ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রভাতী মকতব

বাঙালি মুসলমানের চেতনার বাতিঘর

দিদার শফিক
বাঙালি মুসলমানের চেতনার বাতিঘর

আবছা আলো-অন্ধকার। মৃদুমন্দ হিমেল বাতাসের ঝাপটা। গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির। পূবাকাশে পদ্মণ্ডলাল সূর্যের উঁকি। মসজিদ থেকে নামাজ শেষে দলে দলে ফিরছে মুসল্লিরা। লাঙল-জোয়াল কাঁধে হালের গরু হাঁকিয়ে কৃষক ছুটছে ফসলি জমিতে। আর কোমলমতি শিশু-কিশোররা অজু করে, টুপি পরে যাচ্ছে মহল্লার কাচারি ঘরের বা মসজিদের মকতবে। ওড়না মাথায় পড়তে বসা মেয়ে শিশুরা বাতাসে দোলা ফুলের মতো মাথা নাড়ছে আর মিষ্টি সুরে আলিফ, বা, তা, ছা পড়ছে। ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জনের মতো ম ম গন্ধে বাতাসে ভাসছে সুললিত কণ্ঠে কোরআন পাঠের মধুর ধ্বনি। দশক তিনেক আগেও এমন একটি পবিত্র ও প্রশান্তিময় চিত্র ছিল এ দেশে নিত্যদিনের। গাঁও-গ্রাম, শহর-বন্দর সর্বত্রই ছিল মকতব। ছিল আপেক্ষিক সমান গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। এ মকতব ভারত উপমহাদেশে এশীয় মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাঙালি মুসলমানের আত্মিক শক্তি, শুচিশুদ্ধতা ও শানিত চেতনার বাতিঘর।

মকতবের সময়

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গত পঞ্চাশ বছরের মকতব-শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ফজর নামাজের পর থেকে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময়ব্যাপী মকতব পরিচালিত হয়। মহল্লার মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন বিনা বেতনে মসজিদভিত্তিক এ মকতবগুলোতে পাঠদান করেন। মুসলমান ছেলেমেয়েরা মকতব থেকে ধর্মের মৌলিক বিষয়ে শিক্ষালাভ করে চরিত্র ও চেতনায় উৎকর্ষ সাধন করে। এ সময় পরিচালিত মকতবগুলোই আদর্শ মানব ও দীপ্ত চেতনার উন্নত জাতি গঠনে বেশ ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছে।

ভিন্ন সময়ে মকতব

শহুরে চাকরিজীবীদের সন্তানদের জন্য সরকারি কলোনিগুলোতে সুবিধা মতো জোহরের পর বা আসরের পর ঘণ্টাখানেকের মকতবের শিক্ষাব্যবস্থা আজ থেকে দুই-আড়াই যুগ আগ থেকে শুরু হয়েছে। দু’যুগ আগে অভিভাবকদের কাছে মকতবের শিক্ষার গুরুত্ব থাকলেও আজ ক্রমেই তা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া আজকাল গ্রামেও প্রায় অনেক জায়গায় বিকেলে মকতব চালু হয়েছে। বিকেলে বাচ্চাদের মন থাকে খেলাধুলায়। ফলে মসজিদভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ মকতবগুলো আবেদনহীন হয়ে পড়েছে।

গুরুত্বহীন মকতব

বিভিন্ন সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কিন্ডার গার্টেন, প্রাক-প্রাথমিক বিভিন্ন স্কুল খুব ভোরে ক্লাসটাইম চালু করাতে সকালে ফজরের পর পরিচালিত মকতবগুলো ধীরে ধীরে প্রাণ হারাতে শুরু করেছে। ১৯৯০ সাল এবং এর পরেও এক দশক পর্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস শুরু হতো সকাল ১০টায়। তখন কিন্ডারগার্টেনও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প হয়ে ওঠেনি। ফলে তখন মকতব ছিল পুরোদমে প্রাণবন্ত। যেই কিন্ডার গার্টেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প হতে শুরু করল এবং গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা শুরু হলো, তখন মকতবগুলো ধীরে ধীরে প্রাণহীনতার প্রতি এগুতে থাকে। এ ছাড়া মকতবের শিক্ষক ইমামণ্ডমুয়াজ্জিনকে যথাযথ সম্মান ও কদর না করায় এবং ছাত্র ও শিক্ষকের বিদ্যা দান ও গ্রহণ টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় নৈতিকতার শিক্ষাপদ্ধতি মকতবশিক্ষা শিথিল হয়ে পড়ে।

মকতবের শিক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা

মকতব থেকে একজন শিক্ষার্থী মুসলমান হিসেবে তার জরুরি আমল ও ইবাদত সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। নামাজ, রোজাসহ মৌলিক কিছু ইবাদত শেখে। পবিত্রতা ও চারিত্রিক শুচিশুদ্ধতার সবক লাভ করে। কোরআন পাঠ ও বিভিন্ন দোয়া-দরুদ শেখে। শিশু-কিশোররা কচিমনে ঈমানের বীজ বপন করে। তাই মকতব শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত