ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি

ইফতার মুসলমানদের নিজস্ব ইবাদত ও সংস্কৃতি হলেও কালক্রমে তা বাঙালি মুসলমান জাতির স্রষ্টা প্রেমে আনত মস্তক ও উৎসবমুখর আমেজের মিশ্রণে একটি নিজস্ব সংস্কৃতির রূপ ধারণ করেছে। বাঙালি ইফতারকে ইবাদত ও সংস্কৃতি হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করে থাকে। এ ইফতার উদযাপন পরিবেশ ও মহল ভেদে নানা ধরনের হয়ে থাকে। বাঙালি মুসলমানের ইফতারের এমন সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহসম্পাদক মুফতি দিদার শফিক
বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি

ইফতার বাঙালি মুসলমানদের ইবাদতের অংশ। সারাদিন রোজা রেখে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে খাবার খাওয়াকে রোজা ভাঙা বা ইফতার বলে। রমজানের রোজা মুসলমানের একটি মৌলিক ইবাদত ও ফরজ বিধান। প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নারী-পুরুষ দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টায় রত থাকে। সিয়াম এমন একটি ইবাদত, যা বান্দার মাঝে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা থাকলেই শুধু যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব। ইফতারের আগ মুহূর্তে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার ভয়-ভালোবাসার সুমধুর সম্পর্কের নিদর্শন ফুটে ওঠে। বান্দা সারাদিন কিছু না খেয়ে সামনে খাবার নিয়ে বসে থাকে, আর ইফতারের সময় হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

সামনে খাবার প্রস্তুত, পেটেও ক্ষুধার জ্বালা তীব্র, তবু বান্দা মুখে খাবার তুলে দেয় না। এ যে রবের প্রতি বান্দার ভয়, ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রতীক। ইফতার বান্দার এ চেতনাকে শানিত করে। ঠোঁটে-মুখে-হৃদয়ে আল্লাহ নামের জপকে স্বভাবে পরিণত করে। তাই ইফতার শুধু খাওয়ার আনন্দ নয়, তপ্ত হৃদয়ের শানিত চেতনাও।

পারিবারিক ইফতার

রমজানে প্রতিদিন বাঙালি মায়েরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রচলন অনুযায়ী ইফতারে নানা খাবার তৈরি করে থাকেন। সাধারণত বাঙালিরা বেগুনি, পিয়াজু, আলুর চপ, হালিম, ছোলা-মুড়ি, দই-চিড়া, শরবত, খেজুর, জিলাপি, বাহারি রুটি ও মৌসুমি নানা ফল দিয়ে ইফতার প্রস্তুত করে থাকে। ইফতারসামগ্রী প্রস্তুত হলে ইফতারের অন্তত দশ মিনিট আগে ইফতার সামনে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা খাবারের দস্তরখানে বসে। মনে মনে আল্লাহর নাম জপে। দোয়া পড়ে। ক্ষমা চায় আল্লাহর কাছে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করার মধ্য দিয়ে ইবাদত ও পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তাসুলভ এক অপার্থিব দৃশ্য ফুটে ওঠে।

মসজিদে মসজিদে ইফতার

শহর-বন্দর, গাঁও-গ্রাম সর্বত্রই মহল্লাবাসী প্রতিদিন মসজিদে ইফতারের আয়োজন করে। ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো মানবিক মহৎ কাজ। ধর্মের সূত্র মতে সওয়াবের কাজ। সাধারণত নিজ থেকেই মহল্লাবাসী কে কবে ইফতারের আয়োজন করবে, তা মসজিদ কমিটি বা ইমাম সাহেবকে জানিয়ে রাখা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাহারি ইফতার নিয়ে উপস্থিত হয় ইফতার আয়োজক। মসজিদের ইফতারে পথশিশু থেকে শুরু করে মুসল্লি ও সর্বসাধারণ অংশগ্রহণ করে। মসজিদে ইফতার আয়োজন করা হয় রোজাদারকে ইফতার করানোর সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে এবং সিয়াম সাধনার অন্যতম শিক্ষা ক্ষুধা তাড়িত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মাধ্যমে মানবিক গুণকে বিকশিত করার প্রয়াসে। প্রতি রমজানে বাঙালি মুসলমান অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ আয়োজন করে থাকে। মসজিদে লম্বা দস্তরখানে ইফতার সাজানো হয়। দস্তরখানের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে বসে মুসল্লিরা তৃপ্তিসহ ইফতার করে। মসজিদে থাকে ইফতারের এক নান্দনিক দৃশ্য।

রাজনৈতিক দলের ইফতার

বাংলাদেশে রমজান মাসজুড়েই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ইফতার ও রোজার আবেদনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এ ইফতার মাহফিলগুলোতে সরকারি দল, বিরোধী দল ও ভিন্নমতের নানান সংগঠন দেশের চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গঠনমূলক কথা বলে। রাষ্ট্রীয় উন্নতি-অবনতি, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগতি-অসংগতির আলোচনা-সমালোচনা এবং সমাজসেবামূলক কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রেরণা জোগাতে সাধারণত এ জাতীয় ইফতার মাহফিলগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের ইফতার মাহফিলে সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণির নেতৃবৃন্দ, সংবাদকর্মী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকেন। অনুষ্ঠান শেষে দেশ, জাতি, ধর্ম ও মানবতার কল্যাণ কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করা হয়।

মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় ইফতার

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ ধনী-নির্ধন সর্ব শ্রেণির মুসলমান রমজান মাসে সিয়াম সাধনার প্রেরণাকে বুকে ধারণ করে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। মাদ্রাসার নিষ্পাপ শিশু শিক্ষার্থী, হাফেজ-আলেম, বুজুর্গ ব্যক্তিদের নেক দোয়া কামনাই সাধারণত এ জাতীয় ইফতার আয়োজনের অভিষ্ট লক্ষ্য হয়ে থাকে। ইফতারের আগ মুহূর্তে মাদ্রাসার আমলি পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু শিক্ষার্থীদের এবং ধর্মপরায়ণ নেককার আলেমদের দোয়া-মোনাজাতে রবের কাছে বান্দার কান্নাভেজা কণ্ঠে আকুতির এক অনন্য দৃশ্য বিরাজ করে। মানবিক বাঙালিরা রমজান মাসে এতিমখানার শিশুদের সঙ্গে ইফতার করে মানসিক তৃপ্তি বোধ করেন। এতিমদের সঙ্গে ইফতার করা বহু বছর ধরে চলে আসা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ।

চলন্ত পথে ইফতার

কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে চলন্ত পথে গাড়ির যাত্রীদের ইফতারের ব্যবস্থা করতে কোথাও কোথাও দেখা যায়। ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে গাড়ি চলাচলের পথে যাত্রীদের মাঝে কোনো সংস্থার পক্ষে মাঝেমধ্যেই পিকআপে করে বিনামূল্যে ইফতার বিতরণ করা হয়। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবতার মিশ্রণে বাঙালির ইফতার হয়ে উঠেছে জাতিগত সংস্কৃতি ও মানবতার প্রতিবিম্ব।

ফুটপাতে ইফতার

দেশের প্রতিটি শহরে, রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ফুটপাতে থাকে বাস্তুহারা কিছু ভবঘুরে বা পথশিশু। যাদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। খাবার ব্যবস্থা নেই। মাটি বিছানা। আকাশ ছাদ। ঝড়ে-রোদে কোনো দেয়াল ঘেঁষে বসে বা দাঁড়িয়ে যারা কাটিয়ে দেয় দুর্যোগ মুহূর্ত। ওদের কেউ নেই পৃথিবীতে। মাঝেমধ্যে একমুঠো খাবার কেউ তাদের হাতে তুলে দিলে তারা ভাবে- এরা মানুষ নয়, ফেরেশতা। এ প্রান্তিক ও অসহায় গোষ্ঠীর ইফতার হয় কারও দেওয়া ইফতার দিয়ে অথবা সহজে লভ্য এক ঢোক পানি দিয়ে। এরা নিজেদের শরীর-কাপড় অতিরিক্ত ময়লা হওয়ার কারণে মসজিদেও যায় না; আবার ভোজনবিলাসী সভ্যশ্রেণির কাছেও হাত পাতে না।

পুরান ঢাকার ইফতার

বাংলাদেশে পুরান ঢাকার ইফতার বহুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ ইফতার। পুরান ঢাকার অধিবাসীরা মূলত মোগলদের বাহারি খাবারের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে বছরের পর বছর। তাদের ইফতার হয় সাধারণত নানা পদের। তাদের ইফতারসামগ্রীতে থাকে বড় বাপের পোলায় খায়, জালি কাবাব, সুতি কাবাব, চিকেন ফ্রাই, চিকেন স্টিক, শাহি জিলাপি, পেস্তা বাদামের শরবত, শাহি পরোটা, লাবাং, দইবড়া, কিমা পরোটা, ঘুগনি, ফালুদা, বেগুনি, আলুর চপসহ নানা স্বাদের বাহারি খাবার। ঢাকার চকবাজারে এসব খাবার পাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের ভোজনরসিক রোজাদাররা এসব ইফতারসামগ্রী কিনতে চকবাজারে নিত্যদিন ভিড় জমায়। বাংলাদেশের ইফতারের সঙ্গে ধর্ম, রাজনীতি, মানবতা ও মোগলদের খাদ্যসংশ্লিষ্ট স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত