মুসলিম চেতনায় বদর দিবস
তাবাসসুম মাহমুদ
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
১৭ রমজান ঐতিহাসিক ‘বদর দিবস’। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অসামান্য। বদরের যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষার্থে, সত্যের পক্ষে, নিপীড়িতদের পক্ষে, মানবকল্যাণের নিমিত্তে। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফের শক্তিকে পরাজিত করে বিজয়ের সূচনা করেছিল। এ যুদ্ধে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়। এ জন্য এ যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী যুদ্ধ বলা হয়। কোরআনে এ দিনকে ‘ইয়াওমুল ফোরকান’ বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ এবং (বিশ্বাস কর বিজয় ঘটিত) সে বিষয়টির প্রতি, যা হক ও বাতিলের চূড়ান্ত মীমাংসার দিন, একে অপরের মুখোমুখি হওয়ার দিন আমার বান্দার ওপর নাজিল করেছিলাম, (তাহলে তোমরা জেনে রেখ) আল্লাহতায়ালা হচ্ছেন সব বিষয়ের ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সুরা আনফাল : ৪১)।
বদর যুদ্ধে আদর্শিক ও নৈতিক পার্থক্য হয়
বদর যুদ্ধে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে উভয়ের মধ্যকার আদর্শিক ও নৈতিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটি বাহিনী পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য এবং ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিছক আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক মানবজাতির সঠিক কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে প্রাণপণ সংগ্রামে নামে; অপর বাহিনী বিরাট বিরাট ভোজসভা, মদের আসর, গান-বাজনার জলসা ও নর্তকীদের নৃত্য ইত্যাদি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে আসে। আল্লাহতায়ালা সেই শক্তিশালী কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় দান করেন। বদরের সে দিনটিকে আল্লাহতায়ালা স্মরণীয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘বদরে (যুদ্ধে) আল্লাহতায়ালা তোমাদের বিজয় ও সাহায্য দান করেছিলেন; অথচ তোমরা কত দুর্বল ছিলে। অতএব, আল্লাহকে ভয় কর। আশা করা যায়, তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় করতে সক্ষম হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১২৩)।
আল্লাহর সাহায্য কামনা করা বদরের শিক্ষা
সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন। সুতরাং একইভাবে আজও তিনি মুসলমানদের সাহায্য করতে সক্ষম, যখন তাঁর ওপর ভরসা করে সততা ও ইখলাসসহ দ্বীনের পতাকা বুলন্দ করার লক্ষ্যে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে। বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, সবকিছুর জন্য সবার ওপর মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা। এ যুদ্ধ প্রমাণ করে, সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশি হওয়া বিজয়ের মাপকাঠি নয়; বরং মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ় ঈমান ও নির্ভরতা হলো বিজয়ের মূল হাতিয়ার। এ যুদ্ধ মুসলমানদের শিখিয়েছে জাগতিক সব প্রস্তুতির পরেও সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহর ওপর। তবেই মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে এবং বিজয় সম্ভব হবে।
দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখা
বদর যুদ্ধের পরও কাফেরদের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি; বরং অব্যাহত রয়েছে আজও। এমন একটি দিন কি আমরা অতিক্রম করছি, যে দিনটিতে অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমান প্রাণ হারায়নি? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। একজন ইরাকি বাবা তার সন্তানের লাশ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু আমার হাতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ভারত, মিয়ানমার, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, মিসর, সিরিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে অসংখ্য মুসলমান প্রাণ হারাচ্ছে। কেন এই দুরবস্থা? কেন আমাদের রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছে নিপীড়কগোষ্ঠী? মুুসলিম মিল্লাত কেন আজ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে? আসলে আমরা ইসলামের মূল থেকে আদর্শচ্যুত হয়ে গেছি। হৃদয় থেকে উঠে গেছে ঈমানের সঠিক স্পৃহা। আমরা ভুলে গেছি বদর প্রান্তরের শিক্ষা। মনে রাখতে হবে, কাফেরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের দ্বীন থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা চলতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা তো সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকবে; যাতে দ্বীন থেকে তোমাদের পিছিয়ে দিতে পারে, যদি সম্ভব হয়।’ (সুরা বাকারা : ২১৭)। এমতাবস্থায় মোমিনদের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ফেতনা-ফ্যাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।’ (সুরা আনফাল : ৩৯)।
ধৈর্য ও হেকমতসহ সহাবস্থান করা
বর্তমান বিশ্বে ইসলাবিদ্বেষীদের পক্ষ থেকে চলছে চূড়ান্ত জুলুমণ্ডনির্যাতন। আর মুসলমানরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নীরবে বসে আছে। তা মোটেও ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং উচিত, জুলুমের মোকাবিলায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি ধৈর্য, হেকমত অবলম্বনসহ ইসলামের সৌন্দর্যকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে সহাবস্থান করা। তাহলে প্রতিপক্ষ একসময় ইসলামের ছায়াতলে চলে আসবে, নতুবা পিছু হটতে বাধ্য হবে।
বদর যুদ্ধ থেকে শিক্ষা থাকবে সব যুগে
বদর যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন থাকবে সব যুগে। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার সংঘটিত বদর যুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সর্বশক্তিমান আল্লাহ অনুগত বান্দাদের সবসময় সাহায্য করেন এবং তিনি অহংকারীদের অহংকার চূর্ণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(লোকমান তার পুত্রকে সম্বোধন করে বলেছিল) হে বৎস! সালাত কায়েম করবে, সৎকর্মের আদেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে। এটাই দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা লোকমান : ১৭-১৮)।