দারাসবাড়ি মসজিদ

ড. খোন্দকার আলমগীর

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পুবদিকে বারান্দা সংযুক্ত আয়তাকার এ মসজিদটি সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের আমলে (১৪৭৪-১৪৮১) নির্মিত হয়। পারসি ব্রাউনের মতানুসারে, এটি ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত ঘোষপুর মৌজার (জে.এর. নং ৬) ৪৩ নং দাগে অবস্থিত। কোনার বুরুজগুলো ব্যতিরেকে এটির বহির্ভাগের পরিমাপ ১১র্০-র্০র্ x ৬র্৪-র্২র্ । মসজিদটির পুবদিকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি বৃহৎ দিঘি রয়েছে। মসজিদটির পুবদিকে ভাগীরথী অথবা পাগলা নদী উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে। বারান্দা অংশে বৃহৎ আকারের কয়েকটি স্তম্ভ রয়েছে। বারান্দার পুবদিকে সাতটি প্রবেশ-পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে প্রবেশ-পথ আছে।

মূল প্রার্থনা-কক্ষের পুবদিকে কৌনিক খিলান-যুক্ত সাতটি প্রবেশ-পথ ছিল। মধ্যবর্তী প্রবেশ-পথটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। এ দিকের খিলানগুলোতে পোড়ামাটির বৃক্ষ, পুষ্প ও পত্র-পল্লবের অলঙ্করণ রয়েছে। কেবলা দেওয়ালের মধ্যবর্তী অংশে অর্ধ-বৃত্তাকার কেন্দ্রীয় মিহরাব অবস্থিত। মিহরাবের উপরে বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলান রয়েছে। এ মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবসহ সব মিহরাবই পোড়ামাটির প্রচুর অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। মসজিদের অভ্যন্তরে দুই বাহুতে নয়টি করে আঠারটি গম্বুজ ছিল। মধ্যবর্তী স্থানে তিনটি গম্বুজ ছিল। আবু সাঈদ মোশতাক আহমেদ মনে করেন যে, এখানে একটি টানেল ভল্ট (tunnel vault) ছিল। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উত্তর পাশে একটি ছাউনি-যুক্ত মিম্বর বা canopied pupit (যে স্থানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব শুক্রবারের বক্তৃতা বা খুতবা প্রদান করেন) ছিল বলে অনুমিত হয়। বারান্দার উপর দুই বাহুতে তিনটি করে ছয়টি গুম্বুজ ছিল। মধ্যবর্তী স্থানে গম্বুজের স্থানে গম্বুজের পরিবর্তে সম্ভবত চৌচালা স্থাপিত ছিল। পার্শ্বীয় খিলানের (lateral arches) উপর গম্বুজগুলো স্থাপিত ছিল।

মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোনায় মুক্তভাবে দণ্ডায়মান বৃহদাকার চারটি প্রস্তর-স্তম্ভ রয়েছে। এ স্তম্ভগুলোর উপরে জেনানা গ্যালারি স্থাপিত ছিল। গ্যালারিটির পরিমাপ ২র্৭-র্৫র্ উত্তর-দক্ষিণ x ২র্৮-র্০র্ পূর্ব-পশ্চিম। এই ধরনের স্তম্ভ হজরত পা-ুয়ার আদিনা মসজিদ, হুগলির জাফর খান গাজীর মসজিদ, গৌড়ের গুনমন্ত মসজিদ ও গৌড়ের কদম রসুল ইমারতে দেখা যায়। ভারতবর্ষেও অন্য কোথাও এ ধরনের স্তম্ভ দেখা যায়।

এ মসজিদের গম্বুজগুলোর ভার বহনের জন্য প্রতি বাহুতে চারটি করে দুই বাহুতে মোট অটটি মুক্তভাবে দণ্ডায়মান প্রস্তরস্তম্ভ ছিল। স্তম্ভগুলোর কোনোটি অষ্টভুজাকৃতির আবার কোনোটি বা দ্বাদশ ভুজাকৃতির। কেবলা দেওয়ালের উপরের দিকে দেওয়াল-গাত্রে স্থাপিত খিলানগুলোতে পোড়ামাটির বৃক্ষ, শাখা-প্রশাখা, পুষ্প ও পত্র-পল্লবের নকশা রয়েছে। এ মসজিদের বিভিন্ন স্থানে শিকল-ঘণ্টা ও কলস মোটিফের অলঙ্করণ রয়েছে।

এ মসজিদের পুবদিকে পুকুরের পুব পাড়ে একটি মাদ্রাসা ছিল। এটিই দারাসবাড়ি মাদ্রসা। দারাস অর্থ পাঠদান। এ মাদ্রাসার নাম থেকে মসজিদটির নামকরণ হয়েছে। সীমান্তের ওপারে গৌড়ের ভারতীয় অংশে বেলবাড়ি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ আছে।

এ মসজিদের বিভিন্ন স্থানে পলেস্তারা ও রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কেবলা দেওয়ালের মধ্যবর্তী অংশ বাইরের দিকে উদ্গত। কেবলা দেওয়ালের সর্বত্র উল্লম্ব অফসেট ও খাঁজ (recess) রয়েছে। এ দিকে আনুভূমিক সারিতে অনেক প্যানেল রয়েছে। প্যানেলগুলোর অভ্যন্তরে খাঁজবিশিষ্ট খিলান ও শিকল-ঘণ্টার অলঙ্করণ রয়েছে। খিলানগুলোর দুই দিকে স্তম্ভ রয়েছে।

মিহরাব : মিহরাবগুলো অর্ধবৃত্তাকার এবং এগুলোতে পোড়ামাটির প্রচুর অলঙ্করণ রয়েছে। প্রতিটি মিহরাবের অভ্যন্তরে একসারি প্যানেল রয়েছে। প্যানেলগুলোর অভ্যন্তরে বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলান ও একটি ঝুলন্ত শিকল-ঘণ্টার অলঙ্করণ রয়েছে।

লেখক : প্রত্নতত্ত্ববিদ, আর্ট হিস্টোরিয়ান ও গবেষক