রাচ্যবিদ এডওয়ার্ড সাচাউ (১৮৪৫-১৯৩০)। ইসলামি আইন ও হাদিসের মধ্যে দৃঢ় ও প্রগাঢ় সম্পর্কের প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ফলে কোরআনের পাশাপাশি হাদিসের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি দিয়ে পশ্চিমা একাডেমিয়া হাদিস বিচারে অধিকতর মনোযোগ প্রদান করে। সূচিত হয় হাদিস গবেষণার নতুন যুগ।