হাদিস বিচারে পশ্চিমা একাডেমিয়ার অবিচার
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হাদিস বিচারে দৃষ্টিভঙ্গি : শুধু হাদিস নয়, ধর্মীয় যে কোনো কর্তৃত্ব বহনকারী গ্রন্থের প্রশ্নে পশ্চিমা সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এসবের উৎস হলো ইহজাগতিক, যা দিয়ে খাড়া করা হয়েছে অতিপ্রাকৃত ধর্মকে। খ্রিষ্টীয় ধর্মগ্রন্থগুলোর রচনা ও সংকলনের ইতিহাস থাকে তাদের সামনে। যার সঙ্গে আছে ইতিহাস রচনার সাদৃশ্য।
ফলে ধর্মের ওপর কর্তৃত্বমূলক গ্রন্থ ঐশী উৎস থেকে জন্ম নেবে, একে সাধারণত তারা বিশ্বাস করতে পারেন না। বরং এমন গ্রন্থকে সম্মিলিত বানোয়াট ব্যাপার হিসেবে দেখাটাই তাদের জন্য স্বস্তিকর। কিন্তু সেই স্বস্তিতে লুকিয়ে থাকে বস্তুনিষ্ঠতার অস্বস্তি। কারণ তাদের এ অবস্থান সাধারণভাবে যা দেখাতে চায়, এর সারকথা হলো, ধর্মীয় উৎসগ্রন্থগুলো প্রায়ই মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার জন্য রচিত হয়। ব্যক্তির বা বংশ ও গোষ্ঠীর কৃতিত্বকে পবিত্রতা দেবার ইচ্ছা থেকে জন্ম নেয় এসব গ্রন্থ। অনেক সময় তা কাজ করে রাজনৈতিক শক্তির অনুকূলে। ফলে এসব গ্রন্থের অনেকটাই রাজনৈতিক শাসকদের জন্য এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত। হাদিস বিচার এ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রবণতার শিকার হয়েছে।
প্রাচীন গ্রন্থের ভাষ্য এবং শৈলীগত সমালোচনার পশ্চিমা ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। যে ধারা ও ধরণে প্রাচীন ইতিহাস বা তত্ত্বীয় গ্রন্থের সমালোচনা হয়, সেই ধারা ও ধরন হাদিস সমালোচনার পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। হাদিসগুলো কীভাবে বানানো হলো, তার হয়ে ওঠার কী কী স্তর আছে, আর কোন পরিপ্রেক্ষিতে তাতে কী কী হস্তক্ষেপ হলো, সেটা যেন দেখানোটাই মুখ্য বিষয়। ধর্মীয় নয়, এমন সূত্র থেকে লিখিত রেকর্ড বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে সামনে এনে হাদিস তৈরির স্তরগুলোর সময় কল্পনা করেন। এর মধ্য দিয়ে ধর্মের ওপর হাদিসের কর্তৃত্বকে সংশয়ে ফেলা হয় এবং হাদিসের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে গোটা শরিয়াকে একটি পাতানো ব্যাপার হিসেবে দেখাবার শর্ত তৈরি হয়।
প্রকৃতি : পশ্চিমা একাডেমিয়ার হাদিস অধ্যয়নের গোড়ার কথা আমরা ইতোপূর্বে বলেছি। কিন্তু সব গবেষক আমাদের সঙ্গে একমত হবেন না। কারণ প্রাচ্যবিদরা কেন হাদিস অধ্যয়ন শুরু করেন, এর ভিন্ন বয়ানও রয়েছে। দাবি করা হয়, পশ্চিমা হাদিস অধ্যয়ন সূচনা ঘটে কোরআনের পরে গৌণ ঐতিহাসিক নথির অনুসন্ধান করতে গিয়ে। সিরাতের গ্রন্থাবলির পাশাপাশি মহানবীর (সা.) সমালোচনামূলক জীবনী-রচনার প্রকল্প তৈরির জন্য হাদিসের দরকার ছিল। এর পাশাপাশি জানার দরকার ছিল প্রাথমিক মুসলিম সম্প্রদায়ের ইতিহাস। ইসলামের প্রাথমিক যুগের অধ্যয়নে হাদিস ছিল মুখ্য এক উপাদান। এর বোঝাপড়া করার জন্য তারা অবলম্বন করলেন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বর্ণনাগুলোর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন তারা, উৎসগুলোকে যাচাই করলেন। প্রতিটি প্রসঙ্গে তারা বুঝতে চেয়েছেন, আসলেই কি এটি ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে, তাহলে কেন ঘটেছিল? কিংবা ঘটনার সঙ্গে বর্ণনার মিল কি রয়েছে আদৌ? একটি হাদিসকে নবীর থেকে আলাদা করে পরবর্তীকালের সৃষ্টি হিসেবে দেখানোর ক্ষেত্রে তারা ইউরোপে বিশেষ পরিস্থিতিতে জন্ম নেওয়া ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
এ পদ্ধতির জনক হলেন লরেঞ্জো ভাল্লা (১৪০৭-১৪৫৭)। মধ্যযুগীয় গির্জার বৈরাগ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল তার আন্দোলন। ইতালির রাজনৈতিক বিভক্তির জন্য তিনি প্রধান দায়ী করেন পোপকে। গির্জা দাবি করত রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন (৩০৬-৩৩৭) পোপ সিলভেস্টারকে দিয়েছিলেন সাম্রাজ্যের সমগ্র পশ্চিম অংশের ক্ষমতা। এ জন্য একটা সনদ দেখানো হতো। লরেঞ্জো ভাল্লা দেখান এই সনদ মিথ্যা এবং পোপের অফিসে এটি তৈরি করা হয়। একে জালিয়াতি হিসেবে দেখানোর জন্য ঐতিহাসিক সমালোচনা প্রক্রিয়া প্রবর্তন করেন তিনি।
তার বিশ্লেষণের ধরন ছিল এমন যে- ১. সম্রাট কনস্টান্টাইন কেন নিজের অর্ধেক সম্পদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন? ২. গির্জা যে দানের কথা বলছে, তার প্রমাণ এই সনদ ছাড়া অন্য কোথাও নেই। ৩. সেকালের প্রচলিত ধ্রুপদ ল্যাটিন ভাষায় চিঠিটি লেখা হয়নি। এর ভাষাই বলে দেয়, এটি পরবর্তীকালের বানানো। ১৮ শতকের শেষ দিকে জার্মান অধ্যাপকরা প্রাচীন বিষয়ের উৎস অধ্যয়নে এ পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগান। হোমারের কাব্য, রোমান ঐতিহাসিক টাইটাস লিবিয়াসের গ্রন্থ ইত্যাদি এ পদ্ধতিতে বিশ্লেষিত হয়। বি.জি. নিবুহর (১৭৭৬-১৮৩১) দেখান টাইটাস লিভিয়াস লোককাহিনির ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস লেখেন। কারণ অতীত সম্পর্কে বলা সাক্ষীদের পূর্ব মূল্যায়ন ছাড়া ঐতিহাসিক বর্ণনা অসম্ভব। লোকেরা নিজেদের বিচারে সঠিক মনে করে যা-ই বর্ণনা করছিল, তাকে ইতিহাস হিসেবে ধরে নেওয়া ছাড়া টাইটাসের বিকল্প ছিল না।
লিওপোল্ড রাঙ্কের (১৭৯৫-১৮৮৬) কাজগুলোতে এ পদ্ধতি আর বিকশিত হয় এবং দ্য র্যাঙ্ক মেথড প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মেথড অতীতের দলিল বিশ্লেষণে সমসাময়িক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে, তারপর পরীক্ষা চালায়। এ মেথড প্রতিটি উৎসের উৎস, উৎসের লেখকের দক্ষতা, এতে আস্থার মাত্রা খুঁজে বের করে এবং তারপর অতীতের একটি সত্যচিত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহৃত উৎসগুলোর মধ্যে তুলনা করে। র্যাঙ্কের পদ্ধতি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। তাকেই অনেকে ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতির আসল উদ্ভাবক মনে করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলতেন, কোনো উৎস সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে হয় সন্দেহের কারণে। আগ্রহের মূল্য তৈরি হয় সন্দেহের প্রভাবে। সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই করে সেই সন্দেহ দূর করতে হবে। যাচাইয়ের মাধ্যমে হয় সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে, নতুবা নয়। সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মাপকাঠি হিসেবে, তিনি দুটি ধারণা দেন।
প্রথমত, চেতনার ঐক্য বা অনৈক্যের ধারণা। চেতনার ঐক্য বলতে বুঝানো হয়, যে রচনার ওপর পরীক্ষা হবে, তার লেখকের চিন্তার যৌক্তিক সামঞ্জস্য, লক্ষ্যের একতা এবং উৎসে ও পরিণতিতে এর যৌক্তিক পূর্ণতা। এর পাশাপাশি সেই লেখকের বেশ কয়েকটি রচনায় দেখা হবে সৃজনশীলতার অভিন্ন বা খুব অনুরূপ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে কি-না? বিচার ও পরীক্ষায় যদি উৎস বা এর অংশগুলোর পরস্পরবিরোধী উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়, অর্থাৎ এতে অনৈক্য দেখা যায়, তাহলে এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ যথার্থ বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয়ত, যে দলিলের যাচাই হবে, তা যে সময়ে তৈরি ও যে জায়গায় তৈরি, সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে তার সঙ্গতিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এক্ষেত্রে লিখিত-অলিখিত উপকরণগুলোর আশ্রয় নিয়ে সেগুলোর সঙ্গে বিচারাধীন দলিলের তুলনামূলক অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
S. Lappo-Danilevsky দেখান, মিথ্যার মানদণ্ড উৎসের অপ্রমাণিততার মানদণ্ডের চেয়ে আরও জটিল। যে দলিলটির বিচার করা হবে, তাকে জাল সাব্যস্ত করার জন্য ঐতিহাসিককে অবশ্যই বিশেষভাবে জালিয়াতির সংকলকের পরিচয় দিতে হবে। কোন উদ্দেশ্যে তিনি জালিয়াতি করলেন, সেই উদ্দেশ্যগুলোকে স্পষ্ট করতে হবে এবং এমন সব কারণ হাজির করতে হবে, যা দিয়ে দাবি করা যায়, এই জালিয়াতির পেছনে মন্দ মতলব রয়েছে, যা পূরণ করার জন্য নকল দলিলকে আসল বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি দেখান এই সব মন্দ মতলব মূলত ব্যক্তিগত লাভ, সম্পদের আকাঙ্ক্ষা, খ্যাতি, বংশগত সম্মান-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি। কিন্তু জাল করা সব সময় একেবারে ভিত্তিহীন হয় না। অনেক সময় এমন দলিলও থাকে, যা আংশিক সঠিক, আংশিক জাল।
লরেঞ্জো ভাল্লা থেকে নিয়ে এস লাপ্পো অবধি গির্জার দাবির প্রতি অনাস্থাবাদী চিন্তকদের এই তত্ত্বগুলো পশ্চিমা একাডেমিয়াকে ঐতিহাসিক দলিল বিচারের যে দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করে, বলতে গেলে তা জালিয়াতের সন্দেহের ভিত্তিতে জালিয়াত সাব্যস্থ করার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় একটি দলিলের সাধারণ চেহারার কৃত্রিমতা তালাশ করে তাকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়, দলিলটির অত্যধিক সংরক্ষণ কিংবা লোকসমাজে একে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে বিশ্লেষণ করে সেখানে মন্দ উদ্দেশ্য তালাশ করা হয়।
ঐতিহাসিক বিষয়ের সত্যতা উদ্ঘাটনে পশ্চিমা এ প্রক্রিয়া দিন শেষে গবেষকের অনুমান ও লক্ষণগুলোর পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। সত্য সন্ধানের প্রক্রিয়া হিসেবে যা নিতান্তই দুর্বল। কিন্তু হাদিস যাচাইয়ের যে বিজ্ঞান ইসলামে প্রতিষ্ঠিত, তা লক্ষণগুলোর বিশ্লেষণ তো করেই, বরং যাচাই ও পরীক্ষার আরও বহু ধাপ অতিক্রম করেই হাদিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। সেসব যাচাই বহু শতকের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় চলে আসছে এবং এর বৈজ্ঞানিক কাঠামোও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পশ্চিমা একাডেমিয়া প্রধানত হাদিসকে নকল নথি হিসেবে ভেবেছে এবং কোন উপায়ে একে খারাপ মতলবের ফসল হিসেবে দেখানো যায়, সেই উপায় অনুসন্ধান করেছে।
পশ্চিমা হাদিস অধ্যয়নে নবযুগ : ১৮৪০ থেকে ১৮৮৯ সাল অবধি প্রাচ্যবিদদের হাদিস অধ্যয়ন একটি গতিশীল ধারা হয়ে উঠলেও ১৮৯০ থেকে নতুন এক যুগের সূচনা হয়। ১৯৫০ এ তাতে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা ও ভাষ্য। তৈরি হয় বিস্তৃত ও প্রভাবশালী স্রোত, যা আজ অবধি চলমান। পশ্চিমা একাডেমিয়া ১৮৯০ পরবর্তী সময়টিকে স্বাধীন অধ্যয়নের কাল হিসেবে দেখাতে চেয়েছে। দাবি করা হয়েছে যে, এ সময়ে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি পা-িত্যপূর্ণ এক স্বাধীন শৃঙ্খলা পরিপক্বতা লাভ করে।
নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ইগনাজ গোল্ডজিহারের গ্রন্থ Muhammedanische Studien (Muslim Studies) প্রকাশের মাধ্যমে। এ যুগের সমাপ্তি ঘটে ১৯৫০ সালে জোসেফ শাখতের দ্য অরিজিনস অব মুহামেডান জুরিসপ্রুডেন্সের মাধ্যমে। প্রাচ্যবাদের কাছে উভয় বই ম্যাগনাম ওপাস। এ দুই গ্রন্থ পশ্চিমা একাডেমিয়ায় হাদিস অধ্যয়নকে নতুন উজ্জীবন দেয়। ১৯৫০ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলমান কালপর্বে জেমস রবসনের কাজগুলো শ্রদ্ধা পাচ্ছে। গোল্ডজিহার-শাখতের উত্তরাধিকারকে অবলম্বন করে তিনি নতুন মাত্রা যোজনার চেষ্টা করছেন। আধুনিক এই ধারা কোমল ও সশ্রদ্ধ ভাষা প্রয়োগে হাদিসপ্রশ্নে সংশয়বিস্তার করে। গড়পড়তা সবকিছুকে অস্বীকার করে না। কিন্তু অস্বীকৃতিটাই তার লক্ষ্য ও প্রধান অভিমুখ!