পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্থ রুচিবোধের পরিচায়ক। উন্নত জাতি ও শালীন সভ্যতার প্রতীক। পরিচ্ছন্নতা ইসলামের এক অনন্য সভ্যতা। একজন মুসলমানের জীবনের পরতে পরতে পরিচ্ছন্নতা ও পরিশীলিত সভ্যতার রয়েছে ইতিবাচক প্রভাব। পরিচ্ছন্নতার গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে মহামানব রাসুল (সা.) পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ বলে অভিহিত করেছেন। নোংরা, ময়লা, কদর্যপনা কোনো সভ্য জাতির বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক
ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ বলে অভিহিত করে পরিচ্ছন্নতাকে অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে। কেননা, হাদিস শরিফে পবিত্রতা অবলম্বনকে ঈমানের অর্ধেক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে ইসলামের উন্নত রুচিবোধ ফুটে উঠেছে। আর পরিচ্ছন্নতা একটি শালীন সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। আবু মালেক আশআরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম : ৪২২)। ঈমান ছাড়া যেমন ইবাদত মূল্যহীন, তেমনি পরিচ্ছন্নতা ছাড়াও ইবাদত মূল্যহীন।
পবিত্রতা মোমিন জীবনের অংশ
ইসলাম চায় একজন মানুষ সর্বাবস্থায় পবিত্র থাকুক। এ জন্য মহান আল্লাহ মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পবিত্রতার সঙ্গে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। বীর্যপাত হওয়ার পর গোসল করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রস্রাব-পায়খানার পর অজু করার আদেশ দিয়েছেন। অজু-গোসলের জন্য পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মোমিনরা! যখন তোমরা নামাজের জন্য ওঠ, তখন মুখমণ্ডল ও হাতদ্বয় কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং পদযুগল টাখনুসহ ধৌত কর। যদি অপবিত্র হও, তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও। আর যদি তোমরা রুগ্ণ হও, সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ পেশাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও। অর্থাৎ স্বীয় মুখমণ্ডল ও হাতদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদের অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদের পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা মায়িদা : ৬)। দেহ পরিষ্কার থাকলে মন ভালো থাকে। আর মন ভালো থাকলে যে কোনো কাজে বা সভ্যতায় পরিচ্ছন্নতার ছাপ পড়ে; যা একটি রুচিশীল সভ্য জাতি গঠনে ফলপ্রসূ প্রভাব বিস্তার করে।
পরিচ্ছন্ন পরিবেশ
ইসলাম পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রতি জোর নির্দেশ দিয়েছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও আশপাশের পরিবেশ ও আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখা সুস্থ রুচির পরিচায়ক। সুস্থ রুচি ও মননের অধিকারী কোনো ব্যক্তি অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না। আল্লাহতায়ালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ভালোবাসেন। তাই মুসলমানরা আল্লাহর ভালোবাসায় সিক্ত হতে ভেতর থেকে তাড়িত চেতনায় নিজেদের ঘরবাড়ি, উঠান-আঙিনা ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা মুসলমানদের ইবাদতের পূর্বশর্ত। পরিচ্ছন্নতা মুসলিম সভ্যতার অন্যতম অংশ। মহানবী (সা.) ঘরবাড়ি ও আশপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সালেহ ইবনে আবু হাসসান (রহ.) বলেন, আমি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রহ.)-কে বলতে শুনেছি, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা পবিত্র এবং পবিত্রতা ভালোবাসেন। তিনি পরিচ্ছন্ন ও পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন। তিনি মহান ও দয়ালু, মহত্ত্ব ও দয়া ভালোবাসেন। তিনি দানশীল, দানশীলতাকে ভালোবাসেন। সুতরাং তোমরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকো। আমার মনে হয় তিনি বলেছেন, তোমাদের আশপাশের পরিবেশকেও পরিচ্ছন্ন রাখ এবং ইহুদিদের অনুকরণ করো না। সালেহ বলেন, আমি এ প্রসঙ্গে মুহাজির ইবনে মিসমারের কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি বলেন, আমির ইবনে সাদ তার পিতার সূত্রে নবীজি (সা.) হতে একই রকম হাদিস আমার কাছে বলেছেন যে, ‘তোমাদের আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখ।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)।
দেহজুড়ে শালীন সভ্যতা
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু স্বভাবজাত বিষয় রয়েছে। সেগুলোকে স্বভাবের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে সম্পন্ন করা হলে জীবন শালীন, পবিত্র ও সুশৃঙ্খল হয়। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দশটি কাজ স্বভাবজাত কর্মের অন্তর্ভুক্ত। তা হলো- মোচ খাটো করা, দাড়ি লম্বা করা, মেসওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে ঝাড়া, নখ কাটা, আঙুলের গিরাগুলো ধোয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের পশম মু-ন করা ও পানি দ্বারা ইস্তেঞ্জা করা।’ জাকারিয়া বলেন, হাদিসের বর্ণনাকারী মুসআব বলেন, দশমটির কথা আমি ভুলে গেছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। (মুসলিম : ৪৯২)। মোচ খাটো করা, নখ কাটা, নাভির নিচের পশম মু-ন করা ও বগলের পশম উপড়ে ফেলার মতো কাজগুলো সম্ভব হলে প্রতি সপ্তাহে একবার করা উত্তম, অন্যথায় পনেরো দিনে একবার করবে। তাও সম্ভব না হলে মাসে একবার করবে। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই যেন চল্লিশ দিন অতিবাহিত না হয়। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের জন্য গোঁফ ছাঁটা, নখ কাটা, নাভির নিম্নভাগের লোম চেঁছে ফেলার ও বগলের পশম উপড়ে ফেলার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আমরা যেন এ কাজগুলো চল্লিশ দিনের বেশি সময় পর্যন্ত ফেলে না রাখি। বর্ণনাকারী বলেন, আরেকবার চল্লিশ রাতের কথাও বলেছেন। (সুনানে নাসায়ি : ১৪)।
নির্দিষ্ট স্থানে মলমূত্র ত্যাগ
যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা অশালীনতা। এতে পরিবেশ দূষিত হয় ও রোগ-ব্যাধি সংক্রমিত হয়। তাই নির্ধারিত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করার প্রতি ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। মানুষের চলাচলের পথে ও বিশ্রামের স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করলে পরিবেশ দূষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অভিসম্পাত ও গালিগালাজের পাত্র হয়। এ জন্য নবীজি (সা.) মানুষের চলাচলের রাস্তায় ও গাছের ছায়াতলে, বিশ্রামস্থলে পেশাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অভিসম্পাতযোগ্য দুটি কাজ থেকে দূরে থাক।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘অভিসম্পাতযোগ্য সে কাজ দু’টি কী, ইয়া রাসুলাল্লাহ?’ তিনি বললেন, ‘মানুষের যাতায়াতের রাস্তায় অথবা তাদের বিশ্রাম নেওয়ার ছায়ায় পেশাব-পায়খানা করা।’ (মুসলিম : ৫০৬)।
জুমার দিনে গোসল করা
পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যারা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গোসল করে না। শরীরে ময়লা জমে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ইসলামে এ ধরনের কদর্যপনার স্থান নেই। শরীর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ইসলামে অজু-গোসলের বিধান আছে। জুমার দিন মুসলমানদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের মতো। এ দিনে মসজিদে মসজিদে বহু মানুষ জমায়েত হয় ও জুমার নামাজ আদায় করে। এ দিন যদি কোনো ব্যক্তি অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় মসজিদে গমন করে, তাহলে তার দ্বারা অন্য মানুষের কষ্ট হতে পারে। তার শরীরের দুর্গন্ধের কারণে অন্য মানুষের ইবাদতে বিঘ্নতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই ইসলাম প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদের জুমার দিনে গোসল করার নির্দেশ প্রদান করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ জুমার সালাতে এলে সে যেন গোসল করে।’ (বোখারি : ৮৭৭)। অন্য আরেকটি হাদিসে নবীজি (সা.) জুমার দিনে গোসল করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে একে ওয়াজিব বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের গোসল করা জরুরি।’ (বোখারি : ৮৫৮)।
মাসিককালীন স্বামী সহবাস নিষিদ্ধ
মেয়েদের মাসিকের রক্ত নোংরা ও অপবিত্র। মেয়েদের পিরিয়ডকালীন এ অবস্থাকে ইসলামে অপবিত্র অবস্থা বলে। এমন অশুচি অবস্থায় স্ত্রীলোকদের সঙ্গে সহবাস করতে ইসলাম বারণ করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে ঋতু সম্পর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র। কাজেই তোমরা ঋতু অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের হুকুম দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে, তাদের পছন্দ করেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)। ইসলামি সভ্যতা শুধু সভ্যতা নয়, ইবাদতও। তাই ইসলামি সভ্যতার চর্চা ও লালন দেহমনে প্রশান্তি এনে দেয়।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া
ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা