আল্লাহ সব দেখেন : আখেরাতের চিন্তা নিজের মধ্যে সর্বদা ক্রিয়াশীল রাখার উত্তম পদ্ধতি হলো, মনে মনে এ কথা কল্পনা করা- আল্লাহ আমাকে দেখছেন। তিনি আমদের সব কর্ম সম্পর্কে সম্মক অবগত আছেন। তাঁর অলক্ষ্যে আমরা কোনো কর্ম সম্পাদন করতে পারি না। আল্লাহ নিজেই বলছেন- ‘তবে সে কি জানে না আল্লাহ দেখছেন।’ (সুরা আলাক : ১৪)। এ অনুভূতি সদা জাগ্রত রেখে ঈমান হেফাজত করা। আমলে সালেহা তথা নেক আমলের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। মন্দ পরিণতির ভয় এবং এর থেকে বাঁচার পাথেয় সংগ্রহ করা। সারকথা- আখেরাতমুখী চিন্তা-ফিকিরে লিপ্ত থাকা।
তাকওয়া অর্জন : তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। তাকওয়া অর্জনকারী ব্যক্তির অন্তর- আখেরাতের ফিকিরে পেরেশান থাকে। এই জন্য আল্লাহতায়ালা আখেরাতের সফরের পাথেয় হিসেবে তাকওয়া হাসিলের নির্দেশ দিয়েছেন। ‘নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহর ভয়।’ (সুরা বাকারা : ৯৭)। তাকওয়া হলো আল্লাহকে ভয় করা। তাঁর নির্দেশিত পথে চলা। অল্পে তুষ্ট থাকা এবং পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যার অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই, সে গুনাহের প্রতি ধাবিত হয়ে পড়ে। যে অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় থাকবে, সে আখেরাতের ফিকির ও প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যতিব্যস্ত থাকবে।
মৃত্যুর স্মরণ : অধিক পরিমাণে মৃত্যুর স্মরণ- আখেরাতের ফিকির তৈরির জন্য সহায়ক। মৃত্যু দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তি। তারপর আখেরাতের ‘মনজিল’ শুরু হয়ে যায়। এই জন্য রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- স্বাদ বিনষ্টকারী বস্তু অর্থাৎ মৃত্যুকে বেশি বেশি স্বরণ কর। (তিরমিজি : ২৩০৭)।
রাসুল (সা.)-এর এ কথা বলার অর্থ হলো, আমরা যেন ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার স্বাদ ও শাহওয়াত থেকে নিবৃত্ত থাকি। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখি এবং মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ জন্য অনেক আল্লাহওয়ালাদের উপদেশবাণী- নসিহতের জন্য ‘মৃত্যু’-এর স্মরণই যথেষ্ট। যেমন আল্লাহতায়ালা বড় বড় জালেমদের এমন মৃত্যু দিয়েছেন; যা অন্যদের জন্য শিক্ষণীয়।
কবর জিয়ারত : আখেরাতের চিন্তা তৈরির ক্ষেত্রে কবর জিয়ারত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, কবরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের কবর থেকে উপদেশ গ্রহণ করার জন্য, যাতে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয়। অন্তর নরম হয়। আখেরাতের ফিকির তৈরি হয়। মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। নবী করিম (সা.) বলেন- ‘আমি তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন (থেকে) তোমরা কবর জিয়ারত করবে। কেননা এটা অন্তর নরম করে দেয়। ভয়ে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। আখেরাতের কথা স্মরণ হবে। সেখানে তোমরা অনর্থক কথাবার্তা বলো না।
এই হাদিসের প্রেক্ষাপটে উমর (রা.)-এর অবস্থা ফিকির করলে দেখা যায়- তিনি যখন কোনো কবরের পাশ দিয়ে যেতেন তখন এত কাঁদতেন, দাড়ি ভিজে যেত। এর কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা হয়, ‘আচ্ছা আপনি বেহেশত-দোজখের কথা শুনলে তো এত কাঁদেন না?’ উত্তরে উমর (রা.) বলেন- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আখেরাতের মনজিলগুলোর মধ্যে কবর হচ্ছে প্রথম ঘাঁটি। কেউ কবরের আজাব থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে, পরবর্তী স্তরগুলো তার সহজ হয়ে যাবে। আর যদি কবর থেকে মুক্তি পাওয়া না যায়, পরবর্তী ধাপগুলো পার হওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে।
হজরত উসমান (রা.) বলেছেন- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ভীতসন্ত্রস্ত ও কঠিন হওয়ার দিক থেকে কবরের মতো অন্য কোনো দৃশ্য দেখিনি।’ কবর ও কবরস্থান এক ভয়ানক জায়গা। ওখানে কত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীকে পাওয়া যাবে, যাদের সঙ্গে জীবনের কত সময় অতিবাহিত হয়েছে। কত স্মৃতি তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওই দৃশ্যদগুলো স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠবে। তাদের মতো আমাকেও একদিন এ মাটির নিচে শায়িত হতে হবে। কবর জিয়ারতকারী আখেরাতের চিন্তায় বিভোর হবে।
কবরের আজাব : মৃত্যুর পরের মানজিলগুলোতে আমার অবস্থা কী হবে? মনে মনে কল্পনা করা। নিরবে-নির্জনে গভীরভাবে চিন্তা করা। সে কঠিন ঘাঁটিতে কী অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে তা নির্ভরযোগ্য কিতাব পড়ে অথবা বিজ্ঞ আলেমদের বর্ণনা থেকে ভালোভাবে জেনে নেয়া। এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে আখেরাতের কথা অধিক স্মরণে আসবে। মৃত্যু যন্ত্রণা, কবরের প্রথম রাত কীভাবে কাটাব? কবরের আজাব কীভাবে সহ্য করব? হাশর মাঠের ভয়াবহ অবস্থা। ইয়া নাফসি! ইয়া নাফসি! বলার মুহূর্ত। নেক ও বদ আমলের হিসাব। পুলসিরাত! দোজখের লেলিহান শিখা। দুনিয়ার আগুনের চেয়ে ৩৬ গুণ শক্তিশালী! আহ, সেদিন কী ভয়াবহ হবে? পিপাসাকাতর জাহান্নামিদের পানীয় হিসেবে গলিত পুুঁজ পারিবেশন। পরকালের শাস্তির সম্মুখীন হলে বরদাশত করার কথা অন্তরে চিন্তা করা। নিঃসন্দেহে এ ধরনের কল্পনা-জল্পনা দ্বারা প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে আখেরাতের ফিকির তৈরি হবে।
পরকাল চীরস্থায়ী : আখেরাতের ফিকির সক্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও শোভা সৌন্দর্য। ক্ষণস্থায়ী জীবনের ভালোবাসায় মত্ত হয়ে দুনিয়া তালাশে লেগে যাওয়া। স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা এটাই যার মাঝে দুনিয়াবী ব্যস্ততা যত বেশি, তার মাঝে দ্বীনদারী তত কম। আর যার দুনিয়া যত সংকীর্ণ, তার দ্বীনদারী তত বেশি। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, যারা দ্বীনের থেকে দুনিয়াকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, দুনিয়া তাদের আখেরাত ভুলিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়টি আল্লাহ কোরআনে এভাবে বলেছেন- ‘বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী।’ (সুরা আ’লা : ১৬-১৭)।
আমাদের আমলের বিষয়ে আশ্চর্য হতে হয় যে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া এবং এর ভোগ-বিলাসকে চিরস্থায়ী সুখণ্ডশান্তি থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে দিয়েছি। অথচ আল্লাহতায়ালার কাছে এ দুনিয়া মাছির পাখার সমমূল্যও নয়। হজরত সাহাল বিন সাদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘দুনিয়ার মূল্য যদি আল্লাহর কাছে মশার ডানা সমতুল্য হতো তাহলে আল্লাহ একজন অবিশ্বাসী কাফেরকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না।’ (জামে তিরমিজি : ২৩২০)।
আত্মশুদ্ধি অর্জন : পরকালের চিন্তা ও প্রস্তুতির মাঝে বড় একটি প্রতিবন্ধক অন্তর পাথর হয়ে যাওয়া। কুফর ও পাপাচারে নিমজ্জিত থাকা। তাছাড়া অন্তরের কঠোরতা- ইবরত হাসিলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। ওয়াজিবাত ছেড়ে দিয়ে অন্যায় কাজের প্রতি ধাবিত হতে মন চাইবে। আল্লাহর ওই সমস্ত বান্দাই সফল ও কামিয়াব হবে, যারা নিজের অন্তরকে মন্দ চরিত্র ও শিরক থেকে পবিত্র করবে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয়।’ (সুরা আ’লা : ১৪)।
দুনিয়া মুসাফিরখানা : বাস্তবতা এটাই, দুনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকেই আখেরাতের মুসাফির। এ স্বতঃসিদ্ধ কথাটা যাদের বুঝে আসছে, সে দুনিয়াতে নিজেকে মুসাফিরই মনে করে। দুনিয়াতে কেউ সফরে বের হলে সামানা গুছিয়ে রাখে এবং প্রস্তুত থাকে বের হওয়ার জন্য। আখেরাতের বুদ্ধিমান পথিক সেই যে নিজের ঈমান কর্মণ্ডবিশ্বাসে প্রস্তুতি নিতে থাকে। কখন না জানি মৃত্যু চলে আসে। পরকালীন চিন্তা-ভাবনা থেকে রাসুল (সা.)-এর এ হাদিস- ‘দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো, যেন একজন অপরিচিত ব্যক্তি বা মুসাফির এবং নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য করো।’ (তিরমিজি : ২৩৩৩)।
যাহেদ বলেন, ‘ইবনে উমর (রা.) আমাকে লক্ষ করে বললেন- তুমি সকালে উঠে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভরসা রেখ না এবং সন্ধ্যায় পরের দিনের সকালের ভরসা কর না। অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থ থাকা এবং মৃত্যুর আগে জীবিত থাকা অবস্থায় পরকালের জন্য কিছু করে নাও। হে আল্লাহর বান্দা! জানা নেই আগামীকাল তোমার নাম কী হবে?
কোরআন তেলাওয়াত : কোরআন চিন্তা-ফিকির করে তেলাওয়াত করার দ্বারা নিজের মধ্যে পরকাল ভাবনা জাগ্রত হয়। আল্লাহর কোরআন হেদায়াত লাভের প্রথম উৎস। দুনিয়া-আখেরাতে সফলতা অর্জনের মাধ্যম। কোরআন বুঝে বুঝে পড়ার দ্বারা প্রথমত ঈমান বৃদ্ধি পায়, নেক আমলের আগ্রহ জন্মে। দ্বিতীয়ত আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত হয়। এ তিন জিনিসের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকার ফিকির গভীর হয়। মুমিন বান্দা যখন ঈমান ও আমলের প্রতিদান জান্নাত লাভের সুসংবাদের কথা কোরআন থেকে জানতে পারে তখন তার মধ্যে জান্নাতের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। যখন আল্লাহর শাস্তি, দোজখ ও পাপিষ্ঠদের অবস্থার কথা শুনে তখন দোজখের ভয়াবহ আজাব থেকে বাঁচার চিন্তায় ব্যকুল হয়ে ওঠে। এ জন্য বুঝে বুঝে যতদূর সম্ভব কোরআন তেলাওয়াত করার চেষ্টা করা। অর্থ বুঝে না পড়ার কারণে যেন দেখে দেখে পড়া ছেড়ে দেওয়া না হয়। কোরআন অর্থ বুঝে পড়লেও সাওয়াব, না বুঝে পড়লেও সওয়াব রয়েছে।
সুন্নতের পাবন্দ : সবসময় এ কথা স্মরণ রাখা চাই যে, আমি একজন মুসলিম। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। আর সে ইবাদতও হতে হবে নবীজি (সা.)-এর নির্দেশিত তরিকায়। মৃত্যু অবধি কোরআন ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী চলার নির্দেশ আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- ‘পালনকর্তার ইবাদত করুন, যে পর্যন্ত আপনার কাছে নিশ্চিত কথা না আসে।’ (সুরা হিজর : ৯৯)। অর্থাৎ সারা জীবন আল্লাহর ইবাদতে লেগে থাকা, যতক্ষণ না আল্লাহতায়ালা মৃত্যুর মাধ্যমে নিজের কাছে ডেকে নেবেন। আল্লাহ আমাদের আখেরাতের প্রস্তুতি নেওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : খতিব, মদিনা জামে মসজিদ
রায়পুরা, নরসিংদী