বৃক্ষ, পুষ্প ও ঝরনাশোভিত উদ্যানের ধারণা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত বেহেশতের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বহু অর্থের বিনিময়ে মুসলমানরা উদ্যান, খাল ও ঝরনা নির্মাণ করেন এবং একই সীমানায় তাদের কবরের স্থান নির্ধারণ করেন- যেন মৃত্যুর পর তাঁরা বেহেশতে বিশ্রাম করছেন। এভাবে কোরআনের বর্ণনা অনুসরণ করে পৃথিবীকে তারা বেহেশতের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, বেহেশতে বৃক্ষ, ফল, পুষ্প ও ঝরনা রয়েছে। উদ্যান রচনার ধারণা ক্রুসেড যোদ্ধাদের মাধ্যমে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে প্রবেশ করে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়ে ক্রুসেড যোদ্ধারা তারা বীজ এবং চারা সঙ্গে নিয়ে যেতেন।
মঘুলদের আগে ভারতবর্ষে উদ্যান প্রচলিত থাকলেও তারাই প্রথমে সরাসরি এদেশে পারসিক উদ্যান রচনার রীতি প্রবর্তন করেন। যমুনা নদীর তীরে বাবর সর্বপ্রথম একটি উদ্যান রচনা করেন এবং এর নাম ছিল রাম বাগ। পরবর্তী সময়ে ২০০ বছরে উত্তর ও মধ্যভারতের সর্বত্র অনেক উদ্যান রচনা করা হয়েছিল। ভারতবর্ষে উদ্যান রচনা জাহাঙ্গীরের আমলে কাশ্মীরে উৎকর্ষ লাভ করে। এই উদ্যানগুলো ছিল ‘আধ্যাত্মিক ধ্যান-সাধনা অথবা অন্যদের সঙ্গে আনন্দে অংশগ্রহণের স্থান। দিনের প্রখর তাপদাহ থেকে আরামদায়ক স্থান। এবং সম্রাটদের দীর্ঘ ভ্রমণপথে বিশ্রামস্থল।’ অধিকাংশ মোগলই জীবদ্দশায় তাদের সমাধি নির্মাণ করতেন। এই সমাধিগুলো ফলবান বৃক্ষ, পুষ্প, খাল এবং ঝরনা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এসব উদ্যানের পরিকল্পনা কোরআনে বর্ণিত বেহেশতের ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। নির্মাণকারীদের জীবদ্দশায় পার্শ্ববতী উদ্যানগুলো বাদশাহদের প্রমোদণ্ডউদ্যান হিসাবে ব্যবহৃত হত এবং তাদের মৃত্যুর পর এগুলো সুফি-দরবেশদের কাছে হস্তান্তর করা হতো।
এসব উদ্যানে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কোনো কোনো উদ্যানে গবাদি পশুর মাধ্যমে কূয়া থেকে পানি উত্তোলন করা হত। দূরবর্তী নদী থেকে এ উদ্দেশ্যে খাল খনন করে অন্যান্য উদ্যানে পানি আনয়ন করা হত। আগ্রার রাম বাগে গবাদি পশুর সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হত। বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬১৯ সালে কাশ্মীরের শালিমার উদ্যান নির্মাণ করেন। ডাল লেক থেকে একটি খালের মাধ্যমে এখানে পানি সরবরাহ করা হয়। এ উদ্যানটি আয়তাকার। আবার ১৬৪২ সালে বাদশাহ শাহ জাহান নির্মিত লাহোরের শালিমারে ১০০ মাইল দূরবর্তী ইরাবতী (রাভি) নদী থেকে খাল খনন করে পানি আনয়ন করা হত। এই ধরনের উদ্যানগুলোতে চার-বাগ পদ্ধতির পানির নালা ছিল। পানির নালাগুলো সরল রেখায় পরস্পর সমকোণে ছেদ করে এবং উদ্যানটিকে চারটি অংশে বিভক্ত করে। হুমায়ুনের সমাধি সম্পূর্ণ পারস্যরীতিতে তৈরি এবং সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এ মোগল উদ্যানটি আদি রূপে অপরিবর্তিত অবস্থায় বিদ্যমান। এ উদ্যানে ৪র্১-র্৬র্ প্রশস্ত বাঁধানো পথের মধ্যবর্তী অংশে পানির অপরিসর নালা রয়েছে। পরবর্তী উদ্যানগুলোতে এ নালা ক্রমান্বয়ে আরও প্রশস্ত হয়ে এসেছে। হুমায়ুনের সমাধিতে ‘পানি সরবরাহের উৎস হিসেবে উত্তর ফটক সংলগ্ন একটি বৃহৎ কূপ ছিল।’ ইতিমাদুদ্দৌলার সমাধিতে ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে নালাগুলোতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। ‘(লাহোরের শালিমারে) উদ্যানের মধ্যে এখনও খাল ও নালার এক বিস্তৃত ব্যবস্থা রয়েছে এবং উদ্যানের দূরতম কোণে সহজেই পানি পৌঁছাতে পারে।’ সব মোগল উদ্যানই ফলবান বৃক্ষ, পুষ্প, খাল ও ঝরনা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। সে আমলে কোনো পাম্প মেশিন না থাকায় শুধু অভিকর্ষের সাহায্যেই এসব উদ্যানে পানি সরবরাহ করা হত।
এ পর্যায়ে বাংলাদেশে উদ্যানের ইতিহাস আলোচনা করা যায়। মোগলরাই এ দেশে উদ্যানের ধারণা আমদানি করে। সুলতানি বাংলায় উদ্যান রচনার ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। লালবাগ দুর্গের অভ্যন্তরে একটি উদ্যান ছিল বলে অনুমান করা যায়। সেখানে এখনও অনেক প্রাচীন ঝরনা ও একটি হাম্মাম রয়েছে। উদ্যান, ঝরনা ও হাম্মামে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আলোচনা করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
শামসুল আলমের মতে পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পারসিক চাকার (Persian wheel) সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হত। এটি সম্ভাব্য হলেও নিকটবর্তী নদী হতে কোনো স্থানে পানি উত্তোলন করা হত বর্তমানে তা নির্ণয় করা যায় না। বুড়িগঙ্গা দক্ষিণে সরে গেছে। তবে এটি সম্ভবত তৎকালে দুর্গের দক্ষিণ দেওয়াল স্পর্শ করত। বর্তমানে দেখা যায় যে, দুর্গ প্রাকার আরও মজবুত করার জন্য এখানে দুটি দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বুরুজ থেকে পানি উত্তোলন করে সমগ্র দুর্গে পানি সরবরাহ করা হত বলে আপাতত ধরে নেয়া যায়। দুর্গ প্রাকারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের উপরে সম্ভবত একটি জলাধার ছিল। দক্ষিণ প্রাকারে র্৪র্ ব্যাসের পানির ২টি নালি নদী থেকে পানি উত্তোলনের ধারণার জোরালো সমর্থন করে। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বুরুজের সঙ্গে একই সারিতে অবস্থিত। পরি বিবির সমাধির দক্ষিণে একটি জলাধার অদ্যাবধি বিদ্যমান। উঁচু স্থানে অবস্থিত এ জলাধারটি সমগ্র দুর্গ এলাকা, ঝরনা ও পুব দিকের হাম্মামে পানি সরবরাহ করত। ৪৫০ কোণে স্থাপিত একটি প্রস্তর ফলক দিয়ে এ জলাধার থেকে পানি প্রবাহিত হত। পরি বিবির সমাধির চার দিকে চারটি বর্গাকার চৌবাচ্চা ও চারটি ঝরনা রয়েছে। দক্ষিণ দিকের চৌবাচ্চায় শায়েস্তা খানের তিনজন আত্মীয়কে দাফন করা হয় এবং বর্তমানে এখানে তিনটি শবাধার রয়েছে। ১৯৮০ সালের খননের সময়ে পণ্ডিত ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কাছে লালবাগের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্মোচিত হয়।
র্১ ব্যাসের একটি পাইপ লাইন দুর্গ এলাকার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল। এটি সম্ভবত মসজিদ এলাকা থেকে শুরু হয়ে পরি বিবির সমাধি ও দরবার হল হয়ে পূর্ব দিকের মসজিদ পর্যন্ত গিয়েছিল। পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত পোড়ামাটির এই পাইপ লাইন পরি বিবির সমাধির চার দিকের ঝরনা ও দরবার হল সংলগ্ন হাম্মামের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই আমলে পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত পোড়ামাটির প্রাচীন এ পাইপ লাইন মাটির র্৫-র্৬র্ নিচে স্থাপিত ছিল। এর দু’দিকে পাকা দেওয়াল ছিল। কোন দিক থেকে কোন প্রকার চাপ বা আঘাতের ফলে এটি যাতে ভেঙে না যায়, সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাইপলাইনের উপরে কংক্রিটের একটি ফলক ছিল।
হাম্মামের দেওয়ালের অভ্যন্তরে পোড়ামাটির আরও সরু পাইপ ছিল। দুর্গের পূর্ব দিকে দরবার হলের নিচ তলায় একটি চৌবাচ্চা ও ঝরনা ছিল। উষ্ণ ও শীতল পানির পৃথক আধার ও হাম্মামের মেঝের গভীরতার মধ্যে গোসলের জন্য একটি জলাধার রয়েছে। নিচে নামার জন্য জলাধারে একটি সরু সিঁড়ি সংযুক্ত আছে। ব্যবহার্য পানি গরম করার জন্য হাম্মামের উত্তরে পৃথক একটি রান্নাঘর রয়েছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মসজিদ থেকে পুকুর পর্যন্ত পোড়ামাটির একটি পাইপলাইন ছিল। কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরে পানি সরবরাহের জন্য উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত কোনো পাইপ লাইন ছিল কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। চার-বাগ পদ্ধতির উদ্যানে এরূপ থাকার কথা। কিন্তু বিষয়টি লালবাগে এভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় একটি কূয়া আবিষ্কৃত হয়েছে।
দুর্গের অভ্যন্তরে পানি সরবরাহের স্থান নির্ধারণের জন্য ১৯৮৭ সালে খনন কার্য পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কোন কূয়া পাওয়া যায়নি- যদিও কোনো কোনো পণ্ডিত এরূপ অনুমান করেছেন। বড় জলাধারের পশ্চিমে উঁচু টিলার উপরে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি পাকা নালা উন্মোচিত হয়। এই পাকা নালার অভ্যন্তরে আনুভূমিকভাবে স্থাপিত পোড়ামাটির একটি পাইপ ও এর সঙ্গে তাম্রনির্মিত উল্লম্ব কয়েকটি ঝরনা সংযুক্ত আছে। এ ঝরনাগুলোর আকার অনেকটা হুকার ন্যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে দুর্গাভ্যন্তরে অনেক নতুন নালা ও ঝরনা স্থাপন করা হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিবিবির সমাধি ও দরবার হলের মধ্যবর্তী স্থানে ৪র্০ বর্গাকার ও ৫র্০ গভীরতা বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় একটি জলাশয় তৈরি করা হয়েছে। নতুন নালাগুলোর গভীরতা পরবর্তীতে কমানো হয়েছে এবং এখানে রঙিন টালি লাগানো হয়েছে। প্রত্যেকটি নালাই ১র্২ প্রশস্ত। নালাগুলোতে সর্বমোট ৬৭টি নতুন ঝরনা রয়েছে এবং আলোকসজ্জার জন্য নালাগুলোর পাশে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।