এ মুহূর্তে আমাদের সর্বপ্রধান দাবি হচ্ছে, ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা স্কুলের দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষার বাধ্যবাধকতা বহাল করা। ২০১২ সালের শিক্ষানীতির আওতায় গত বছর এই পরীক্ষা তুলে দেয়ার পর থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত দেশের সর্বস্তরের সব মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় আছেন আর যারা বিএনপি করেন, ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেন, তাদের মধ্যে এমন লোক নেই, যারা ধর্মকর্ম মানে না। ধর্ম প্রতিপালনে কারও দুর্বলতা থাকলেও কেউ চায় না, নিজের ছেলেমেয়ে অসৎ, অধার্মিক, নাস্তিক হয়ে গড়ে উঠুক। মুসলমান মাত্রই চায়, আমার ছেলেমেয়ে অন্তত নামাজ-কালাম শিখুক, পাক-নাপাকির চেতনা লালন করুক, জুমা-ঈদণ্ডজানাজায় শরিক হোক, রোজা, হজ, জাকাত, জিয়ারত প্রভৃতির নিয়মণ্ডকানুন জেনে রাখুক। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সন্তানদের নিজ নিজ ধর্মকর্মের প্রতি অনুরাগী দেখলে খুশি হন। এটি বাঙালি সমাজের ঐতিহ্য এবং দীর্ঘদিনের আচরিত জীবনধারা।
তবে মুষ্টিমেয় কিছু নাস্তিক আছেন, যারা ছাত্রজীবনে কম্যুনিস্টদের খপ্পরে পড়ার কারণে মগজ ধোলাই হয়েছেন। তারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে শত্রু মনে করেন। বিশ্বব্যাপী কম্যুনিজম ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর আমাদের দেশে তারা এখন খোলস পাল্টে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন আর নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। তারা আরেকটি ঘৃণ্য নকশা এঁকেছেন সিলেবাসে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, ফ্রয়েডের যৌন সুঁড়সুঁড়ি আর পৌত্তলিকতার মতো স্পর্শকাতর বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে। তাদের লক্ষ্য আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টিকালচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করে নিজেদের আদর্শিক ব্যর্থতার প্রতিশোধ নেয়া।
আমাদের ৯০ ভাগ ছেলেমেয়ে পড়ে স্কুলে। বাকি ১০ ভাগ পড়ে মাদ্রাসায়। যারা ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে, তারা প্রধানত এই ৯০ ভাগ থেকেই আসে। কাজেই স্কুলের ধর্মশিক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। এ সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
১. স্কুলের দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ধর্মপরীক্ষা মানে নিচের ক্লাসগুলোতে সেই অনুপাতে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা থাকা। বোর্ড পরীক্ষায় বাধ্যবাধকতার কারণে ছাত্রছাত্রীরা ধর্মভিত্তিক জীবনযাপনের প্রাথমিক ও মৌলিক শিক্ষা রপ্ত করে। এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার মানে তাদের নিজের ধর্মকর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে অন্ধ করে রাখা।
২. শিক্ষা মানে কী? শিক্ষা মানে ‘নিজকে জানা, নিজের চারপাশকে জানা।’ ধর্মীয় শিক্ষায় এই সংজ্ঞার আওতা আরও ব্যাপক। নিজের সৃষ্টির উৎস জানা, পৃথিবীতে থাকাকালীন দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং শেষ গন্তব্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা ধর্মীয় শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য। এখন নিজের চারপাশকে জানার জন্য কেবল ভূগোল, পৌরনীতি, বিজ্ঞান, পরিবেশ পরিচিতি, রাস্তাঘাট, শহর বন্দর প্রভৃতি সম্পর্কিত বইপুস্তক পড়াই কি যথেষ্ট? নিজের ও সমাজের মানুষের ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ন্যায়-অন্যায়ের বোধবিশ্বাস প্রভৃতি সম্পর্কে যদি জ্ঞান আহরণ না করে, তাহলে কী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নিজেকে ও নিজের চারপাশকে জানার কাজ হয়ে যাবে?
৩. যারা স্কুল থেকে ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন, তাদের জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনাদের এই পদক্ষেপের ফলে কী আমাদের ছেলেমেয়েরা একেবারে ধর্মহারা হয়ে যাবে? তারা কী নাস্তিকরূপে বেড়ে উঠবে? না, তা হবে না। কোনো কোনো নাস্তিক বুদ্ধিজীবীর ঘরে ধার্মিক ছেলেমেয়ের খবর আমাদের কাছে আছে। এর কারণ কী? ক্ষিধা পেলে খাবারের চাহিদা প্রত্যেক মানুষের সহজাত প্রবণতা। ক্ষুধার সময় যদি স্বাস্থ্যসম্মত ভালো খাবারের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে বাধ্য হয়। জৈবিক চাহিদার মতো ধর্মীয় চেতনাও মানব মনের সহজাত আত্মিক চাহিদা। ধর্ম সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা ও ব্যাখ্যা না পেলে সরলপ্রাণ লোকেরা ভ-দের খপ্পরে পড়বে, এ কথা যুক্তি দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন হয় না। এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখুন।
৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষার বালাই নেই। সমাজের উচ্চবিত্ত তথাকথিত অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা এসব ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে। ধর্মীয় শিক্ষা বঞ্চিত এসব প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েই ধর্মীয় উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়। তার উদাহরণ কয়েক বছর আগে গুলশানের অভিজাত এলাকায় হলি আর্টিজানে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা। রিপোর্টে এসেছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অভিজাত পরিবারের ছেলেরা ধর্মীয় উগ্রবাদী মানসিকতা নিয়ে কাজটি করেছে। কোনো মাদ্রাসা ছাত্র বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণকারী কোনো ছাত্রের নাম এ ঘটনার কোথাও উচ্চারিত হয়নি। কীভাবে এসব ছাত্রের মধ্যে উগ্রবাদের সংক্রমণ হয় কিংবা জন্মদাতা মা-বাবাকে হত্যাকারী ঐশীরা কীভাবে জন্ম নেয় তা বুঝার জন্য একটু গভীরে যাওয়ার অনুরোধ করব।
৫. কোরআন ও হাদিসের কোনো কোনো বাণী আছে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এগুলোকে খণ্ডিত আকারে অপব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে এবং অনেক উর্বর মস্তিষ্ক থেকে তা হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি হাদিস, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফরি করল।’ হাদিসটি বোখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত। মাদ্রাসা অঙ্গনে এর তরজমা ও ব্যাখ্যা হলো এমন- ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানি করল বা কাফেরের মতো কাজ করল। কিন্তু উগ্রবাদের প্রবক্তাদের কাছে এর অর্থ অন্য রকম। তারা বলতে চায়, এমন লোক কাফের হয়ে গেল। তার মানে ইচ্ছাকৃত নামাজ ছেড়ে দেয়ার কারণে মানুষ ইসলাম থেকে খারিজ ও মুরতাদ হয়ে যায়। ব্যাপারটি কতদূর গড়াতে পারে চিন্তা করে দেখুন।
৬. ইসলামে চুরির শাস্তি চোরের হাত-পা কেটে দেয়া। জেনা-ব্যভিচারের শাস্তি পাথর মেরে হত্যা কিংবা ১০০ ঘা চাবুকের আঘাত। এ ধরনের পাঁচটি শাস্তি অত্যন্ত কঠিন এবং হুদুদ নামে পরিচিত। তবে শাস্তি যেমন কঠিন তা প্রয়োগের পূর্বশর্তও অত্যন্ত কঠিন। তন্মধ্যে একটি শর্ত হলো, অপরাধের তদন্ত ও শাস্তি প্রয়োগ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে হতে হবে। অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে উল্টা অভিযোগকারীকে ৮০ ঘা বেত্রাঘাত করা হবে। যারা মাদ্রাসায় এসব বিষয় পড়ে, তারা শাস্তির প্রকারভেদ ও শর্তাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়; কিন্তু যারা সিলেক্টিভ কিছু বই পড়ে বা নেট দুনিয়ার বক্তৃতা শুনে নিজেদের মস্ত জ্ঞানী মনে করে তারা অপব্যাখ্যার শিকার হয়। তাতে কত ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে তা প্রমাণের জন্য অতীতে ৬৪ জেলায় একযোগে বোমাবাজি ও বাংলা ভাইদের উত্থানের গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে। কাজেই সমাজকে উগ্রতা, বিশৃঙ্খলা ও ধর্মীয় অরাজকতা থেকে রক্ষার জন্য স্কুল-কলেজে ধর্মীয় জীবনবোধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দানের প্রয়োজনীয়তা কোনো বিবেকবান মানুষ অস্বীকার করতে পারে না।
৭. শিল্পোন্নত কোনো দেশ যখন অন্য দেশে পণ্যদ্রব্য বাজারজাত করার চিন্তা করে, তখন প্রথমে তারা ফিল্ড স্টাডি করে। পণ্যটি জনপ্রিয় ও বাজারজাত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের বোধ বিশ্বাস, জীবনাচার, ভালো লাগা না লাগা, রুচিবোধ প্রভৃতি সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা লাভের চেষ্টা করে। কাজেই জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার।
৮. স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারটি শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের জন্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা ও সংকটের শিকড় কোথায়। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে গোটা জাতি আজ খাবি খাচ্ছে। মাদক দ্রব্যের ছোবলে বর্তমান প্রজন্ম রসাতলে যাচ্ছে। দুদক দিয়ে দুর্নীতি দূর হচ্ছে না। ক্যাসিনোতে জুয়ার আড্ডা বন্ধ হচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কোটি কোটি টাকা সুফল বয়ে আনছে না। দেশের ভবিষ্যত কী হবে কেউ বলতে পারছে না। সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি, এই সমস্যা ও সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ মানুষের মনে খোদাভীতি জাগ্রত করা। আখেরাতের ভয়ে শুদ্ধ জীবনবোধে উজ্জীবিত করা। ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারামের ফারাক সম্পর্কে সচেতন করা এবং পিতামাতা, প্রতিবেশী অসহায় গরিব মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা, যা একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রকে অরাজকতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য স্কুলের বোর্ড পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা বহাল করুন। পরবর্তী পদক্ষেপে প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদালয় পর্যন্ত সব স্তরে ছাত্রছাত্রীদের নিজের ধর্ম, ঐতিহ্য, জীবনবোধ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দিন।
আপনারা বিবর্তনবাদ ও নাস্তিকতা পৌত্তলিকতার সিলেবাস পাল্টাতে বাধ্য। হাতেগোনা কয়টা নাস্তিক গোটা জাতির ভাগ্য নিয়ে খেলবে তা হতে পারে না। ক’দিন পর ছেলেমেয়েরা যখন নিজেরা ‘আমরা বানরের বাচ্চা বলে’ বলাবলি করবে, তখন কেউ সহ্য করতে পারব না। আমরা মুসলমান, আমরা বানর থেকে রূপান্তরিত হইনি। আদম ও হাওয়া (আ.) আমাদের পিতামাতা। ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও বিশ্বাস করে মানুষ এসেছে অ্যাডাম (আদম) ও ইভ (হাওয়া) থেকে। যারা ব্রম্মের অন্ড থেকে জগত সৃষ্টির রূপকথায় বিশ্বাস করে তারাও স্বীকার করে না, বানর থেকে মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছে।
আপনারা ডারউইনের জঞ্জাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে দর্শনে পড়ান; স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নয়। আমাদের সন্তানদের বানরের বাচ্চা বানানোর চেষ্টা করবেন না। তাদের মানুষরূপে গড়ে তুলুন। অন্যথায় ইতিহাস ক্ষমা করবে না।