ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উপেক্ষিত সাধনার সাতকাহন

মুসা আল হাফিজ
উপেক্ষিত সাধনার সাতকাহন

ইতিহাস-দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি, মধ্যযুগে এর কাঠামো গড়ে উঠেছিল। বর্বরতা, নৃশংসতা, পাশবিকতা ও নিশ্চিদ্র অজ্ঞতার অপর নাম যদি হয় মধ্যযুগ, সেটা পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য। পৃথিবীর প্রাচ্য অংশে তখন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ফকফকা রোদ। রসায়নশাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, বীজগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব ইত্যাদির মুক্তি ও বিকাশের বসন্তকাল ছিল তখন প্রাচ্যে। ইতিহাস-দর্শনও এ সময়েই প্রাণবন্ত হয় এবং উত্তরণ লাভ করে। এর আগে ইতিহাস ছিল ডানাবিহীন এক পাখি, আকাশ কাঁপানো শক্তিমত্তা সত্ত্বেও অবজ্ঞার মাটিতে সে মূকযন্ত্রণায় তড়পাচ্ছিল। পথের পাশে উপেক্ষিত ঝরা পাতার মতো তার প্রতি কেউই দৃষ্টি দিত না। পাতা কুড়ুনি কেউ যদি কুড়াতও, তা নিছক জ্বালানি হিসেবে। এমনটা ছিল বলেই ইতিহাস স্থান দিতে পারেনি সক্রেটিস, প্লেটো কিংবা পিথাগোরাসের সম্পূর্ণ জীবনকে তার বুকে। তাদের জীবনের সম্পূর্ণ চিত্র ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তার অসংশয় বাস্তবতা হারিয়ে গেছে জনশ্রুতি আর গ্রিক মিথোলজি বেলাভূমিতে।

ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে

আশ্চর্য! যে গ্রিক জাতি সভ্যতার শৌর্য ও দর্শনের গরিমায় ইতিহাসের উচ্চাসন দাবি করে, তারাই তাদের শ্রেষ্ঠ রত্ন ও গর্বের প্রধান অবলম্বন দার্শনিকদের জীবনীকে পারল না সবিস্তারে গ্রথিত করতে। পারল না রচনা করতে সমাজ-সভ্যতার যথার্থ ঐতিহাসিক আলেখ্য। এ কী সমাজ, মানুষ ও মনীষার প্রতি গুরুত্বহীনতা না ইচ্ছার অভাব? ঐতিহাসিক তথ্যমালা ও ইতিবৃত্ত আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারাবাহিক বিবরণ লিখতে হবে। মানুষ ও মনীষার জীবনচিত্র ধরে রাখতে হবে। এ প্রণোদনা কাউকে তাড়িত করেনি বলেই সেন্টপলের অনুসারীরা ঈসা মসিহ (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র হিসেবে চিনিয়ে দিল। কিন্তু ঈসা মসিহ (আ.)-এর জীবনের যাপনকে পারল না গ্রন্থিত করতে। তার দিনরাত্রিকে পারল না উপস্থাপন করতে। মূলত ঈসা মসিহ (আ.)-এর জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া সবকিছুই ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। বাইবেলে বর্ণিত কিছু ঘটনা ও উপদেশ ছাড়া তার অন্য কোনো শিক্ষার বিবরণ পাওয়া যায়নি। মানুষকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে তা থেকে।

উপেক্ষিত ইতিহাস ও তার কথকতা

বিশ্বাস, আবেগ ও সাংস্কৃতিক শৌর্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যখন এ অবস্থা, তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, সাধারণ মানুষ সমাজজীবন ও স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির বিবরণ গ্রন্থনের প্রতি কতটা উপেক্ষা ছিল। উপেক্ষা যদিও ছিল, কিন্তু তারপরও একটা ইতিহাস তৈরি হয়েই চলছিল। ক্লাসিক্যাল গ্রিক ও ল্যাতিন সাহিত্য তার নিজস্ব সূত্রের আওতায় ইতিহাসের শূন্য পৃষ্ঠায় অক্ষরের মাহফিল বসাচ্ছিল। ফলে মরুভূমিতে সহসা খুঁজে পাওয়া কূপের মতো কতক ঐতিহাসিকের দেখা পাই। হেরোডোটাস তাদের অগ্রগণ্য। তিনিই ইতিহাসের প্রথম প্রবক্তা। ভূগোল বিদ্যার প্রবক্তা যদি তাকে বলা হয়, মোটেও ভুল হবে না। আলেকজান্ডারের সমসাময়িক ছিলেন তিনি। তার হাতে লেখা হয় গ্রিক ও পারস্যের ইতিহাস। যদিও তিনি আরবকে মনে করতেন পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণ দেশ। কিন্তু তারপরও ইতিহাস ও ভূগোলে তিনি যে জ্ঞানসাধনার সড়ক নির্মাণ করেন, সেই সড়কেই দেখতে পাই ইরাটস্থেনিশ। (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৬-১৯৪) স্ট্রাবো (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩-২৪) এবং ডাইওডরাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৮০) প্লিসি (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৯-২৩) এবং খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে জসেফাস ক্লাভিয়াস ও দ্বিতীয় শতকে টলেমীর অভ্যুদয়। ইরাটস্থেনিশের কাছে পৃথিবীর পরিধি ছিল ২৬ হাজার মাইল, স্ট্রাবোর কাছে পৃথিবী বলতে ছিল আলেকজান্ডারের বিজিত অঞ্চল ও এর আশপাশ, ডাইওডরাস তার ইতিহাসগ্রন্থে আরবজাতির অস্তিত্বের কথাই শুধু শুনিয়েছেন, প্লিসির কাছে অজ্ঞাত ছিল পৃথিবীর বহু জাতির অস্তিত্ব, জসেফাস ক্লাভিয়াসের কাছে ইতিহাস মানে ছিল ইহুদিদের বৃত্তান্ত ও যুদ্ধকাহিনি।

ইতিহাসচর্চার ক্ষীণধারা যখন

থমকে দাঁড়াল

তাদের রচিত ইতিহাস ছিল অস্পষ্ট, আবছায়া। সর্বত্রই ছিল ঐন্দ্রজালিকতার জয়জয়কার। রাজরাজড়ার জীবনাচার ও তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ঘটনাপ্রবাহই ছিল সেই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে তারা রাজাদের দেবতা বানিয়েছেন এবং তাদের কাজকর্মে অলৌকিকতার ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। তাদের পছন্দের রাজা যিনি হতেন, তার জন্য বরাদ্দ হতো অধিকতর অলৌকিক লীলাখেলার পৃষ্ঠা। এসব লীলাখেলা ও অবিশ্বাস্য ঘটনার উৎপীড়নে ইতিহাসও হয়ে উঠেছিল দুর্ভিক্ষতাড়িত নিরন্ন চাষার বিধ্বস্ত চেহারা; যা শুধু সন্তাপ ছড়ায়, করুণার উদ্রেক করে। একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক আলেকজান্ডারের শাহি কীর্তির বর্ণনা থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২ অব্দে মিশনের উপকূলবর্তী শহর আলেকজান্দ্রিয়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামানুসারে নির্মিত এ শহর সম্পর্কে সেই সময়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বহুল উদ্ধৃত একটি বর্ণনা হচ্ছে, ‘শহর নির্মাণ শুরু হলে সামুদ্রিক দৈত্যরা বাধা দিল। সম্রাট তখন সিসা ও কাঠের তৈরি এক সিন্দুকে করে পাতালপুরীতে গমন করে দৈত্যদের প্রতিচ্ছবি নিয়ে এলেন। সে অনুযায়ী তাদের ধাতব প্রতিকৃতি গড়ে তুললেন। সম্রাট সেগুলোকে শহরের ঠিক মধ্যস্থলে পুঁতে রাখলেন। এরপর যখন দৈত্যরা আরেকবার হামলা করতে এলো, তারা দেখতে পেল নিজেদের লোকদের করুণ পরিণতি। ভয়ে তটস্থ হয়ে তারা পালিয়ে গেল।’ এসব অতিপ্রাকৃতিক বর্ণনা প্রদান ইতিহাসচর্চার ক্ষীণধারাও একসময় থমকে দাঁড়াল। জ্ঞানচর্চার প্রান্তরে নেমে এলো বিশাল নীরবতা। পাদরিতন্ত্রের জনক মহামতি পোপ গ্রেগরি অজ্ঞানতা ধ্যানের জনক তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থকেন্দ্রসমূহ ধ্বংসের অভিযান শুরু করলেন। ইউরোপে নিষিদ্ধ হলো জ্ঞানচর্চা। সেখানকার চিন্তানৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতি হয়ে উঠল বার্ট্রাড রাসেলের ভাষায় ‘সম্পূর্ণ আলোকবঞ্চিত ও বর্বরতাণ্ডআচ্ছন্ন।’

প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন খুঁজে ফেরা

এভাবেই চলতে থাকল। যতক্ষণ না হেরা পর্বতে প্রত্যাদেশ এলো ‘পাঠ করো রবের নামে।’ যতদিন না অতীতের জনগোষ্ঠীগুলোর বৃত্তান্ত অবগত হয়ে শিক্ষা গ্রহণের পয়গাম ঘোষিত হলো। যতদিন না ঘোষিত হলো দুনিয়া মন্থন করে জ্ঞান-তত্ত্ব অর্জনের মাধ্যমে অন্তর্চক্ষু উন্মোচনের আহ্বান। এরপর দেখা গেল ওহাব ইবনে মুনাব্বেহ (রা.) দক্ষিণ আরবের নাইতদুর্গে পরিত্যক্ত শিলালিপির পাঠোদ্ধারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। আবদুর রহমান (রা.) মিসরের গর্ভনর হয়েও হিসনে গোরারের ধ্বংসস্তূপ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন প্রাচীন শিলালিপির অনুসন্ধানে। কোরআনে বর্ণিত প্রাচীন সম্প্রদায়গুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারে জীবন কাটিয়ে দিলেন ইবনে হিশাম, কালবি, হামদানিরা। মুকাদ্দাসি, ইয়াকুবি, নুভাইরি, কাজবিনিরা মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করতে লাগলেন প্রত্নতাত্ত্বিক অজস্র নিদর্শন। যাদের আবিষ্কারের বিবরণ দিতে গিয়ে হামদানিকে আট খণ্ডে লিখতে হলো আল ইকলিল গ্রন্থ। এ পথ ধরে ইউরোপে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধিৎসা শুরু হলো ডি এইচ মুলার কর্তৃক আল ইকলিল গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশের অনেক পরে।

ইতিহাস সাধনায় আত্মনিয়োগের ধারা

অনেক পরেই ১৭৬১ সালে নেভুর আত্মনিয়োগ করলেন এ সাধনায়। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তিনি আরব ভ্রমণ করলেন। তারপর ১৮৮৭ সালে এলেন প্লেজার ও মেনজানি, তারা খনন করলেন ইয়েমেন এলাকা। ওয়েলস্টেড ও ডাউডি অনুসন্ধান করলেন গোটা মধ্য আরব। জসার্ড ইয়েমেনের গ্রন্থাগারসমূহে বছরের পর বছর অতিবাহিত করে অবশেষে প্রকাশ করলেন হেজাজের মানচিত্র। সিরিয়া, মিসর, পারস্য ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্ব সন্ধানীরা। তাদের কেউই রিক্তহস্তে ফেরেননি। প্রত্যেকের ঝুড়ি পরিপূর্ণ ছিল ঐতিহাসিক মণি-রত্নে। খুব সহজেই তারা সেগুলো পেয়ে যান সংগ্রহশালাসমূহে। তার চেয়েও অধিক সহজে সেগুলো পাঠিয়ে দেন বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস ও লন্ডনের মিউজিয়ামে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত