শিক্ষাব্যবস্থার ইসলামায়নের প্রয়োজনীয়তা

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমার নিবেদন হচ্ছে, প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষা বা জেনারেল শিক্ষা ইংরেজ প্রবর্তিত হলেও তা আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারা। এসব প্রতিষ্ঠানেই শতকরা ৯০ জন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে, যারা ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় জীবনে নেতৃত্ব দেবে। কাজেই যারা এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এর প্রতি অনীহা প্রদর্শন করে তারা নিঃসন্দেহে কূপমণ্ডূক। সব সচেতন মুসলমান, আলেম সমাজ ও চিন্তাবিদদের প্রতি অনুরোধ, জেনারেল শিক্ষাকে বিজাতীয় বা ইংরেজ প্রবর্তিত এবং দুনিয়াদারির শিক্ষা বলে অবহেলা না করে কীভাবে একে ইসলামি শিক্ষার ধারায় ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করুন। এই শিক্ষায় ইসলামি শিক্ষা বা ধর্মকর্ম চর্চার যেটুকু সুযোগ আছে তা রক্ষা করাকে দ্বীনি কর্তব্য ও শিক্ষা সংস্কৃতি অঙ্গনের জিহাদ হিসেবে গণ্য করুন।

এক শ্রেণির অতি ধার্মিক আছেন। বলেন যে, আমি কোনো দিন রেডিও শুনি না, টিভি দেখি না, মোবাইলে সিনেমার ছবিতে চোখ পড়লে ফিরিয়ে নেই। ভালো কথা। প্রশ্ন হলো, আপনার ছেলেমেয়ে উঠতি বয়সের আপনজনরা এসবের প্রতি আসক্ত কি-না তার কি খোঁজ নিয়েছেন? আপনি এসব দেখলে গোমরাহ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তাতে আপনার কাছের তরুণরা কীসের ছোবলে পড়ে রসাতলে যাচ্ছে, তা জানতে পারতেন। এর প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পেতেন।

বর্তমানে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক বানানোর যে মহড়া শুরু হয়েছে, পৌত্তলিক, মূর্তি-মন্দিরের ছবি দিয়ে পাঠ্যবই ভরে দিচ্ছে, তার অন্যতম কারণ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির প্রতি তথাকথিত ধার্মিকদের অবহেলা এবং নিজে সুফি সেজে সমাজকে গোল্লায় দেয়ার প্রবণতা। পক্ষান্তরে আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার চেতনা ধ্বংস করার কুশিলবদের ঘুম নাই। তারা কৌশলে জাতীয় শিক্ষায় স্কুলের নবমণ্ডদশম শ্রেণিতে এবং সমাপনী পাবলিক পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা ও পরীক্ষার যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা তুলে দিয়েছেন। এ অবস্থায়ও আমাদের তথাকথিত ধার্মিকদের ঘুম ভাঙছে না। টঙ্গীতে এত বড় ইজতেমা হলো, কোটি কোটি সওয়াবের কথা আলোচনা হলো, সেখান থেকে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এমন জঘন্য ষড়যন্ত্রের সামান্যটুকু প্রতিবাদ উচ্চারিত হলো না। বাংলাদেশের ধর্মীয় চেতনার দুর্দশাই বলতে হবে।

স্কুল শিক্ষা থেকে ইসলামকে বিদায় দেয়ার ষড়যন্ত্র কেন

আমাদের স্কুল শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে যে তেলেসমাতি সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সম্পর্কে দুটি কথা বলব। আমাদের শতকরা ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে পড়ে স্কুলগুলোতে। বাকি প্রায় দশ ভাগ ছাত্র পড়ে মাদ্রাসায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবে, তারা প্রধানত আসে স্কুল থেকে। স্কুল শিক্ষাই আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারা। এ জন্য যারা জাতিকে বিপথগামী করার ফন্দি-ফিকির নিয়ে থাকে, তারা বারবার স্কুলের সিলেবাসের ওপর হানা দেয়। সর্বশেষ যিনি গোটা জাতিকে নাস্তিক বানানোর শিক্ষানীতি দিয়ে গেছেন তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নাস্তিকদের জীবনভরের লালিত স্বপ্ন নামে ইসলামের আলো নুরুল ইসলাম থাকলেও ইসলামের মূল শিক্ষা ভুলিয়ে দিতে হবে। এ জন্য তাদের টার্গেট শিক্ষাব্যবস্থা। তারা আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় ধ্বংস করার জন্য স্কুলে দুটি অভিযান চালিয়েছেন। এর একটির চেয়ে আরেকটি মারাত্মক। একটি, স্কুলের দশম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা থেকে ১০০ নম্বরের ধর্মপরীক্ষা বাদ দেয়া। দ্বিতীয়টি, নাস্তিক্যবাদী ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার সিলেবাস চালু করা। মাদ্রাসা শিক্ষাও এই আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি।

সরকার বিক্ষুব্ধ জনমতকে শান্ত করার জন্য ভুল স্বীকার করে বলেছে যে, কিছু লোকের অবহেলায় (?) বইগুলোতে কিছু আপত্তিকর ছবি ভুল করে ছাপানো হয়েছে। ত্রুটি এক জায়গা দুই জায়গায় হলে ভুল হয়েছে মর্মে সাফাই মেনে নেয়া যেত। কিন্তু আগাগোড়াই যেখানে ভুলে ভরা, তাকে ইচ্ছাকৃত না বলে উপায় নেই। আমি নিশ্চিত যে, নাস্তিকদের এই ষড়যন্ত্র বর্তমান সরকারকেও বিব্রত করবে। ২০১২ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির যে বই ছাপানো হয়েছে, তাতে ভূমিকার শেষ প্যারায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন পুরো ভূমিকার সঙ্গে শেষ প্যারায় প্রধানমন্ত্রীর এ কথার মিল নেই। তার মানে প্রধানমন্ত্রীর চাপে তারা কথাটি সংযোজন করতে বাধ্য হয়েছে। আসলে একটি নাস্তিক প্রজন্ম তৈরির কাজটি নাস্তিক কুশীলবরা আঞ্জাম দিয়েছে। তার দোষ চাপাতে চাচ্ছে বর্তমান সরকারের ওপর। প্রশ্ন হলো, পাবলিক পরীক্ষায় যে ১০০ নম্বর এর ধর্ম পরীক্ষা বাদ দিলেন তা ভুল হয়েছে কিনা এবং সেই ভুল সংশোধন কখন করবেন আর প্রধানমন্ত্রীর চোখে ধুলা দেয়ার কারসাজিটা ছাড়বেন কি-না।

যে কোনো জাতিকে নৈতিক চরিত্র ও বিশ্বাসের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে তাদেরকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চিন্তা চেতনার মানদণ্ডে গড়ে তুলতে হবে। এই যুক্তি ও দর্শন কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। একটি প্রশ্ন করি, স্কুলের ছাত্রদেরকে যে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হলো, তাতে কি সবাই ধর্ম ত্যাগ করবে। করবে না। কারণ ক্ষুধা যেমন মানুষের সহজাত চাহিদা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনাও মানুষের আত্মিক চাহিদা। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের চাহিদা যদি পূরণ করা না হয়, তাহলে মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খাবে। একইভাবে মানব মনের ধর্মীয় চাহিদা যদি সঠিক নিয়মে পূরণ করা না হয়, তাহলে ধর্ম সম্বন্ধে ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়ে বিপথগামী হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব উগ্রবাদী হাঙ্গামা হয়েছে এবং ধর্মীয় স্লোগানে করা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তাতে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যেসব যুবক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল তারা আশপাশের বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণা ও ধর্ম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়ে ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। এসব ঘটনায় লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অভিজাত পরিবারের সন্তানরাই অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার হয়েছে। কোনো ঘটনায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী কেউ জড়িত বলে প্রমাণিত বা অভিযুক্ত হয়নি।

এর কারণ, মাদ্রাসায় ছাত্ররা উস্তাদের কাছে কোরআন-হাদিসের সঠিক দরসটি পেয়েছে। ফলে কারও অপপ্রচারে তারা বিপথগামী হয় না, হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ একটি হাদিসের বাণী নিয়ে চিন্তা করতে বলব। ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে নামাজ ছেড়ে দিল, সে কুফরি করল।’ মাদ্রাসা অঙ্গনে এই হাদিসের তরজমা ও ব্যাখ্যা হলো, সে আল্লাহর নাফরমানি করল কিংবা কাফেরের মতো কাজ করল। কিন্তু যারা উগ্রবাদী তাদের দৃষ্টিতে এই হাদিসের অর্থ হলো, ‘তারা কাফের হয়ে গেল।’ তার মানে দ্বীন থেকে খারিজ, মুরতাদ হয়ে গেল। ব্যাপারটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, একটু চিন্তা করুন। কাজেই স্কুলে বা মাদ্রাসায় যদি আপনি ধর্মীয় শিক্ষার সঠিক বাণী থেকে নতুন প্রজন্মকে বঞ্চিত করেন তাহলে স্বভাবগত ধর্মীয় আকর্ষণের কারণে তারা খারাপদের খপ্পরে পড়বেই। অতএব, সমাজকে উগ্রবাদ থেকে রক্ষার জন্য হলেও স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক রাখতে হবে।

স্কুলে এমন কতক সাব্জেক্ট পড়ানো হয়, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছাত্রদেরকে নিজের পরিবেশ, সমাজ, দেশ ও বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত করানো। যেমন ভূগোল, পৌরনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি। আমার কথা হলো, এর জন্য তো ছাত্রদেরকে নিজ দেশের মানুষ, তাদের বিশ্বাস, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আচরণ, জীবনবোধ, ধর্মকর্ম, বৈধ-অবৈধ কিংবা ভালো লাগা-না লাগার বিষয়াদি সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে হবে। এটিই তো ধর্মীয় শিক্ষা। এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন কোন যুক্তিতে।

কোনো দেশ যখন অন্য দেশে পণ্য বাজারজাত করতে চায় তখন একটি সমীক্ষা চালায়। পণ্যটি জনপ্রিয় করার ও ভোক্তাদের চাহিদা মাফিক পরিবেশনের জন্য তারা বুঝতে চায় এ দেশের মানুষ কোন কোন জিনিস পছন্দ বা অপছন্দ করে। তাদের বিশ্বাস আচরণ কেমন। এসব দিক নিয়ে ফিল্ড স্টাডি করার পরই তারা পণ্য বাজারজাত করে। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছেও বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা সংশ্লিষ্ট দেশের রীতিনীতি, ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা প্রভৃতি সম্পর্কে স্টাডি করে। কাজেই আমাদের দেশের জনগণের ধর্মকর্ম পালনের সঠিক নিয়ম শেখানো, ধর্মীয় চেতনা সম্বন্ধে সঠিক ব্যাখ্যা এবং কোরআন হাদিসের যে কোনো ধরনের অপব্যাখ্যা থেকে নতুন প্রজন্মকে নিরাপদে রাখার জন্য স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। এটা আমাদের দাবি, যুক্তির কথা। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও ছিল তাই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত গুণী ব্যক্তিদের বিষয়টি অনুধাবন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কেউ মনে করবেন না যে, জনগণের মাথার ওপর শিক্ষার নামে ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং ফ্রয়ডের যৌনবাদী মতবাদের আবর্জনা নিক্ষেপ করে জনগণ ও আল্লাহর কাছ থেকে পার পাবেন। আমরা অনতিবিলম্বে স্কুলের ১০ শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ধর্মীয় পরীক্ষা বহাল করার দাবি জানাচ্ছি।