ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হিজরি প্রথম শতকেই ভারতীয় উপমহাদেশে তথা মালাবারে ইসলামের আগমন ঘটে এবং বাংলায় ইসলাম আগমনের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় চট্টগ্রাম অঞ্চল।

বঙ্গেপসাগরের উপকূলীয় জনপদ চট্টগ্রাম। এই উপকূল দক্ষিণে কক্সবাজার ও টেকনাফ পর্যন্ত প্রলম্বিত। ধারণা করা হয় যে, আরব বণিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে যাতাযতের সময় চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে যাত্রাবিরতি করেন। সেই সূত্রে পুরো এলাকা ছিল তাদের অবতরণ ও অবস্থানস্থল। এ সময়টিতেই মিয়ানমার অর্থাৎ আগের বার্মার আরাকান অঞ্চলেও আরব বণিক ও ধর্ম প্রচারকদের পদচারণা ছিল। তবে এই অঞ্চলে কখন ইসলামের আগমন ঘটেছিল তা সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা কঠিন। এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্থান ও মানুষের নাম ইত্যাদিতে আরবির যেমন প্রভাব আছে, তেমনি ফারসির প্রভাবও লক্ষণীয়। তবে অনুমানের ভিত্তি ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায় যে, খ্রিষ্টীয় অষ্টম অথবা নবম শতকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবের মুসলমান বণিকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আর সেই সূত্র ধরে বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে।

এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিমের মতামত প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘খ্রিষ্টীয় অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনাগোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিকরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর আরবি শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের আগে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবি ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। চট্টগ্রামী লোকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা, যেমন- আলকরণ, সুলুকবহর, বাকলিয়া ইত্যাদি এখনও আরবি নাম বহন করে।’

ড. আবদুল করিমের এই বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রাম দিয়েই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। এ কারণে চট্টগ্রামকে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। সেই সুবাদে চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ইসলামাবাদ।

চট্টগ্রামের আরেক নাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’। ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ কথাটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুটি স্থানে বারো আউলিয়ার মাজার দেখতে পাওয়া যায়। এর একটি হলো সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে অবস্থিত পীর বারো আউলিয়ার মাজার। গ্রামের নাম সোনাইছড়ি হলেও সীতাকুণ্ড উপজেলার এ এলাকাটি বারো আউলিয়ার মাজার নামে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আরেকটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে কক্সবাজারগামী আরকান রোডের সঙ্গে লাগোয়া। যেখানে বারো আউলিয়ার মাজার নামে কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে। তবে এখানে বারো আউলিয়ার অন্তর্গত কোনো পীরের মাজার নেই। মূলত স্থান দুটি ছিল বারো আউলিয়ার আস্তানা, খানকা বা অবস্থানস্থল।

ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সুদূর আরব, ইরাক, ইরান বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য সুফি-সাধকরা বাংলার জমিনে আগমন করতেন। তাদের সমগ্র জীবনের সাধনা ও ধ্যানজ্ঞান ছিল ইসলামের প্রচার। তারা সারাদিন গ্রামে গ্রামে দ্বীনের প্রচার করতেন। রাতে এসে সে স্থানে একত্রে বসবাস করতেন। তাদের সাধনা, ত্যাগের বিনিময়েই চট্টগ্রামের গ্রামগঞ্জের মানুষ ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।

তারা এই স্থানেই আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন। ফলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ জায়গাটি বারো আউলিয়ার মাজার, দরগা বা আস্তানা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

ড. গোলাম সাকলায়েন লিখিত ‘বাংলাদেশের সূফী-সাধক’ গ্রন্থের ১২৯-১৩০ পৃষ্ঠায় চট্টগ্রামের ‘বারো আউলিয়ার’ মধ্যে ১০ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন-

১. হজরত সুলতান বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.)

২. হজরত শেখ ফরিদ (রহ.)

৩. হজরত বদর শাহ্? বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহ.)

৪. হজরত কত্তাল পীর (পীর কত্তাল) (রহ.)

৫. হজরত শাহ্? মহসিন আউলিয়া (রহ.)

৬. হজরত শাহ্? পীর (রহ.)

৭. হজরত শাহ্? উমর (রহ.)

৮. হজরত শাহ্? বাদল (রহ.)

৯. হজরত শাহ্? চাঁদ আউলিয়া (রহ.)

১০. হজরত শাহ্? জায়েদ (রহ.)

উল্লেখিত ইসলাম প্রচারকদের সবাই কিন্তু মূল চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের কাজ করেননি। তারা চট্টগ্রামের আশেপাশে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।

চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড়

ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে, হজরত বদর শাহ্? বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর (রহ.) চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত হন। তিনি যখন এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন, তখন চট্টগ্রাম শহর ছিল জনমানবহীন গভীর বনজঙ্গল। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তখন এ এলাকায় জিন-পরীদের বাসস্থান ছিল। হজরত বদর শাহ (রহ.) একটি মাটির চেরাগ হাতে নিয়ে গভীর বন-জঙ্গল দিয়ে একটি পাহাড়ের ওপর উঠলে জিন-পরীরা তাকে বাধা দেয় এবং বলে, তাদের আবাসস্থলে কোনো মানুষের স্থান নেই।

রাতের অন্ধকার নেমে এলে হজরত বদর শাহ (রহ.) জিন-পরীদের কাছে শুধু চেরাগ রাখার স্থানটুকু চাইলে তারা সম্মতি জ্ঞাপন করে। তিনি চেরাগ জ্বেলে দিলে তা থেকে তীব্র ত্যেজ বিকিরণ করতে থাকলে জিন-পরীদের শরীরে প্রকট জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়। এক পর্যায়ে তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় এবং আস্তে আস্তে এখানে মানুষ বসবাস করতে শুরু করে। এভাবেই চেরাগ রাখার পাহাড় চেরাগি পাহাড় নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রতীকী অর্থে এখান থেকে চেরাগ জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিল চট্টগ্রাম এবং সেই থেকে আজ অবধি চট্টগ্রাম আলোকিত হয়ে উঠছে ক্রমাগত। কিংবদন্তি আছে যে, ওই চেরাগটি ছিল অলৌকিক।

বর্তমানে আন্দরকিল্লায় চেরাগির মোড়ে স্থাপিত মনুমেন্টটি ইতিহাসের স্মারক। এই চেরাগ যেন মূল্যবোধের প্রতীক। যে চেরাগ মনুমেন্ট চট্টগ্রামবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের গর্বিত ইতিহাসের কথা। এই চেরাগ জ্বালিয়ে আলোকিত করা হয়েছিল চট্টগ্রাম, দূর করা হয়েছিল তাবৎ অশুভ শক্তিকে। ইতিহাসের সুন্দরতম অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এই চেরাগের আলো ধরে। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও মাজার। এই চট্টগ্রামের মাটি জন্ম দিয়েছে হাজারো আউলিয়া। যে ধারাবাহিকতা এখনও চলমান।