সম্প্রতি আবিষ্কৃত বাংলাদেশের ঝিনেদা জেলার বারবাজার প্রাথমিক মুসলিম যুগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থল এবং বাংলার প্রাথমিক মুসলিম যুগের স্থাপত্য ইতিহাস পুনর্গঠনে এটি অত্যন্ত সহায়ক। বাংলায় মুসলিম অধিকার স্থলপথে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয় এবং বারবাজার এ প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বাংলাদেশের বর্তমান ঝিনেদা (বৃহত্তর যশোর) জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার এটি একটি ক্ষুদ্র এলাকা। এটি সম্ভবত শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের (৭৪৩-৯/১৩৪২-৫৮) সময়ে শহর-ই-নও নামে পরিচিত ছিল। বাগেরহাট যাওয়ার পথে খানজাহান (৮৬৩/১৪৫৯) সম্ভবত এ স্থান অতিক্রম করেছিলেন। বারবাজারের সাতগাছিয়া ও মনোহর মসজিদ বাগেরহাটের ষাইট গুম্বুজ মসজিদের (১৪৪০) নির্মাণ-কৌশলকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। বারবাজারের এ মসজিদ দুটির ওপরে ৩৫টি করে গম্বুজ স্থাপিত ছিল। এ সংখ্যাটি ষাইট গুম্বুজ মসজিদের এক বাহুর ওপরে স্থাপিত গুম্বুজের সমান। ষাইট গুম্বুজ মসজিদের মধ্যস্থলে সাতটি চৌচালাসহ এ মসজিদের গম্বুজের সংখ্যা ৭৭ (৩৫+৩৫+৭=৭৭)। সাতগাছিয়া ও মনোহর মসজিদের স্থাপত্য স্থূল এবং এটি নিম্নমানের কারিগরিবিদ্যা প্রদর্শন করে। বারবাজারের অন্যান্য পুরাকীর্তি হলো: গলাকাটা, জোড় বাংলা, পীর পুকুর, নুনগোলা, চেরাগদনি ইত্যাদি মসজিদ। জোড় বাংলা প্রত্নস্থল খননে প্রাপ্ত আবুল মোজাফ্ফর মাহমুদ ইবনে হোসাইনের একটি ইষ্টকলিপি অনুযায়ী অনুমিত হয় যে, এ এলাকাটি অন্তত পক্ষে হোসেন শাহি বংশের শেষ পর্যন্ত (৯৪৪/১৫৩৮) অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু ছিল।
বাগেরহাটের অবস্থান ও এর পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব বাংলার ইতিহাসে বেশ রহস্যাবৃত ছিল। বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত ষাইট গম্বুজ মসজিদ ও খানজাহানের সমাধি (মৃত্যু ১৪৫৯) বাগেরহাটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রত্নস্থল। প্রাচীন ভৈরবের পাড়ে অবস্থিত এ শহরটি সম্ভবত গৌড় সুলতানদের একটি সীমান্ত চৌকি ছিল। পরবর্তী ইলয়াস শাহি বংশের শাসনামলে (১৪৩৬-১৪৮৮) খানজাহান সম্ভবত স্থানীয় ও তার সঙ্গে আগত তুর্কি সৈন্যদের সমন্বয়ে এখান থেকে বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা করতেন। তখন এখানে সম্ভবত নৌ-সেনাদের আধিক্য ছিল। পুরাকীর্তিগুলোর সন্নিকটে ভৈরব নদের শুষ্ক খাত এখনও দেখা যায়। নদীটি পূর্ব দিকে এক মাইল সরে গেছে। বাগেরহাটের অন্যান্য পুরাকীর্তি হলো: চুনাখোলা মসজিদ, সিঙ্গার মসজিদ, বিবি বেগনি মসজিদ, রেজা খোদা মসজিদ, জিন্দা পীরের মাজার ও মসজিদ, সাবেক ডাঙাগার ইমারত ইত্যাদি। আহমদ হাসান দানি বলেন, “the buildings are more utilitarian as is clear from the stark plainness of the walls”. কোনার বুরুজগুলোতে মোল্ডিং, দেওয়াল গাত্রে প্যানেল নকশা, পোড়ামাটির অলঙ্করণ প্রভৃতি দেখা যায়। অন্যদিকে মোগল আমলের ইমারতগুলো পলেস্তারা আবৃত। ষাইট গুম্বুজ মসজিদ (আনু. ১৪৫০) ও খানজাহানের সমাধি (১৪৫৯) বাংলার স্থাপত্য ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ষাইট গম্বুজ মসজিদটি ঝিনেদা জেলার বারবাজারের সাতগাছিয়া ও মনোহর মসজিদ (পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ) দুটির দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বারবাজারের স্থাপত্য কারিগরিভাবে নিম্নমানের হলেও ষাইট গম্বুজ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী উন্নতমানের ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। সাতগাছিয়া ও মনোহর মসজিদের কোনার বুরুজগুলোর গোলাকৃতি এ দুটি ইমারতের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে। কেননা অষ্টভুজাকৃতির বুরুজগুলো গৌড়ের প্রভাব হিসেবে পরবর্তীকালে এ অঞ্চলে আমদানি হয়েছে।
সুলতানি আমলে অনেক সমাধি নির্মিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মালদা জেলার হজরত পা-ুয়ায় অবস্থিত একলাখি সমাধি (১৪২৫) অন্যতম। একলাখি সমাধি বাংলার স্থাপত্যকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। আহমদ হাসান দানি বলেন,
“This building has rightly been regarded as setting the Bengali type once for all. … The Eklakhi represents the true brick style of Bengal, with massive walls, octagonal corner towers, curved parapet, terracotta ornamentation, the wall surface variegated with offsets and recesses, and above all the numerous lines of mouldings. The glazed tiles are for the first time used in this building”.
খানজাহানের সমাধির শবাধারের নিচে ভূ-গর্ভস্থ একটি কক্ষ রয়েছে। সেখানে আরবি লিপি, আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং আল্লাহর নাম রয়েছে। সমাধি-কক্ষের অভ্যন্তরের মেঝে রঙিন টালি ( glazed or encaustic tiles) দ্বারা আবৃত ছিল। বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে আরও বহু প্রত্নস্থল ও ইমারত রয়েছে। এখানে সেগুলোর কয়েকটির নাম উল্লেখ করা যায়: মসজিদকুড় মসজিদ, খুলনা (পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী), কসবা আল্লাহর মসজিদ, বরিশাল (পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী), আরশনগর মসজিদ, খুলনা (ষোড়শ শতাব্দী), সিংদহ আউলিয়া মসজিদ, ঝিনেদা (ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ), রোয়াইলবাড়ি মসজিদ, নেত্রকোনা (ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধ), উচাইল (শংকরপাশা) মসজিদ, হবিগঞ্জ (১৪৯৩-১৫১৯), বিবিচিনি মসজিদ, বরগুনা (ষোড়শ শতাব্দী), মসজিদবাড়িয়া মসজিদ, পটুয়াখালী (১৪৬৫), শর্শদি মসজিদ, ফেনী (ষোড়শ শতাব্দী) ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে রোয়াইলবাড়ি প্রত্নকেন্দ্র সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা যায়।
পনের গুম্বুজবিশিষ্ট রোয়াইলবাড়ি মসজিদটি নেত্রকোনা জেলার (বৃহত্তর ময়মনসিংহ) কেন্দুয়া উপজেলাধীন রোয়াইলবাড়ি প্রত্নকেন্দ্রের দুর্গ এলাকায় অবস্থিত। এটি বর্তমানে শীর্ণধারা প্রাচীন বেতাই নদীর তীরে অবস্থিত। এটি বাগেরহাটের মতো একটি সীমান্ত চৌকি ছিল বলে ধারণা করা যায়। এ প্রত্নস্থলের বুরুজ ঢিবিতে রঙিন টালি পাওয়া গেছে। এটি সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি দুর্গ। এটির ইতিহাস হোসেন শাহি আমলের আগে নয় (১৪৯৩-১৫৩৮)। তবে পূর্ববর্তী সুলতানদের আমলেও এটি একটি জল-দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে।
সুলতানি আমলের ইমারতগুলো ইটের তৈরি ছিল এবং এগুলোতে প্রস্তর-স্তম্ভ ব্যবহৃত হয়েছিল। কোনো কোনো ইমারতের দেওয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে ইষ্টক ব্যবহৃত হয়েছে এবং দেওয়ালের দুই পার্শ্বে প্রস্তর
(stone veneers) ব্যবহৃত হয়েছে। গাঁথুনিতে কোথাও কোথাও কাদামাটি ব্যবহৃত হলেও প্রধান মশলা (mortar) ছিল চুন। পলেস্তারা হিসেবে চুন ব্যবহৃত হয়েছে। আহমদ হাসান দানি আরও বলেন,
“However, it is the use of lime which fundamentally distinguished the brick masonry of the Muslim period from that of the pre-Muslim. Lime was known to the Hindus, and it was used by them for concreting the floor, as evident from the excavations at Mahasthan, but lime as mortar is hardly known to have been used in the pre-Muslim period … Lime has also been used as a plaster, especially on the parapet, roof and dome in order to make the building water-tight”.
সুলতানি ইমারতগুলোতে পোড়ামাটির নকশা ও রঙিন টালির ব্যবহার ছিল। মুসলমানরা এ দেশে অতি উন্নতমানের পাথর খোদাই শিল্প প্রবর্তন করে। এর নমুনা চাঁপাইনবানগঞ্জ জেলার গৌড়ের ছোট সোনামসজিদে দেখা যায়।
ইমারতগুলোতে সাধারণত খিলান-রীতি ( arcuate system) ব্যবহৃত হলেও আদিনা মসজিদের জেনানা গ্যালারিতে সর্দল রীতি ( trabeate system) ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতের অন্যত্র কৌণিক খিলান ব্যবহারের আগেই বাংলায় কৌণিক খিলান ব্যবহার শুরু হয়। পশ্চিম বাংলার আদিনা মসজিদে (১৩৭৪-৭৫) ও গৌড়ের গুনমন্ত মসজিদে (১৪৮৪-৮৫) ভল্ট ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলার দক্ষিণ এলাকার ইমারতগুলির কোনার বুরুজগুলো পরবর্তী ইলিয়াস শাহি আমলে গোলাকার ছিল। তবে হোসেন শাহি আমলে এগুলোর আকার অষ্টভুজাকৃতির হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অষ্টভুজাকৃতির বুরুজগুলো গৌড়ের প্রভাব হিসেবে পরবর্তীকালে দক্ষিণ এলাকায় প্রবর্তিত হয় বলে ধারণা করা হয়। মিহরাবগুলোর আকৃতি সুলতানি আমলে অর্ধবৃত্তাকার ছিল। বক্র ছাদ কিনারা (curved cornice) অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে গ্রাম্য কুঁড়েঘরের আকৃতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দোচালা ও চৌচালা ছাদ এ আমলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ষাইট গম্বুজ মসজিদের (আনু. ১৪৪০) চৌচালা ও ছোট সোনামসজিদের (আনু. ১৫১০) চৌচালা একই আকৃতির নয়। তবে ম্যাক্কাচিয়ন (McCutchion) ভুলবশত এ দুটি চৌচালা একই আকৃতির বলে উল্লেখ করেছেন। ছোট সোনামসজিদের চৌচালা বক্র কিনারাযুক্ত পুরাপুরি চৌচালা আকৃতির; কিন্তু ষাইট গম্বুজ মসজিদের চৌচালার চার দিকটাই ঢালু হয়ে সরাসরি ছাদে গিয়ে মিশেছে। ষাইট গুম্বুজ মসজিদের চৌচালার ওপরের দিকটা সমান ( flat)। এ ধরনের স্থাপত্যরীতি বাংলার পরবর্তী স্থাপত্য ধারাকে বিশেষ করে মন্দির স্থাপত্যকে প্রভাবিত করেছে। দোচালা, চৌচালা, আট চালা এবং ষোল চালা বিশিষ্ট ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলার সুলতানি ইমারতগুলোতে শিলালিপি সংযুক্ত ছিল। চতুর্দশ, পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে এটি উৎকর্ষ লাভ করে। তুগরা লিপিশৈলী বাংলার লিপিকারদের ( Calligraphers) বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এটি মধ্য এশিয়া দ্বারা প্রভাবিত ও মিশরের সঙ্গে সাদৃশ্য বহন করে। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের কারণে সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে এ দেশে আগত ও স্থায়ভিাবে বসবাসরত শিল্পীদের হাতেই সম্ভবত এগুলো সম্পাদন হয়েছে।
বাংলার সুলতানি আমলের স্থাপত্যে পৃথক একটি বৈশিষ্ট্যের ছাপ স্পষ্ট। এ সময়ে দেশীয় ও বহির্দেশীয় বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে একটি চমৎকার মিশ্রণ তৈরি হয়। বাংলার প্রাক-মুসলিম স্থাপত্য যদিও কোনোভাবে নিম্নমানের ছিল না, তবুও সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক হয় ও এ দেশে একটি নতুন রীতির প্রবর্তন হয়। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা হারানোর পর বাংলা দিল্লির একটি প্রদেশে পরিণত হয়। মোগল আমলের স্থাপত্যে এটি প্রতিফলিত হয়েছে। (২য় ও শেষ পর্ব)
লেখক : প্রত্নতত্ত্ববিদ, আর্ট হিস্টোরিয়ান ও গবেষক