বাংলা ভাষা চর্চায় আলেম সমাজের অবদান

মুফতি পিয়ার মাহমুদ

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহতায়ালার বিশেষ দান ও অসাধারণ নেয়ামত। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাদের শিখিয়েছেন ভাষা। (সুরা আর রাহমান : ৩-৪)। ওই আয়াতে আল্লাহতায়ালা মানব সৃষ্টির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি ভাষা শিক্ষার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভাষা না থাকলে মানুষ বিকল। ভাষা ও মানুষ একে অপরের সম্পূরক। ওই আয়াত এ কথারও ইঙ্গিত বহন করে যে, আল্লাহতায়ালা অন্য কোনো প্রাণীকে মানুষের মতো ভাষা দান করেননি। এ ক্ষেত্রে মানব অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা। তাই পৃথিবীর বুকে যত ভাষাই চালু আছে, সবগুলোই আল্লাহতায়ালার এক অমূল্য নেয়ামত। যার কোনো বিকল্প নেই। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, সবাইকে স্বজাতি ও এলাকার ভাষা দিয়েই প্রেরণ করেছেন। এভাবে সব আসমানী কিতাবও যে জাতির জন্য নাজিল করেছেন, সে জাতির ভাষাতেই নাজিল করেছেন। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- ‘আমি সব রাসুলকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যেন তাঁরা তাদের আল্লাহর হুকুমণ্ডআহকাম পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারেন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ওই আয়াতও মাতৃভাষার যথাযথ গুরুত্ব দানের বার্তা দেয়। এক কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক ভাষারই গুরুত্ব সীমাহীন এবং এর সযত্ন ও নিয়মতান্ত্রিক চর্চা নেক আমল বলে গণ্য।

সে মতে ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্বও সীমাহীন এবং এর চর্চায় আত্মনিয়োগ করাও পুণ্যের আমল বলে বিবেচিত হবে। তাই একে অবহেলা করা বা গুরুত্বহীন মনে করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই; বরং একে স্থান দিতে হবে কোরআন-হাদিস, মুহাম্মাদ (সা.) ও জান্নাতের ভাষা আরবির পাশেই। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো, দীর্ঘকাল খোদার সৃষ্টি আমাদের এ ভাষাটি মুসলামনদের অবহেলার শিকার ছিল। তখন তার দখল নিয়েছিল হিন্দু দাদা-বাবুরা। ফলে সংস্কৃতির দানাপানি খাইয়ে তার যেমন চেহারা বদলে দিয়েছে দেব-দেবীর পূজারি দাদা-বাবুরা, তেমনি এর চর্চা শিকার হয়েছে ভয়াবহ সংকীর্ণতা ও নীচুতার। গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের কোনো দর্পণেই বিম্বিত হতে পারেনি আমাদের প্রাণের ধর্ম ইসলাম ও মুসলমানের যাপিত জীবন। তবে আশার কথা হলো, ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে মুসলমান ও আলেমণ্ডওলামারা এ দিকে নজর দিতে শুরু করেন। ফলে বাংলা ভাষা যখন আলেমণ্ডওলামা ও মুসলমানদের পরশ পেয়ে মাত্রা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনই পাকিস্তানের নির্বোধ শাসকদের মাথায় চাপে একের ভাষা অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার নাদান ভূত। তখনই গর্জে ওঠে বাংলার দামাল ছেলেরা। ঢাকার রাজপথ লাল হয় দামাল ছেলেদের তপ্ত রক্তে। বাতাসে ঢেউ উঠে প্রতিবাদের। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের বহ্নিশিখা। এই আন্দোলনে সচেতন অন্য সবার মতো আলেম সমাজও অংশগ্রহণ করেন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।

এ ক্ষেত্রে আমরা সবিশেষ উল্লেখ করতে পারি মাওলানা আতহার আলী (রহ.) এর নাম। ঐতিহাসিক দলিল মতে, ১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ কিশোরগঞ্জের হজরত নগরে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক সম্মেলেন। এই সম্মেলনে সর্বমহলের আলেমণ্ডওলামা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ মার্চ ছিল কাউন্সিল। সভাপতি ছিলেন মাওলানা আতহার আলী (রহ.)। এই কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘চতুর্থ প্রস্তাব : খ. পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের এই সম্মেলন পাকিস্তান গণপরিষদের নিকট দৃঢ়তার সহিত দাবি জানাইতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হোক।’ তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির জন্য প্রণীত মূলনীতিতেও তিনি এই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে উত্থাপন করেন- ‘উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ এক কথায় উভয় পাকিস্তান থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবকারী মাওলানা আতহার আলীই (রহ.) প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। (হায়াতে আতহার : ১৩৮-১৩৯)।

এখানেই কি শেষ? সেই সময় তিনি কওমি মাদ্রাসার তালিবুল ইলমদের বাংলা ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন ‘মুতামুরুল মাদারিসিল কাওমিয়্যা।’ তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের প্রধান। সেখানে তিনি দক্ষ অভিজ্ঞ বাংলার শিক্ষক রেখে ছাত্রদের ভালোভাবে বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। তার এই চৌকস উদ্যমতা দেখে অনেকে শঙ্কিত হন এই ভেবে যে, মাওলানা আবার জামিয়াকে কলেজ বানিয়ে ফেলেন কি-না? তার সযত্ন তত্ত্বাবধানে তখন নিয়মিত বেশ কিছু পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। দৈনিক নবজাত, সাপ্তাহিক নেজামে ইসলাম ও মাসিক মুনাদী তার মধ্যে অন্যতম। এখানে আমরা আরও স্মরণ করতে পারি ইসলামের রসে সিক্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর্ণসন্তান মুজাহিদে আজম মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী, শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.)-কে।

হজরত ফরীদপুরীর রচনা ভান্ডার যেমন বিশাল, তেমনি বিষয়-বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য। হজরত থানবী (রহ.)-এর বেহেশতি যেওরের বাংলা তরজমা থেকে বিশাল তাফসিরে হক্কানি পর্যন্ত তার এই দীঘল কলম সংগ্রাম তাকে এনে দিয়েছিল বাংলার থানবী স্বীকৃতি। তারই মজবুত ও দক্ষ হাত ধরে উঠে আসেন তার সূর্যশিষ্য শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)। বাংলায় তার অনূদিত ও সম্পাদিত দশ খণ্ডে প্রকাশিত বুখারি শরিফের বর্ণাঢ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য এক অপার গৌরবের প্রতীক। লাখো ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তার সে অপার কীর্তিতে সিক্ত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আমাদের এই দুই মহান মনীষীর দক্ষ হাতে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে মাসিক নেয়ামত ও মাসিক রহমানী পয়গাম এখনও বিলিয়ে যাচ্ছে সাহিত্য রসে সিক্ত করে ঐশী চেতনায় প্রজ্জ্বোল ইসলাম ও ঈমানের আলো।

ইসলামের রসে তৃপ্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কাছে অতীত কাফেলার আরেক প্রবাদ প্ররুষ হচ্ছেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.)। তার প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত মাসিক মদীনাও প্রবাদতুল্য। বলতে গেলে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তো ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য মাসিক মদীনার দিকেই তাকিয়ে থাকেন এখনও। এই এক মাসিক মদীনাই তাকে দেশ-বিদেশে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। আর তাফসিরে মারিফুল কোরআনের বঙ্গানুবাদ তো এনে দিয়েছিল আকাশচুম্বী খ্যাতি। এ ছাড়া জনপ্রিয় সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানও তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত। তার অনূদিত, সম্পাদিত ও স্বলিখিত বইয়ের বিশাল ভান্ডার তো কালের সাক্ষী। যার সংখ্যা ১০৫টি।

আসল কথা হলো, এ উপমাহাদেশে বিভিন্ন কারণে উর্দু, ফারসির বিশাল প্রভাবের ফলে এক সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার দিকে আলেম সমাজ ও সাধারণ দীনদার শ্রেণী দৃষ্টি দিতে পারেননি। ফলে পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত এ দেশে আলেমদের মধ্যে কারা বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেছেন, পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, বাংলা ভাষায় বলা ও পাঠদানকে উৎসাহিত করেছেন, তার একটা তালিকা খুব সহজেই করা সম্ভব। কিন্তু আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে এসে এই তালিকাটা আর হাতের মুঠোয় থাকে না। আর একুশ শতকে এসে থাকে না সাধ্যের সীমানায়। সব মিলে সে তালিকা এখন বিস্ময়কর। তাদের লিখিত ও সম্পাদিত মাসিক, সাপ্তাহিক, সাহিত্য চর্চার ম্যাগাজিন আর কোনো উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারকের সংখ্যার তালিকাও বিস্ময়কর। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। খালেস দ্বীনি স্টাইলে খালেস দ্বীনি বিষয়ে যেমন লেখা হচ্ছে, তেমনি লেখা হচ্ছে আধুনিক স্টাইলে ধর্মীয় বিষয় বা সাধারণ বিষয় নিয়ে।

ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবই বের হচ্ছে কওমি ক্যাম্পাস থেকে। কওমি ক্যাম্পাসে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে এমন একটি শক্তিশালী কাফেলা। ফলে ইসলামের বিমল গায়ে কেউ মলের আঁচড় দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যাবে, তা আর এখন ভাবা যায় না। এই মিছিল প্রতিদিনই বড় হচ্ছে। হচ্ছে দিঘল। এই কাফেলার হালের স্বর্ণসন্তান হলেন মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ, মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী, মাওলানা লেয়াকত আলী, মুফতি আব্দুল মালেক, মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ, মুফতি হিফযুর রহমান, মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসাইন, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা যাইনুল আবিদীন, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ, মাওলানা লাবীব আব্দুল্লাহ, মাওলানা গোলাম রব্বানী, মাওলানা জহির উদ্দীন বাবর প্রমুখ। সত্যি কথা কী, আমাদের আত্মার স্পন্দন, মানব ও মানবতার অহঙ্কার হজরত মুহাম্মাদ (সা.) দ্বীন প্রচারের যে মহান মিশন নিয়ে আলো-আঁধারের এ দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং স্বজাতির ভাষাকে যে মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তুলে নিয়েছিলেন অব্যর্থ অস্ত্ররূপে, আমরা সে মিশন ও অস্ত্রকে ছাড়তে পারি না। তাই ঐশী চেতনায় প্রজ্জ্বোল ঈমানি মশাল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য চর্চার পবিত্র এই ময়দানে। এই হোক হালের সব ভাষা প্রেমীকের দৃপ্ত অঙ্গীকার।

লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, তালতলা, মোমেনশাহী

শায়খুল হাদিস, নাসিরাবাদ তুহফাতুল জান্নাত মহিলা মাদ্রাসা, মোমেনশাহী ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, মোমেনশাহী