শর্শদি মসজিদ, ফেনি (১৬শ শতাব্দী)
ড. খোন্দকার আলমগীর
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাধারণ বর্ণনা : ছয় গম্বুজের আয়তাকার এই মসজিদটি ফেনী (পূর্বের নোয়াখালী) জেলার ফেনী উপজেলার ১ নং শর্শদি ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত উত্তর শর্শদি গ্রামের উত্তর খানে বাড়ি মৌজার সি. এস. ৯৩৫ নং দাগে অবস্থিত। এটি কুমিল্লা-ফেনী মহাসড়কের পার্শ্বস্থ মোহাম্মদ আলী বাজারের পশ্চিমে তাকিয়া দিঘির পাড়ে অবস্থিত। মোহাম্মদ আলী বাজার কুমিল্লা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার ও ফেনী শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মসজিদের উত্তর-পুব দিকে অবস্থিত দিঘিটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। মসজিদটির বহির্ভাগের পরিমাপ ১০.২৯ মি. উত্তর-দক্ষিণ x ৭.৭৭ মি. পূর্ব-পশ্চিম এবং অভ্যন্তর-ভাগের পরিমাপ ৭.৫৫ মি. উত্তর-দক্ষিণ x ৪.৯৬ মি. পূর্ব-পশ্চিম। মসজিদে পুব দিকে তিনটি প্রবেশ-পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণে দুটি করে প্রবেশ-পথ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মুক্তভাবে দণ্ডায়মান অষ্টভুজাকৃতির দুটি প্রস্তর-স্তম্ভের ওপর ছয়টি গম্বুজ স্থাপিত। ১৯৯৬-৯৭ ও ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে সংস্কারের পূর্বে মসজিদটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। তবে কিবলা দেওয়ালটি অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় ছিল।
মসজিদের সম্মুখ-ভাগ (Façade) : প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটির সম্মুখ-ভাগ সম্পূর্ণরূপে পুনর্নির্মাণ করেছে। এ দিকে কৌনিক খিলান-যুক্ত তিনটি প্রবেশ-পথ আছে। মধ্যবর্তী খিলানটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। এ দিকে পোড়ামাটির কিছু নকশা দেখা যায়। এ মসজিদের চার কোনায় কোনো বুরুজ সংযুক্ত নেই। বক্র ছাদ কিনারা বেশ স্পষ্ট।
উত্তর ও দক্ষিণ দিক (বহির্ভাগ) : এই দুই দিক প্রায় একই রকম। দুই দিকেই কৌনিক খিলান-যুক্ত দুটি করে প্রবেশ-পথ রয়েছে। পোড়ামাটির অলঙ্করণও আছে।
কিবলা দেওয়াল (বহির্ভাগ) : কিবলা দেওয়ালের মিহরাব অংশটি পশ্চিম দিকে বর্ধিত। মিহরাব অংশের দুই দিকে উল্লম্ব রিসেস রয়েছে। মসজিদেও চার দেওয়ালের ওপরই বক্র ছাদ কিনারা (curved cornice) রয়েছে।
অভ্যন্তর-ভাগ : পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ মসজিদের অভ্যন্তরে মুক্তভাবে দণ্ডায়মান অষ্টভুজাকৃতির দুটি প্রস্তর-স্তম্ভের ওপর ছয়টি গম্বুজ স্থাপিত আছে। গম্বুজগুলো ক্ষুদ্রাকার ও এগুলোতে কোন ড্রাম (drum) নেই। কিবলা দেওয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অবতল ও দুই দিকের মিহরাব দুটি বদ্ধ বা সমান (blind)। পূর্ব দিকে কৌনিক খিলান-যুক্ত তিনটি প্রবেশ-পথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি করে প্রবেশ-পথ রয়েছে। মসজিদটির দেওয়াল-গাত্রে ছয়টি অর্ধ-স্তম্ভ (pilaster) রয়েছে।
মিহরাব : পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় মিহরাবের দুই দিকে অষ্টভুজাকৃতির দুটি সরু অর্ধ-স্তম্ভ (pilaster) রয়েছে। মিহরাবের ওপর বহুখাঁজবিশিষ্ট একটি কৌনিক খিলান রয়েছে। খিলানের দুই পাশে (spandrel) পোড়ামাটির দুটি পুষ্প রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের সম্পূর্ণ অংশ পোড়ামাটির বিভিন্ন প্রকার অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। দক্ষিণ দিকের বদ্ধ মিহরাবটিও পোড়ামাটির অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। এটির অভ্যন্তরে শিকল-ঘণ্টার অলঙ্করণ ও ওপরে বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলান রয়েছে। এটির দুই দিকে (spandrel) পোড়ামাটির দুটি পুষ্প রয়েছে। সম্পূর্ণ মিহরাব অংশটিই পোড়ামাটির বিভিন্ন প্রকার পত্র-পুষ্প ও জ্যামিতিক নকশায় অলঙ্করণে সমৃদ্ধ। উত্তর দিকের বদ্ধ মিহরাবটি ক্ষুদ্র ও প্রায় অলঙ্করণবিহীন। এটির মধ্যে শিকল-ঘণ্টার একটি অলঙ্করণ ও উপরে বহুখাঁজবিশিষ্ট একটি খিলান রয়েছে।
মসজিদটির গাঁথুনিতে চুনের মশলা ও চুনের পলেস্তারা ব্যবহৃত হয়েছে। এ মসজিদের চার কোনায় কোনো বুরুজ না পাওয়ায় সংস্কার কাজের সময় চার কোণায় কোনো বুরুজ নির্মাণ করা হয়নি। স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে মসজিদটি সুলতানি ও মোগল আমলের অন্তর্বতী কালে নির্মিত বলে ধারণা করা যায়। এই এলাকায় এ মসজিটির অবস্থান গুরুত্ব বহন করে। স্থানীয়ভাবে এটি শের শাহী আমলে নির্মিত বলে প্রচলিত ধারণা রয়েছে। শর্শদি শব্দটি শেরশাহবাদী > শেরশাদী > শর্শদি এভাবে উৎপন্ন হতে পারে। শেরশাহবাদীরা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে সুলতান শেরশাহের সময় (১৫৩৮-১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) এদেশে আগমন করে।
লেখক : প্রত্নতত্ত্ববিদ, আর্ট হিস্টোরিয়ান ও গবেষক