কোরআন-হাদিসের ইলম অন্বেষণের তৌফিক পাওয়া আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। শুরু থেকে দাওরায়ে হাদিস অব্দি আসা আরও মহা অনুগ্রহ। নিচের জামাতগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কিতাবাদি থাকলেও দাওরাতে সবগুলো কিতাবই হাদিসের। বছরজুড়েই হাদিস পড়ানো হয়। কখনও উস্তাদ নিজে পড়েই তাকরির দেন। আমরা হই নিরব শ্রোতা। কখনও বা ছাত্ররা পড়ে উস্তাদ তাকরির দিয়ে যান। মুগ্ধ হয়ে মন্ত্রের মতো শুনে যাই চাতক পাখির মতো।
বাদ ফজর থেকে হাদিসের দরসে বসি। চলতে থাকে হাদিসের পাঠদান। উস্তাদ কি’বা ছাত্রের কণ্ঠে ক্রমাগত বাজতে থাকে ওয়া বিহি ক্বলা হাদ্দাসানা আর ক্ললা রাসুল (সা.) কি’বা আ’ন রাসুলিল্লাহ আনিনা নাবি। তখন হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আর ভালোবাসায় অকপটে মুখে উচ্চারিত হয় সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নবী প্রেমের অবারিত বৃষ্টিতে সিক্ত হয় হৃদয় জমিন।
বোখারির প্রথম বার ওহির সূচনা। অর্থাৎ প্রিয় নবী (সা.) এর ওপর কীভাবে ওহির সূচনা হয়েছিল। হাদিসের এবারত আর উস্তাদের মুখ নিঃসৃত তাকরির শুনে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় প্রিয় নবি (সা.) এর উপর ওহি নাজিলের সেই আনন্দঘন মুহূর্ত। যখন মানবজাতির সফলতার প্রথম সবক দেওয়া হয়েছিল। এরপর ওহির গুরুদায়িত্ব উপলব্ধি করে রাসুলের ঘাবড়ে যাওয়া। ঘরে এসে আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-কে সম্বোধন করে বলা জাম্মিলূনী জাম্মিলূনী। আর পাহাড়ের পাদদেশে উঠে গোত্রের লোকজনকে একত্ববাদের আহ্বানÑ এসব যেন চোখের সামনে দৃশ্যমান।
হাদিসের কিতাবের একেকটি অধ্যায় পাঠকালে হৃদয়ের অবস্থাও পরিবর্তন হতে থাকে। কিতাবুল ঈমানের হাদিস ও তাকরির শুনে সাহাবিদের ঈমানের সামনে নিজেকে বড়োই অপরাধী মনে হয়। দ্বীনের জন্য তাদের কতো ত্যাগ-সীমাহীন ধৈর্য। স্বদেশ ছেড়ে হিজরত। এক হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) ঈমানের তিনটি স্তর বর্ণনা করেছেনÑ সেখানে তিনি সর্বনি¤œ স্তর নির্ধারণ করেছেন যে, মন্দ কাজ দেখে অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা। অর্থাৎ সেটাকে পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করা। আমাদের অবস্থা তো এই যে, মন্দ কাজের প্রতিবাদের পরিবর্তে নিজেরাই সেখানে লিপ্ত হচ্ছি লাগামহীনভাবে। তাহলে আমাদের ঈমান কোথায়? একটু চিন্তা করুন!
বোখারি ছানী আর আবু দাউদ ছানীতে যুদ্ধ-জিহাদ সংক্রান্ত হাদিসগুলো পড়ে ঈমানের নদীতে জযবার ঢেউ ওঠে। হৃদয়ে জাগ্রত হয় সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর জিহাদি স্পৃহা। নিজেকে খুঁজে পাই যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) মতো বীর পালোয়ানের সঙ্গে সম্মুখ সারিতে। শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে উন্মুখ থাকে মানবাত্মা।
প্রিয় নবি (সা.) এর পুরোটা জীবনই ছিল সাদাসিধা। তিনি ইচ্ছে করলে শাহি হালতে দিনাতিপাত করতে পারতেন। আল্লাহ তাঁকে প্রাচুর্যতা দিতেন। কিন্তু তিনি দৈন্যতার জিন্দেগিই বেছে নিয়েছিলেন। পুরোটা জীবন দুনিয়াবিমুখ থেকেছেন। হজরত আয়েশ (রা.) কোনো এক তাবেই এর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেনÑ মুহাম্মাদ (সা.) এর পরিবার একনাগাড়ে তিন দিন তরকারিসহ গমের রুটি পেট ভরে খাননি। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। দ্বীনের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন সদা হাস্যবদনে।
সবচেয়ে বেশি দুনিয়া বিমুখ ছিলেন সাহাবি আবু জর (রা.)। সম্পদ জমা করে রাখার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। কারণ রাসুল (সা.) এক হাদিসে বলেনÑ সম্পদশালীরা কেয়ামতের দিন সর্বনিম্ন স্তরে উপনীত হবে। কিন্তু যারা নিজেদের মাল এদিক সেদিক (আল্লাহর পথে) খরচ করবে, তারা এর ব্যতিক্রম। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৩০)। সেই হাদিসের ওপর তিনি অটল ছিলেন। কারণ অধিকাংশ মানুষই এক্ষেত্রে ধোঁকায় পড়ে যায়।
কিতাবুল ফিতান। আশরাতুস সাআ’হ। রাসুল (সা.) এর ওফাতের পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত বিভিন্ন ফেতনা সম্পর্কিত হাদিস। যেমন জেনা-ব্যভিচার। মদ্যপান। প্রকাশ্যে মন্দ কাজ। অযোগ্য লোকের বড় বড় পদ পাওয়া। দাজ্জালের আবির্ভাব। ঈমাম মাহদির আগমন ইত্যাদি। এ সক্রান্ত হাদিসগুলো যখন সামনে আসে, তখন আমাদের সমাজের সঙ্গে যেন অক্ষরে অক্ষরে মিল খুঁজে পাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্রিয়নবী (সা.) কথাগুলো সরাসরি আমাদেরকে লক্ষ্য করেই বলে গিয়েছিলেন। আমরাই তার প্রথম সম্বোধিত ব্যক্তি। কারণ এ-সবগুলো কাজ আমাদের সমাজে খুব জোরালোভাবে চলছে।
রাসুল (সা.) উম্মতের ব্যাপারে আরেকটি ফেতনার আশঙ্কা করেছিলেন। শেষ জামানায় উম্মতের মাঝে এমন একটি দল আবির্ভূত হবে, যাদেরকে আরবিতে বলে মুনকিরিনে হাদিস বা হাদিস অস্বীকারকারী। যারা বর্তমানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে মানুষের মাঝে ফেতনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষকে দ্বীন থেকে বিমুখ করার নীলনকশা একে যাচ্ছে দিব্যি। এজন্যই প্রিয় নবি (সা.) উম্মতকে সতর্ক করে গিয়েছেন খুব জোরালোভাবে। একটি হাদিস এখানে পেশ করছি।
রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি হজরত মিক্বদাদ ইবনে মাদীকারিব (রা.) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন : রাসুল (সা.) ইরশাদ করেনÑ সাবধান! খুব শিগগির এমন ব্যক্তির আগমন ঘটবে যে, সে তার সুসজ্জিত গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। তখন তার কাছে আমার কোনো হাদিস পৌঁছলে সে বলবে, আমাদের ও তোমাদের মাঝে তো আল্লাহর কিতাবই আছে। আমরা তাতে যা হালাল পাব সেগুলো হালাল বলে মেনে নেব এবং যেগুলো হারাম পাব, সেগুলো হারাম বলে মেনে নেব। সাবধান! রাসুল (সা.) যা হারাম করেছেন তা আল্লাহতায়ালা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতোই হারাম। (সুনানে তিরমিজি : ২৬৬৪, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)।
রাসুল (সা.) এর বাণীর সত্যতা আজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। একদল লোক উঠেপড়ে লেগেছে হাদিস অস্বীকার করার ব্যাপারে। তাদের কাছে আমার সরল প্রশ্ন! আপনারা যারা হাদিস অস্বীকার করেন; কোরআন কেন নিঃশর্তে মেনে নেন? হাদিস যে পরম্পরায় বা সনদে এসেছে কোরআনও তো সেই সনদেই এসেছে। এখন আবার প্রশ্ন আসতে পারে কোরআন হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিয়েছেন। সে জন্যই কোরআন সংরক্ষিত ও অবিকৃত।
তাহলে আমি বলব, এই যে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা দিলেন কোরআন তিনি হেফাজত করবেন সেই আয়াতটি কি সরাসরি আপনার ওপর আল্লাহ নাজিল করেছেন নাকি এ আয়াতটিও তাদের সূত্রেই এসেছে! তাই হাদিস অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। হাদিস অস্বীকার করা রাসুলকে অস্বীকার করার নামান্তর। দ্বীনকে অস্বীকার করার নামান্তর। আশা করি বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, ময়মনসিংহ