ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঙালির সাহরি সংস্কৃতি

দিদার শফিক
বাঙালির সাহরি সংস্কৃতি

রমজান সিয়াম সাধনার মাস। কু-রিপু দমন করে আত্মনিয়ন্ত্রিত শুদ্ধ বিমল জীবন গঠনের মাস। এ মাসে ইসলামের ফরজ বিধান রোজা পালনে বাঙালি মুসলমানের থাকে নানা আয়োজন। ইফতার, সাহরিতে অংশগ্রহণ ও নামাজে নিয়মতান্ত্রিকতা রমজানে বাঙালি মুসলমানের স্বভাবজাত ও রুটিনমাফিক কাজ। এ সময় দেখা যায় প্রত্যেক মুসলমান নিজেকে উত্তম আচরণ ও মানবিক গুণে বিকশিত করার এক পবিত্র অনুভূতি লালন করেন। ভালো কাজে একে অপরের সহযোগী হওয়ার আত্মপ্রেরণায় উজ্জীবিত হন। এ প্রেরণা থেকেই বাংলাদেশে রমজান মাসে শেষ রাতে সাহরির সময় অন্যরকম এক আবহ তৈরি হয়। মহল্লার অলিগলিতে চলে রোজাদার মুসল্লিদের জাগানোর মহড়া। মসজিদের মিনার থেকে ইমাম-মুয়াজ্জিনের দরদি কণ্ঠে ভেসে আসে সাহরির আহ্বান- ‘ঘুম থেকে জাগুন, সাহরি খান; রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন।’ এ আহ্বান পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে, কানে কানে। এক পড়শী অন্য প্রতিবেশীকে ডাকে। ঘুম থেকে জাগায়। বিশেষ করে, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক মহল্লায় তরুণ ও কিশোররা দলবেঁধে সুরেলা কণ্ঠে বাংলা ও উর্দু গজল গেয়ে রোজাদারদের জাগিয়ে তোলেন। বাংলাদেশে সাহরিতে ডাকাডাকির এ রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। সাহরি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে জাগাতে ডাকাডাকির সংস্কৃতি বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্যের অংশ। শতবর্ষ পুরনো এ ঐতিহ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসছে। ফলে সেহরির সময় বাসা-বাড়িতে উৎসবমুখর এক অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করে।

পুরান ঢাকায় সাহরির ডাক

মহল্লাবাসীকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লোকজ সংগীতের প্রচলন রয়েছে। এক সময় পুরান ঢাকায় কিশোররা দলবেঁধে বাংলা-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় সুর তুলে বলত- ‘আল্লাহ কে বান্দে কো হাম আয়ে জাগানে কো/হার দিল মে রমজান কী পয়গাম পৌঁছায়েঙ্গে হো/যায়েগি ইয়ে দুনিয়া রমজান মোবারক কি/আল্লাহ কী রহমত কি হাম তুফান উঠায়েঙ্গে/আরে আল্লাহর বান্দা যারা, রোজা রাখে তারা।’ পুরান ঢাকার লালবাগের শাহি মসজিদের মিনার থেকে এখনও ভোর রাতে বাংলা ও উর্দু মিশেলে সাহরির শুরু ও শেষ সময়ের ঘোষণা দেওয়া হয়।

চার দশক আগে সাহরির ডাক

আজ থেকে তিন-চার দশক আগে বাংলাদেশের প্রায় গ্রামে আজকের মতো উন্নত ব্যবস্থা ছিল না। তখনকার মুসলমান বাঙালিরা এখনকার সময়ের মানুষের মতো এত রাত জাগত না। সন্ধ্যার পর খাবার খেয়ে এশার নামাজের পর ঘুমিয়ে যেত।

সকালে ফজর পড়ে ফসলি জমিতে যেত। তাই তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই শেষ রাতে জাগতে পারত। কিন্তু সবার তো আর জাগার অভ্যাস ছিল না। তাই সবার জাগা নিশ্চিত করতে থানা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো মসজিদ বা প্রতিষ্ঠান থেকে তীব্র আওয়াজের হুইসেল বাজানো হতো। এ আওয়াজ পেয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগত। এ ছাড়া মফস্বল অঞ্চলে মুড়ির টিনখ্যাত টিনের পাত্রে কাঠির আঘাতে শব্দ করে বলত, ‘রোজাদার উঠুন। সাহরির সময় হয়েছে।’

মাইকের যুগে সাহরি

আজ থেকে চার দশক আগে প্রায় গ্রামের মসজিদ ছিল পাঞ্জেগানা। টিনের বা বাঁশের কিংবা শোলাকাঠির দোচালা ঘর আর মাদুরের মেঝে ছিল মসজিদের অবয়ব। মসজিদ জীর্ণশীর্ণ হলেও তখন মুসল্লিরা ছিল সাচ্চা ঈমানদার। তখন মাইকের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। মসজিদের বাইরে ইমাম সাহেব উচ্চ স্বরে আজান দিতেন। কালক্রমে মসজিদে মাইকের ব্যবহার ব্যাপক হয়। তখন থেকেই মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসত হুইসেলের শব্দ। যে শব্দ সাহরির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইমামের কণ্ঠে থেকে থেকে আসতে থাকে সতর্কতার আহ্বান। প্রযুক্তির উন্নতির আগে এভাবে সেহরিতে জাগানো হলেও বর্তমানে দলবেঁধে ডাকা ও কাসিদা গাওয়া অনেকাংশে কমে এসেছে। মাইকের আহ্বান এখনও প্রচলিত আছে। কিছু সময় পরপর ছোট্ট শব্দে সাহরির সময় মনে করিয়ে দিতে থাকেন ইমাম, মুয়াজ্জিন সাহেবরা। আধুনিক বিভিন্ন হামদণ্ডনাতে ও রমজানের বিশেষ নাশিদ বাজিয়েও রোজাদারদের সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়।

রেডিওতে সাহরি অনুষ্ঠান

গত বিশ বছর আগে ঘরে ঘরে রেডিও ছিল। সে সময় অনেকে রেডিওর আজান ও ঘোষণার মাধ্যমে সাহরি ও ইফতার সম্পন্ন করত। আজ থেকে দুই দশক আগে বাংলাদেশে সাহরির সময় রেডিওতে সাহরির অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। রোজা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আলোচনা করা হতো এসব অনুষ্ঠানে। রোজা রাখার শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বিভিন্ন উপকারিতার কথা উপস্থাপিত হতো। সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয় রেডিও আলোচক ছিলেন পুরান ঢাকার লালবাগ শাহি মসজিদের খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম। রেডিওতে সাহরির প্রায় প্রোগ্রাম তিনিই পরিচালনা করতেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শ্রোতাদের ঘুম থেকে জেগে সাহরি খাওয়ার আহ্বান করতেন। সাহরির শেষ মুহূর্তে রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ ও অত্যন্ত আবেগ ও আকুতি নিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে অর্থবহ মোনাজাত পরিচালনা করতেন বয়োবৃদ্ধ মাওলানা আমিনুল ইসলাম। বাঙালি মুসলিম ও বাংলাদেশি রোজাদার ভাইবোনদের হৃদয়ে সাহরির মুহূর্তে অনুষ্ঠিত সেই আবেগময় প্রাণবন্ত প্রোগামগুলো আজও স্মৃতি হয়ে আছে। সেহরি শুধু ইবাদতের অংশ নয়, বাঙালির সংস্কৃতিরও অংশ।

এলার্ম ঘড়ি ও মোবাইলের যুগে সাহরি

সময়ের ব্যবধানে ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এলার্ম ঘড়ি ও মোবাইল এলার্মের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে সাহরির জন্য ডেকে তোলার পদ্ধতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। তবে আজও অনেক মানুষ এখনও ডাকাডাকি ও মাইকের সতর্কবাণীর ওপর নির্ভরশীল। মনে রাখার বিষয়, এখনও মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ঘুমণ্ডজাগরণ, সচেতনতাণ্ডউদাসীনতার স্বাভাবিক প্রবণতাগুলো পুরোপুরি বদলে যায়নি। এখনও মানুষ বিস্মৃতি কিংবা বেখেয়ালিতে ভালো কাজ ছেড়ে দেয়। দেখাদেখি অথবা কারও ডাকে নেক কাজে জড়িত হওয়ার প্রবণতা আছে বাঙালি মুসলিম জাতির। তাই কানের পাশে মোবাইলের এলার্ম বাজলেও মাইকে ডাকাডাকির সংস্কৃতি সীমিত পরিসরে হলেও চালু থাকা উচিত। এতে করে পাড়া-মহল্লায় উৎসবের আমেজ বিরাজ থাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত