আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও আমরা কয়েকটি বিশেষায়িত সাবজেক্টের জন্য আলাদ ক্যাম্পাসের গুরুত্ব স্বীকার করি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও সেটিই অনুসৃত হচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত সার্টিফিকেট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্যু করা হলেও পড়াশুনার জন্য আলাদা মেডিক্যাল কলেজের প্রচলন রয়েছে। কারণ, সেখানে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি প্রাক্টিসের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। অনুরূপ কৃষি সংক্রান্ত বিষয়াদির জন্য রয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট প্রভৃতি রয়েছে। কারণ, এসব সাবজেক্টের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা, অনুশীলন, পরিবেশ ও যতœআত্তির দরকার রয়েছে। একই যুক্তিতে আমাদের সমাজে ধর্মীয় নেতৃত্ব ও বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা থাকতে হবে। সেখানে কোরআন-হাদিসের পুঁথিগত বিদ্যার একই সাথে শরিয়াহ পরিপালন ও চরিত্র গঠনের আলাদা ব্যবস্থাপনা ও অনুশীলন থাকতে হবে।

মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য থেকে যে নির্দেশনা পাওয়া যায়, তা সামনে রাখলেও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আলাদা রাখার প্রয়োজনীয়তা বুঝা যায়। তখন কেউ এমন কথা বলবে না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ইসলামিক স্টাডিজ, অ্যারাবিক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি; এমনকি আল-হাদিস, আল-কোরআন, আল-ফিকহ শিরোনামে পৃথক পৃথক ডিপার্টমেন্ট রয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি সাধারণত বিশ্বমানের হয়ে থাকে, সেহেতু আলাদাভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা বলবৎ রাখার যুক্তি নেই। এর অন্যতম কারণ হলো, ইসলামে যতখানি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, ঠিক ততখানি এমনকি তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দীক্ষার ওপর। কোরআন মজিদে যেখানে তেলাওয়াত ও তালিমের কথা বলা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বলা হয়েছে তাজকিয়ার কথা। উভয় কাজকে মহানবী (সা.)-কে দুনিায়াতে প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্য বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। (দ্র. সুরা বাকারা : ১২৯; সুরা জুমু’আহ : ২)

এক হাদিসে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘না-আহলকে যে ইলম শিক্ষা দেয় তার উপমা সেই ব্যক্তির মতো যে শূকরের গলায় মণিমুক্তা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের হার পরিয়ে দেয়। (ইবনু মাজা, বায়হাকি)।

হাদিসে না-আহল বলতে কি হিন্দু সমাজে প্রচলিত বর্ণবৈষম্য জাতীয় কোনো শ্রেণিবৈষম্য বা জাতপাত বিচারের কথা বলা হয়েছে? নিশ্চয়ই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা প্রতিটি মানব শিশুর মৌলিক অধিকার। কাউকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন নজির কোথাও নেই। তাহলে হাদিসে বর্ণিত না-আহল বলতে সেই লোকদেরই বুঝায় যারা উপযুক্ত দীক্ষা থেকে বঞ্চিত। যারা নিজের চিন্তা-বিশ্বাস শুদ্ধ করেনি, কোরআন হাদিসের জ্ঞান ধারণ করার চারিত্রিক যোগ্যতা অর্জন করেনি, তারাই ওহির জ্ঞান অর্জন ও ধারণ করার না-আহল, অযোগ্য। একটি ছোট্ট কথায় আসুন, যারা পায়খানা-পেশাবের পর পানি নেয় না, পবিত্র হয় না, পবিত্রতার ধার ধারে না, নামাজ কালাম নেই, তাদেরকে কোরআন হাদিসের মৌলিক জ্ঞান দান এবং ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী করলে ইসলামেরই অবমাননা করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক জ্ঞান আহরণ করে কেউ হয়তো প-িত হতে পারবেন। ইহুদি-খ্রিষ্টান ওরিয়েন্টালিস্টদের মতো স্কলার বনতে পারবেন; কিন্তু তাদেরকে সমাজ আলেম হিসেবে গ্রহণ করবে না। কারণ হলো, আলেম হওয়ার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা আল্লাহর ভয়ে সংযমী জীবনযাপন করে, ‘ইয়াখশাআল্লাহ’। তার মানে ওহিলব্ধ জ্ঞান দানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে খাশয়াতুল্লাহ বা খওফে ইলাহি সৃষ্টি করার ব্যবস্থা ও অনুশীলন থাকতে হবে। যুগ যুগ ধরে এ ধরনের খাশিয়া বা খাওফে ইলাহি সৃষ্টির পটভূমি হচ্ছে মাদ্রাসার শিক্ষাঙ্গন। যারা ভবিষ্যতে দেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই ক্যাডেট কলেজের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে গড়ে তোলা হয়। অনুরূপ যারা আল্লাহর ভাষা কোরআন ও রাসুলের ভাষা হাদিসের ভাষ্যকার হয়ে ভবিষ্যতে সমাজকে ইহ-পরকালের সত্য-সুন্দর কল্যাণ ও সাফল্যের পথ দেখাবে তাদেরকেও ছোটবেলা থেকে দ্বীনি মেজাজ ও চরিত্র নিয়ে তালিমের সাথে তাজকিয়া, শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এখানেই মাদ্রাসা শিক্ষার আলাদা বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। আমার একটি প্রশ্ন হলো, মাদ্রাসায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাসের চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া করানো হয়। এ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের সার্টিফিকেট মাদ্রাসা ছাত্রদের দেয়া হবে না কেন?

শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের আগাগোড়া রক্ষিত ও অনুসৃত হয়েছে। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়নির্ভর পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক ইংরেজরা হলেও তা কর্ডোভা গ্রানাডাকেন্দ্রিক ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুকীর্তি। এ জন্য ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার কোনো কোনো রীতিনীতি তাতে খুঁজে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন প্রথমে ‘হল’-এ ভর্তি হতে হয়েছে। হল থেকে ভর্তির কাগজপত্র নিয়ে জমা দিতে হয়েছে ডিপার্টমেন্টে। তার মানে আমরা মূলত হলের ছাত্র। হল থেকে পড়তে পাঠানো হয়েছিল ডিপার্টমেন্টে। পড়ালেখা তো হয় ডিপার্টমেন্টে। তাহলে হলের ভূমিকা কী? থাকার আসন বা আবাসন? তেমনটি হলে ভর্তি করা হতো ডিপার্টমেন্টে। সেখান থেকে পাঠানো হতো হলে। আসল কথা হলো, ‘হল’-এর ভূমিকা ও গুরুত্ব চারিত্রিক দীক্ষা ও পরিশুদ্ধির আঙিনা হিসেবে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে হল হবে দীক্ষাগার, আর ডিপার্টমেন্ট পাঠশালা। এটিই ইসলাম ও ইসলামি শিক্ষার ঐতিহ্য। ইংরেজরাও তারই অনুকরণ করেছে। যেমন বর্তমান বিচারব্যবস্থাও সাজানো আছে মোগল আমলের দিওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের আদলে।