একটি সময় ছিল যখন মুসলিম জাহান বলতে মধ্যপ্রাচ্য ও নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশকে বুঝাত। এখন কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিষ্ঠান অনেকদূর ছড়িয়ে গেছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে সেনেগাল পর্যন্ত বিস্তৃত এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশের মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে মুসলমানরা প্রধানত বাস করলেও অমুসলিম প্রধান দেশগুলোতে বসবাস করছেন ৩০ কোটিরও অধিক মুসলমান। এর মধ্যে ইউরোপেই আছেন ৩ কোটি ৮০ লাখ মুসলমান। ফ্রান্সে বাস করেন ৫০ লাখের অধিক মুসলিম, জার্মানিতে মুসলিম জনসংখ্যা ৫৭ লাখের উপরে, ব্রিটেনে বসবাসকারী মুসলিম জনসংখ্যা ৪২ লাখ অতিক্রম করেছে। বিপুল সংখ্যক মুসলিম আছেন নেদারল্যান্ডস, ইতালি, স্পেন ও সুইডেনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন ৪৬ লাখ মুসলমান। ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোতে বসবাসরত মুসলিমদের সংখ্যা কম নয়। এই মুসলমানদের বাদ দিয়ে মুসলিম উম্মাহ ভাবনা কখনও যথাযথ হবে না।
মুসলিম বিশ্ব বলতে যদি বুঝি মুসলিম প্রধান দেশগুলোকেই; তাহলে ভুল করে ফেলব। কেননা জর্ডান ও লেবাননের মতো মুসলিম প্রধান দেশের চেয়ে অধিক সংখ্যক মুসলমান বসবাস করেন জার্মানি ও রাশিয়ার মতো দেশে। বাংলাদেশের মতো দেশের মোট অধিবাসীদের চেয়ে অধিকসংখ্যক মুসলিমের বসবাস ভারতে। এর মানে ১৭০ কোটি সদস্য বিশিষ্ট মুসলিম উম্মাহ এখন আর নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আবদ্ধ নেই, পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে। অঞ্চল বিচারে এশিয়া-ওশিনিয়ায় মোট জনসংখ্যার ২৪.৪ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৯১.২ শতাংশ, সাব-সাহারা অঞ্চলে ২৯.৬ শতাংশ, ইউরোপে ৬ শতাংশ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় আছে ০.৬ শতাংশ মুসলিমের বসবাস। এ ছড়িয়ে থাকার যেমন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিশ্বসভায় মুসলমানদের সংখ্যাগত অবস্থান। কেননা, মুসলিমরা এখন সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার ২৩.৪ শতাংশ!
বিগত শতকগুলোর দিকে তাকালে একুশ শতকে মুসলিম জাহানকে তুলনামূলকভাবে অগ্রসরমান ও ইতিবাচক অবস্থানে দেখা যায়। উনিশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরুতে নেপোলিয়নের মিসর জয়ের ধাক্কা মুসলিম জাহানে পরাজিত মানসিকতাকে ব্যাপক আকার দেয়। এরপর ওসমানি সাম্রাজ্যের পতনকে বলা হচ্ছিল মুসলিমদের কফিনের সম্ভবত শেষ পেরেক! মুসলিম রাষ্ট্র ও জনপদগুলো হয়ে উঠেছিল অন্যের উপনিবেশ। পশ্চিমা রাজনীতিবিদ এবং প্রাচ্যবিদরা আশা করছিলেন, তাদের জীবদ্দশায়ই ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নাই হয়ে যাবে। এমনটি দেখতে পাবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন অনেকেই। সম্পূর্ণ নাই হয়ে যাওয়ার আগে একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় হিসেবে ইসলামকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রাখার প্রয়োজন অনুভব করে অনেকেই ইসলাম নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা শুরু করে দেন। হারিয়ে যেতে বসা একটি জাতির চিত্র ও চরিত্র উপস্থাপনে অনেকেই হন মনোযোগী- যেহেতু ভবিষ্যতে এই চিত্র ও চরিত্র পৃথিবী আর দেখবে না! মুসলিম জাহানের অবস্থা ছিল সত্যিকার অর্থেই করুণ।
ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান মক্কা ও মদিনার চিত্র থেকেই একটি অন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। ১৮১৪-১৮১৫ সালে সুইস মুসলিম জোহান লুডউইগ বার্কহার্ট ছয় মাস অবস্থান করেন মক্কা-মদিনায়। ব্রিটিশ মুসলিম স্যার রিচার্ড বার্টন ১৮৫৩ সালে এবং জার্মান অমুসলিম হেনরিখ ভন মাল্টজান ১৮৬০ সালে ছিলেন মক্কায়। এ তিনজনের বিবরণ থেকে একটি চিত্র বের করেছেন মুসলিম দার্শনিক মুরাদ হফম্যান। সে চিত্রে দেখা যায় ক্ষয়িষ্ণুতা, অপরিচ্ছন্নতা, বিপদসংকুলতা, কুসংস্কার আর ইসলামবিরোধী নানা কর্ম! হজযাত্রীদের সংখ্যা বছরে বছরে কমছিল। ১৮১৪ সালে বার্কহার্ট অনুমান করেছিলেন ৭০ হাজার। ১৮৬০ সালে তা কমতে কমতে মাল্টজানের হিসাবে দাঁড়ায় মাত্র ৩০ হাজার।
এই যে পরিস্থিতি, তা এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়। যারা মনে করতেন, ইসলাম মরে যাবে, তাদের অনুসারীরা এখন বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ ও মুসলিম সভ্যতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে শঙ্কিত! পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম আতঙ্ক ধারণ করেছে প্রবল আকার। ভয় ছড়ানো হচ্ছে, মুসলিমরা ইউরোপে আধিপত্য সৃষ্টি করতে চায়! হান্টিংটনের ভাষা ধার করে বলা হচ্ছে, ইসলামই পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও প্রবল প্রতিপক্ষ! ১৮১৪ সালে যেখানে হজযাত্রী ছিলেন ৭০ হাজার , ২০১৪ সালে সেখানে হাজীদের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ! ২০১৯ সালে হজ করেছেন ২৫ লাখের অধিক নর-নারী! মক্কা ও মদিনা আজকের পৃথিবীর পরিচ্ছন্নতম শহর, শিক্ষা-সংস্কৃতি, নিরাপত্তা ও আবেদনে জগৎবরেণ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলিম দুনিয়া সে সময় থেকে এগিয়েছে বলতে গেলে। আজকের বিশ্বে ৫২টি রাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা ৪৯ ।
ধর্ম ও জনজীবন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দি পিউর সূত্রে বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি চারজনে একজন মুসলমান। বিভিন্ন দেশে যে হারে লোক মুসলমান হচ্ছে এবং মুসলিমদের বংশবৃদ্ধির যে হার, তাতে ২০২০ সাল নাগাদ বিপুলতা পাবে আরও। ব্রিটেনে তারা এমনিতেই খ্রিষ্টানদের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী।
সামনের দিনগুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে তারা এই মর্যাদা অর্জন করবেন। ইসলাম এখন গোটা বিশ্বেই এমার্জিং রিলিজিওন হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে। ইসলামের বাহক কাউকে হতে হচ্ছে না। ইসলাম নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে অমুসলিম হৃদয়ে। একজন ভিক্ষু, একজন নান, একজন মডেল তারকা, একজন বিজ্ঞানী কিংবা একজন সেনাসদস্য ইসলাম গ্রহণ করছেন কোনো ধরনের লোভ কিংবা ভীতির ফলে নয়, একান্তই আত্মার দাবিতে, যুক্তির সিদ্ধান্তে। এই বিষয়গুলো ইতিবাচক এবং সন্দেহ নেই, যেকোনো মুসলমানকে উদ্দীপিত করবে।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, একদিকে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে যাপিত জীবনে ইসলামের অনুবর্তিতা ক্রমহ্রাসমান। ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনপ্রক্রিয়া, কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা, বৈপ্লবিক রাজনৈতিক দর্শন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক বিধি-বিধান, ইনসাফপূর্ণ আইন ব্যবস্থা, সহনশীল আন্তর্জাতিক বীধিবিধান প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। মানবসমষ্টির বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য ভৌগোলিক উপাদান, ব্যবহারিক উপাদান এবং মনস্তাত্ত্বিক উপাদানকে ইসলাম কীভাবে উপস্থাপন করে, ভাষা ও সংস্কৃতি, জ্ঞান ও জীবনাচারকে কীভাবে উৎকর্ষ দান করে; বিপুল সংখ্যক মুসলমান এর জ্ঞান, অনুভব কিংবা ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থেকেও দূরে।
অপরপক্ষে সভ্যতার বিকাশ ও উন্নতির বিপরীতধর্মী উপাদানগুলো বৃহত্তর মুসলিম গণজীবনে লক্ষ্যণীয়। বিশেষত অনৈতিকতা, দুর্নীতি, চিন্তার অধঃপতন, ব্যবস্থাপনা ও আইনের প্রতি অব্যাহত উদাসীনতা, কেন্দ্রচ্যুতি ও প্রান্তিকতা এবং বেপরোয়া মনোভাবের ব্যাপকতা যেন মুসলিম বিশ্বকে অন্তসারশূন্য করার উপক্রম করেছে। এর পাশাপাশি ইসলাম সম্পর্কে কোনো কোনো মহলে রয়েছে উদ্ভট চিন্তা, লাগামহীন বক্তব্য, নিষিদ্ধ বাড়াবাড়ি এবং প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গীর চর্চা। ইসলামে জ্ঞানার্জন অপরিহার্য হলেও মুসলমানদের জ্ঞানের আকাশে রয়েছে পুঞ্জীভূত মেঘমালা। অজ্ঞতার অন্ধকারে বেড়ে উঠছে বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধি জনগোষ্ঠী, সমাজ বিনির্মাণে কাম্য ভূমিকা রাখতে যারা অসমর্থ। জাতিগতভাবে সবচেয়ে বেশি অশিক্ষিতের হার মুসলিমদের মধ্যে। মুসলিম জাহানে ২০ থেকে ৩০ ভাগ লোকের শিক্ষা নেই। যে শিক্ষা প্রচলিত, তাও মানসম্মত নয়। বৈশ্বিক বিচারে একান্ত অনুন্নত। অন্যদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠী চিন্তা-চেতনায় বহুধাবিভক্ত। রাজনৈতিকভাবে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংঘাতমুখর। ছোটখাটো ধর্মীয় বিষয়ে অনৈক্য ও বিভেদ মুসলমানদের সব ইতিবাচকতাকে যেন ঠুঁটি চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করতে চায়।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন ছিল স্বতন্ত্র আত্মপরিচিতির স্ফুরণ ও স্বকীয় চেতনায় জারিত গতিশীল নেতৃত্ব। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব বলতে গেলে মেরুদণ্ডহীন। পরাশক্তির পাপেট হিসেবে তাদের অধিকাংশই পরিচিত। বেশিরভাগই গণশত্রু ও চরিত্রহীন। ধর্মীয় নেতৃত্ব সংকট ও বিভক্তিকে প্ররোচিত করছেন নানাভাবে। তারা পূর্বসূরিদের মতো সফল নয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ইসলামের প্রতি উদ্বোধিত করতে। তাদের কারও কারও পোশাক-আশাকের আবরণ ভেদ করে যে বাস্তব জীবনাচার প্রতিফলিত হয়, তাকে যদি সত্যিকার ইসলাম মানা হয়, তাহলে কেউ ইসলাম গ্রহণ করতে চাইবে না।
সামগ্রিক অর্থে মুসলিম বিশ্ব অনুন্নত, অনগ্রসর-উন্নয়নশীল বিশ্বরূপে বিবেচিত। দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আছে ওপরের দিকে। বিশ্বায়নের প্রবল স্রোতের মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতিও একেবারে গৌণ। কোনো কোনো মুসলিম দেশ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তেল ভান্ডারের অধিকারী হলেও সম্পদের সদ্ব্যবহার ও এর দ্বারা পরিকল্পিতভাবে টেকসই উন্নয়নের কর্মসূচি থেকে তারা বঞ্চিত। অথচ সম্পদের সদ্ব্যবহারে বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে উচ্চকিত করা যেত এবং সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে গন্তব্যে উপনীত করা যেত। কিন্তু তা হবে তো দূরে থাক, মুসলিম বিশ্ব ব্যাপকভাবে নিজেদের সত্তানুভূতি থেকেই বঞ্চিত। নিজেদের আত্মপরিচয়ের প্রেক্ষাপটে আত্মবিকাশের কর্মসূচি অবলম্বনের অনুভূতিও তাদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য।
অথচ ইসলাম তাদের দিয়েছিল এমন এক সম্মিলিত ব্যবস্থা, যা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফলাফল অর্জনে অধিক থেকে অধিকতর সাহায্য করবে। এ জন্য দিয়েছিল সহায়ক চারিত্রিক নীতিমালা এবং জ্ঞান শিক্ষা ও সংগঠনের পথনির্দেশ। ইসলাম তাদের দিয়েছিল স্বতন্ত্র সত্ত্বানুভূতি, স্বতন্ত্র সভ্যতা সৃষ্টির বুনিয়াদি শক্তি এবং এর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সৃজনশীলতা ও উপাদান। দিয়েছিল এমন সব নিদর্শন, যা প্রাথমিক অর্থে মুসলমানদের এবং ব্যাপক অর্থে সমগ্র মানবজাতির জীবনমান নিরূপণে সমর্থ। দিয়েছিল নিজেদের মিশন ও মেসেজে বিশ্বজনীনতার অভিপ্রকাশ ও মানবকল্যাণে তার ভূমিকার অবশ্যম্ভাবিতা।
ইসলাম তাদের শুধু নিজেদের বস্তু-অবস্তুগত সম্পদ নয়, বরং গোটা মানববিশ্ব এমনকি প্রকৃতিজগতেও ইনসাফ ও ইহসানভিত্তিক সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বলেছে। সে জন্য তাদের অভিহিত করা হয়েছে বিশ্বজাহানে আল্লাহর খলিফা হিসেবে এবং বলা হয়েছে, তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের পাঠানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। কিন্তু ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্নতার ফলশ্রুতিতে মুসলমান আজ বিশ্বজগতে কল্যাণ নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির সুবাতাস প্রবাহিত করবে তো দূরে থাক, নিজের জন্যই খুঁজে পাচ্ছে না নিঃশ্বাসের বিশুদ্ধ বাতাস। অথচ ইসলামের সামগ্রিকতাকে অবলম্বন করলে তারা পেত সবচেয়ে বেশি উন্নত, অগ্রসরমান ও স্বভাবজাত জীবনীশক্তির পরিক্রমা। যে জীবনবোধের দৃষ্টিতে মুসলমানরা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হবে, তা নয়, বরং গোটা পৃথিবী ও প্রাণপরিমণ্ডল নিয়ে আল্লাহর অভিন্ন পরিবারে তারা হবে শৃঙ্খলাবিধায়ক। সময় এখন মুসলমানদের সেই জীবনীসত্যে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানায়, যা জ্ঞান ও চিন্তার দৈন্যদশা এবং আত্মবিস্মৃতির অধঃপাত থেকে উদ্ধারপূর্বক তাদের উপনীত করবে স্বচ্ছ, সুন্দর, ভারসাম্য ও মানবিক মর্যাদাপূর্ণ এক বিশ্বাসের চাতালে, যা মানুষকে দান করে আত্ম আবিষ্কারের গৌরব, তাকে করে তোলে ভালোবাসায় পূর্ণ, জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত এবং নিজের প্রতি, মানবসমষ্টি ও জগৎব্যবস্থার প্রতি ন্যায়বিচারের প্রতিভূ। বিপুল সদস্যসমৃদ্ধ মুসলিম উম্মাহ যদি তাদের জীবনব্যবস্থার সেই সত্যের অনুগামী হয়, তাহলে নিজেরাই শুধু মর্যাদা ও সমৃদ্ধি অর্জন করবে না, বরং বিশ্ববাস্তবতায়ও এক ইতিবাচক রূপান্তর ঘটবে। এ রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় মুসলমানদের অবশ্যই অঞ্চল, সংস্কৃতি ও স্বার্থের বিভাজন সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সম্ভব ঐক্যের অনুভবে সঞ্চালিত হতে হবে।
বিশ্বরাজনীতিতে অবশ্যই মুসলিমদের একটি কেন্দ্রীয় এলায়েন্স থাকবে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থাকবে এবং নিজেদের স্বার্থেই নিজেদের মধ্য থেকে একটি বিকাশমান পরাশক্তি খাড়া করতে হবে। মুসলিম কমন মার্কেটের প্রসঙ্গ ঝুলে আছে বহু দশক ধরে, মুসলিমবিশ্বের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব বহু পুরোনো হলেও অকার্যকর, ওআইসি হয়ে আছে নখদন্তহীন মৃতপ্রায় বাঘ, কাশ্মীর-ফিলিস্তিন কিংবা রোহিঙ্গা গণহত্যার মতো গুরুতর কোনো সংকটেও সমবেত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ মুসলিম জাহান। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় এ জাতীয় ব্যর্থতা দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। যেখানে পারস্পরিক অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে, অন্তত এমন সব ইস্যুতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো বিশ্বমঞ্চে একটি প্রভাবশালী নেতৃত্বের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে পারলে বিশ্ববাস্তবতায় মুসলিম স্বার্থ অন্তত কিছুটা হলেও সুরক্ষিত থাকত। যেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোনো মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই, সেখানে পরিস্থিতি বদলাত। কিন্তু কৌশলগত এমন ঐক্যের আদৌ কোনো লক্ষণ চোখে পড়ে?
সম্প্রতি তুরস্ক, মালেয়েশিয়া ও পাকিস্তান বিশ্বমঞ্চে যৌথভাবে কাজ করার প্রশ্নে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিন্তু এর প্রভাব ও কার্যকরিতা হবে খুবই সীমিত। প্রয়োজন অধিক সংখ্যক মুসলিম রাষ্ট্রের যৌথতা। দুর্বল যখন নিজেকে একার চেষ্টায় বাঁচাতে পারে না, নিজের স্বার্থ ও সুরক্ষা নিজে একা নিশ্চিত করতে পারে না, সেখানে দুর্বলরা অস্তিত্বের ডাকে সাড়া দেয়, ঐক্য রচনা করে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে এর অজস্র নিদর্শন। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো শোষিত হয়েও, লুণ্ঠিত হয়েও, অন্যের চোখরাঙানি ও জবরদস্তির মধ্যে শিকার হয়েও কেন ঐক্যের বোধে চালিত হয় না, সে এক গুরুতর প্রসঙ্গ।
এর গোড়ায় হয়তো আছে নেতৃত্বের আত্মপরিচয় সংকট। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শাসকমহল যে শিক্ষা সংস্কৃতি, মূল্যবোধের অনুশীলন ও চর্চার মধ্য দিয়ে উঠে আসে, সেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ তাদের ইসলামের প্রাণশক্তিতে প্রলুব্ধ করে না, মুসলিমসুলভ দায়বোধে উদ্দীপিত করে না। বড়জোর রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামের ব্যবহারে প্ররোচিত করে। জাতীয় স্বার্থের বদলে আত্মস্বার্থের পাহারাদারিতে উদ্বুদ্ধ করে। ঔপনিবেশিক আমলের কেরানি তৈরির শিক্ষা এবং দেখতে দেশীয়, মনমগজে ইউরোপীয় ধরনের মানুষ গড়ার সংস্কৃতির জোয়াল এখনও বয়ে চলেছে মুসলিম জাহান। চিন্তা ও মূল্যবোধে অন্যের পদানত হীনমন্য শ্রেণির নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাই মুসলিম জাহানে স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে প্রায়।
জনগণও রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ব এবং অসচেতন থেকে গেছে রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা লাভের বহু দশক পরেও। মধ্যপ্রাচ্য তো রাজতন্ত্র ও স্বেচ্ছাতন্ত্রের পাথরচাপায় রুদ্ধবাক, জনগণ কখনও আর্তনাদ করে উঠলে পাথরের ওপর আরও অধিক পাথর চাপানো হয় মাত্র।
এই পরিস্থিতিতে মুসলিম জাহানের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ভযাবহ এক আবর্তে খাবি খাচ্ছে। মুক্তি ও উত্তরণকামী জনতার জন্য এ এক জটিল সংকট। তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে পরিবর্তনের। তাদেরই জীবনের গতিকে ফেরাতে হবে ইসলামের দিকে। সংগ্রাম, সাধনা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সৃজনশীল ও ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব ও কল্যাণী শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ইতিবাচকতার চর্চার মধ্য দিয়ে পরনির্ভরতা থেকে উত্তরণ পেতে হবে। নিজস্ব প্রতিরক্ষা সামর্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। নিজেদের সম্পদকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে আধুনিক জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য সর্বব্যাপী তৎপর হতে হবে। ইসলামের প্রাণপ্রবাহে উজ্জীবিত, আদর্শ ও অগ্রসর মানুষ তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক পরিগঠনে সহায়ক, নৈতিক ও আদর্শিক প্রাণময়তায় উজ্জ্বল, হৃদয়-মন ও দেহের সুষম বিকাশের অনুকূল এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা দিতে হবে। যার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামের জীবনবোধে। মুসলিম উম্মাহর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী সমাজকে ইসলামের মৌল শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও কর্মে নিয়োগ করার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ধনী-দরিদ্র জনগণের মধ্যে পার্থক্য নিরসনের লক্ষ্যে কল্যাণমূলক অর্থব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতিফলিত রূপ দেখাতে হবে জীবনে ও বৃহত্তর সমাজে। একুশ শতকে মুসলিম বিশ্বের বিবিধ অগ্রগামিতাকে সামগ্রিকতায় রূপায়িত করা এবং নতুন মাত্রাদানে এর বিকল্প নেই।
জ্ঞান, চেতনা ও কর্মমুখী বৃহত্তর এক জাগরণ যদি মুসলিম জীবনে তরঙ্গায়িত হয়, তাহলে অবক্ষয়, মৃত্যুময়তা ও হীনতার পরাজয় ত্বরান্বিত হবে। গণজীবন ও রাষ্ট্রিয় চরিত্রে যদি কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তা অবশ্যই মুসলিম বিশ্বকে নতুন প্রাণপ্রবাহ, নতুন উদ্যম এবং জীবনমানের ক্রমোন্নতি এনে দেবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পুঁজিগঠন ও ব্যবস্থাপনায় উন্নততর অবস্থানের সুযোগে বিশ্বায়নের লাভালাভ কারও জন্য আর একচ্ছত্র থাকবে না। মুসলিমণ্ডঅমুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক হবে মর্যাদার; দেয়া-নেয়ার। মুসলিমদের সংকটগুলোর সমাধান হবে ত্বরান্বিত, তাদের রক্ত আর পানির মতো প্রবাহিত হবে না যার-তার হাতে। মুসলিম বিশ্বকে এই প্রক্রিয়ায় গ্রহীতার স্থান থেকে উত্তরণ লাভ করে অর্জন করতে হবে দাতার মর্যাদা। করুণার পাত্র না হয়ে মর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার রাজসড়কে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা জ্বলজ্বল করছে সময়ের দেয়ালিকায়!