মাহে রমজানের প্রস্তুতি যেভাবে
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পবিত্র মাহে রমজান দুনিয়াবাসীর কাছে বেহেশতি মেহমান। এই মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে আসে রহমতের সওগাত নিয়ে, মুক্তি ও কল্যাণের বর্তা নিয়ে। এই মেহমানকে স্বাগত জানাতে, বরণ করতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে গবেষকরা বেশ কিছু টিপস দিয়েছেন। যেমন- প্রথম করণীয় হলো রমজান পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভালো প্রস্তুতি মানেই ওই কাজটির অর্ধেক অর্জিত হয়ে যাওয়া।
ত্যাগ ও সেবার মনোভাব লালন করা
কেউ হয়তো মনে করেন, রমজানে দিনে কষ্ট করলেও রাতে ভোগের দেদার আয়োজন থাকে। ভালো ভালো খাওয়া যায়। অসাধু ব্যবসায়ীদের ধারণা, রমজানে পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে মজুতদারি করে লাভবান হতে পারবে। এক মাসের বেচাকেনায় পুরো বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ খোঁজে অনেকে। আসলে কপালপোড়া লোকেরাই এমনটি চিন্তা করতে পারে। কারণ রমজান হলো ত্যাগের মাস। রমজান ইবাদত-বন্দেগির মাস। অভাবী মানুষ, সাধারণ লোকদের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাস। ন্যায্য দামে জিনিসপত্র বিক্রি করে, কাউকে ভেজাল দেয়া বা না ঠকানোর মানসিকতা পরিহার করলে সেটিও সাধারণ মানুষের খেদমত হিসেবে তা গণ্য হবে। দুঃখজন হলেও সত্য মানুষ আত্মিক প্রস্তুতি বাদ দিয়ে এসবের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে। মূলত শয়তান যাদেরকে কাবু করে তারা এভাবেই প্রতারিত হয়।
মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ ও দোয়া
রমজানকে বরণ করার মানসিক প্রতিজ্ঞা থাকা চাই। অর্থাৎ রমজান মাসে পরিপূর্ণ সাওয়াব ও ক্ষমা পাওয়ার বুক ভরা আশা লালন করতে হবে। রমজানের জন্য মনকে প্রস্তুত করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো দোয়া। আল্লাহর কাছে দোয়া করা। বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত মুয়াল্লা ইবনে ফজল বলেন- ‘সালাফে সালেহিন রমজানের ৬ মাস আগে থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করুন। আর রমজান শেষে তারা বাকি ৬ মাস দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! রমজানে যা আমল করেছি তা আপনি কবুল করে নিন।’
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রজব মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাজান।’ ‘হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করুন।’ এই দোয়ার মধ্য দিয়েই হাসিল হয় মানসিক প্রস্তুতি, মনের জমিনকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া।
তাওবা-ইস্তিগফার
আরেকটি প্রক্রিয়া হলো তাবাহ-ইস্তিগফার করা। এতদিনকার যাবতীয় গোনাহখাতা থেকে তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। যদি ভাবে যে, রমজান এলে আমার সব গোনাহ এমনিতেই ক্ষমা হয়ে যাবে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, মস্তবড় শয়তানের ধোঁকায় পড়েছে। কারণ, বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। বরং আগে থেকে তাওবা-ইস্তিগফার করে রমজানের যাবতীয় কল্যাণ লাভে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
রমজানের উপকারিতার কথা স্মরণ করা
রমজানকে স্বাগত জানানোর একটি ধরন হলো, রমজানের উপকারিতার কথা স্মরণ করা। বরকতময় মাস রমজান সম্পর্কে কুরআন-সুন্নায় যেসব ফজিলত মর্যাদা ও উপকারিতার বর্ণনা রয়েছে, রমজান শুরু হওয়ার আগেই সেসব সম্পর্কে জেনে নেয়া।
প্রয়োজনীয় মাসায়েল শিখে রাখা
রমজান মাস আসার আগে রোজা পালনের মাসআলা-মাসায়েল তথা নিয়মণ্ডকানুনগুলো ভালোভাবে জেনে নেয়া জরুরি।
কাজা রোজা আদায় করা
রমজানের প্রস্তুতির বড় একটি আয়োজন হলো কাজা রোজা আদায় করা। রমজান শুরু হওয়ার আগে বিগত জীবনে অসুস্থ হওয়ার কারণে বা সফরের কারণে রমজানের ফরজ রোজা কাজা হয়ে থাকলে তা যথাযথভাবে আদায় করে নেয়া। বিশেষ করে মা-বোনদের ভাঙতি রোজা থাকতে পারে। তাই রমজানের আগে শাবান মাসের এ সময়ে কাজা রোজা আদায় করে নেয়া দরকার। এতে দুটি ভালো আমল বাস্তবায়িত হবে-
প্রথমটি : বিগত জীবনের কাজা রোজা আদায় হবে। রমজানের রোজা পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
দ্বিতীয়টি : সুন্নাতের অনুসরণ হবে। রমজানের আগের মাস শাবানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। মহিলা সাহাবিরাও তাদের গত রমজানের ভাঙতি রোজা থাকলে তার কাজা আদায় করতেন।
শিরক ও বিদ্বেষ পরিহার
আল্লাহতায়ালা রমজান মাসে অনেক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এ ক্ষমা পেতে হলে দুটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহলো-
-শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক না করা। অর্থাৎ আকিদা বিশ্বাসে বা বাস্তব কর্মে আল্লাহর সমকক্ষ কাউকে মনে না করা।
-হিংসা থেকে মুক্ত থাকা। কারণ হিংসা মানুসের সব নেক আমলকে সেভাবে জালিয়ে দেয়; যেভাবে আগুন কাঠকে জালিয়ে দেয়।
সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করা
রমজান মাসজুড়ে পুরো সময়টি কোন কোন কাজে কীভাবে ব্যয় হবে তার একটি সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করে নেয়া উচিত। আগাম রুটিন থাকলে রমজানে চরম ব্যস্ততার মাঝেও নেক আমলসহ অন্যান্য কাজগুলোও ইবাদতের মধ্যেই কেটে যাবে।
রমজানের চাঁদ দেখা
রমজানকে স্বাগত জানানোর আরেকটি আয়োজন হল, রমজানের চাঁদ দেখা। এটি সুন্নাত। অর্থাৎ শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদের অনুসন্ধান করা সুন্নাত।
বর্তমান সময়ে চাঁদ দেখা (হেলাল) কমিটির দিকে তাকিয়ে থাকা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আবার অনেকে মোবাইল বা রেডিও টিভির সংবাদের অপেক্ষা করেন। এতে চাঁদ দেখা এবং দোয়া পড়ার সুন্নতটি থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। কাজেই আকাশের বুকে রমজানের চাঁদ অনুসন্ধান করার সুন্নাতটি জীবিত করার পূর্ব প্রস্তুতি রাখা। যারা রমজানের নতুন চাঁদ দেখবে তারা এই দোয়াটিও পড়বে।
হজরত তালহা ইবনু ওবায়দুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন বলতেন-
আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমান ওয়াস্সালামাতি ওয়াল ইসলাম রব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ : হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত করুন নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে। হে চাঁদ তোমার ও আমার প্রতিপালক হলেন আল্লাহতায়ালা।’
মনের জমিনকে প্রস্তুত করা
সবচেয়ে বড় কথা আমাদের মনের জমিনকে প্রস্তুত করতে হবে। বর্ষাকালে আকাশ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টি ধারণ করে নরম মাটি, নদী-নালা খালবিল। অর্থাৎ বৃষ্টির পানি ধারণ করার জন্য ছোট হোক বা বড় পাত্র থাকতে হবে। অন্তত জমিনের মাটি বৃষ্টিকে ধারণ করার উপযোগী হতে হবে। পাথরের গায়ে যতই বৃষ্টি নামুক তা জমবে না, মাটি ভিজবে না, প্রকৃতিতে প্রাণের শিহরণ জাগবে না। রমজানে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি ধারণ করার জন্যও আমাদের মনের জমি নরম হতে হবে। হৃদয়ের পাত্রটিকে আকাশের পানে উন্মুখ করে ধরতে হবে। তবেই রমজানের অফুরান কল্যাণ, বরকত ও রহমত নেমে এসে আমাদের হৃদয়ের মাটিতে সবুজ নেকির ফসল ফলাতে পারবে।
প্রভু হে আমাদের চেতনাকে শানিত কর, তোমার মেহমানকে বরণ করার, সমাদর করার তৌফিক দাও। দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি রজমানের সম্মান ও মর্যাদার অনুকুলে রাখ। আমিন।