আব্বাসীয় খেলাফতকালে মুসলিমদের মাঝে গণিতশাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। এ খেলাফতকালেই গণিতশাস্ত্র বেশ সমৃদ্ধি লাভ করে। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ আব্বাসীয় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে আব্বাসীয় রাজবংশ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে থাকে। এ দীর্ঘ আব্বাসীয় শাসনামলে মুসলিম সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান দিক ও দিগন্ত উন্মোচিত হয়। শিক্ষাদীক্ষা ও সভ্যতায় সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বে মুসলমানরা এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন হয়। আব্বাসীয় শাসনামল ইতিহাসের এক বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল অধ্যায়। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা (শাসক) আল মানসুরের শাসনামল (৭৫৪-৭৭৫খ্রি.) থেকেই মূলত মুসলিমদের গণিত চর্চা শুরু হয়। তার শাসনামলেই আবু ইসহাক আল ফাজারি প্রথম গণিতশাস্ত্রের বিধিবদ্ধ চর্চা শুরু করেন। কালক্রমে ৩৫ জন আব্বাসীয় শাসক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য সার্বিক সহযোগিতা চলমান রাখায় তখন থেকেই গণিতের শাস্ত্রীয় বিকাশ ঘটতে থাকে। এ সময় মুসলিম বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞরা বীজগণিত, অ্যানালিটিক্যাল জ্যামিতি উদ্ভাবনসহ নতুন নতুন সূত্র ও ধারা আবিষ্কার করে গণিতশাস্ত্রকে সার্বিকভাবে এক পরিপূর্ণশাস্ত্রে পরিণত করে। গণিতশাস্ত্রকে পূর্ণতা দানে অনেক মুসলিম ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে দশজন মুসলিম গণিতজ্ঞের পরিচয় তুলে ধরা হলো-
১. আবু ইসহাক আলফাজারি
পূর্ণ নাম- আবু ইসহাক ইবরাহিম ইবনে হাবিব ইবনে সুলাইমান ইবনে সামুরা ইবনে জুন্দুব আল ফাজারি। ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র ও দিনপঞ্জি নিরূপন করার পদ্ধতি সম্পর্কিত তার রচিত গ্রন্থগুলো ছিল কালের সেরাগ্রন্থ। তিনি সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্রের উচ্চতা নির্নয় করার যন্ত্র Astrolabe তৈরি করেন। এছাড়া তিনি গণিতশাস্ত্রেরে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন। আরবীয় বর্ষগণনা ও দিনপঞ্জি প্রণয়ন করে তিনিই প্রথম আরবি গণনাপদ্ধতিকে সুনিয়ন্ত্রিত করেন। তিনি ৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
২. আবু আব্দুল্লাহ আল ফাজারি
তিনি আবু ইসহাক আল ফারাজির ছেলে। আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে হাবিব আল ফাজারি তার পূর্ণ নাম। ৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার উৎসাহে তিনি ভারতীয় সিন্দহিন্দ নামক গ্রন্থের অনুবাদ করেন। এর মাধ্যমে ভারতীয় গণিতবিদদের সঙ্গে মুসলিম গণিতবিদদের পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটে। আবু আবদুল্লাহর অনুবাদকৃত এ গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে আল-খাওয়ারিজমি জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক বিখ্যাত তালিকা ফিজিজ বা Astronomical Table রচনা করেন। তিনি ৭৯৬-৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইন্তেকাল করেন।
৩. আল রাযি
তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি তিনি গণিতশাস্ত্রেও বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি জ্যামিতি বিষয়ে কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। ‘মিজান তাবিই’ তার রচিত জ্যামিতিবিষয়ক একটি গ্রন্থের নাম।
৪.আল বাত্তানী
খ্রিষ্টীয় দশম শতকের অন্যতম মুসলিম গণিতবিদ তিনি। তিনি আবু আল বাত্তানী আস সাবি নামে পরিচিত। তিনি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ফিজিজ প্রণয়ন করেন। জ্যোতিরর্বিজ্ঞান তালিকা, সৌর আয়নমণ্ডলীর গতি, চান্দ্রমাসের সঠিক গণনা, নক্ষত্র ও গ্রীষ্মমণ্ডল সংক্রান্ত বছরের দৈর্ঘ্য, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, ঋতুর সঠিক সময় নির্ণয় ইত্যাদি নানান বিষয়ে তিনিই মৌলিক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন।
ত্রিকোণমিতির স্বাতন্ত্র তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। তিনি গণিতবিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে তার রচিত চারটি গ্রন্থ এখনো পাওয়া যায়। তার গ্রন্থগুলো হলো- কিতাবু মারিফাতি মাতালি আল বুরুজ ফি মা বাইনা আবরা আল ফালাক, আর রিসালাহ ফি তাহকিক আকদার আল ইল্লিসালাত, শরাহ আল মাকালাত আল আরবা লি বাতমিয়াস এবং আজজিজ । তিনি ৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
৫. আবুল ওয়াফা
দশম শতাব্দীতে আল বাত্তানীর পরে গণিতশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য সবচেয়ে সুপরিচিত গণিতবিদ হলেন আবুল ওয়াফা। ত্রিকোণমিতিতে তিনি আল বাত্তানির যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। বাত্তানীর আবিষ্কৃত ত্রিকোণমিতি আবুল ওয়াফার হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তিনি ত্রিকোনমিতির নতুন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ত্রিকোনমিতির প্রচলিত ছয়টি সংজ্ঞার পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে তিনিই প্রবর্তন করেন। এছাড়া তিনি ইউক্লিড, ডাওফন্টের জ্যামিতি এবং খাওয়ারিজমির জ্যামিতি ও বীজগণিতের ভাষ্য প্রণয়ন করেন। তার রচিত কিছু গ্রন্থ হলো- কিতাবুল হান্দাসা, মানাজিল ফিল হিসাব, কিতাবুল মাদখিল ইত্যাদি।
৬. ইবনে সিনা
৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বোখারার অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার এক গ্রামে তার জন্ম হয়েছিল, যা বর্তমানে উজবেকিস্তানে অবস্থিত। ইবনে সিনা ১০ বছর বয়সে পবিত্র কোরআনের হাফেজ হন।
তাকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয় । তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়াও জ্যামিতি, বীজগণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বলা হয়, তিনি সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তার জ্যামিতিবিষয়ক আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো ইউক্লিডের জ্যামিতির অনুবাদ। ইবনে সিনার সময়ে ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন মাহমুদ মসসাহ। তিনি তার কাছে গণিত শাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করেন। তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- আল কানুন ফিত তিব্বি (১-৫খণ্ড), কিতাব আল শিফা (২০খণ্ড), শ্রেষ্ঠগ্রন্থ কিতাব আল ইশারাত। ধারণা করা হয়, তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক ১৫০টি ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক ৪০টি রচনাসহ তার মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায়। তিনি কাকুঈ সাম্রাজ্য হামাদানে (বর্তমানে ইরান) ২২ জুন ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ৫৬ বা ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
৭. আল বেরুনি
তার পূর্ণ নাম আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনি। তিনি খোয়ারিজম (বর্তমানে উজবেকিস্তান) অঞ্চলে আনুমানিক ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। আশআরি মতবাদ ছিল তার ধর্মবিশ্বাস। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং বহুবিদ্যাবিশারদ। আল বেরুনি একাধারে গণিত, জ্যোতিপদার্থবিদ, রসায়ন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ‘The Formula of Interpolation’ সূক্ষ্ম ও শুদ্ধ গণনার এটি একটি বিস্ময়কর পথ। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা একে নিউটনের আবিষ্কার বলে প্রচার করে। অথচ নিউটনের জন্মের ৫৯২ বছর আগে আল বেরুনি এটি আবিষ্কার করেছেন। গণিতশাস্ত্রে আল বেরুনির অন্যতম অবদান হলো তার রচিত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাহফিম’। এতে জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে ব্যবহৃত এস্ট্রোল্যাব ও সমসাময়িক ভূগোল ও তারিখ গণনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর তার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হলো কানুনে মাসউদি শীর্ষক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিশ্বকোষ। এতে জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণমিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থের একটি তত্ত্বে তিনি প্রমাণ করেছেন, পৃথিবী নিজ অক্ষরেখার ওপর ঘুরছে।
তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৮০টি। তিনি ১০৪৮ মতান্তরে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
৮.হাসান ইবনে হাইসাম
হাসান ইবনে হাইসাম একজন মুসলিম আলোক বিজ্ঞানী। ৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম ক্যামেরার লেন্স আবিষ্কার করেন। আর তিনিই সর্বপ্রথম আলোক বিজ্ঞানের ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল মানাজির’ (Book of optics)। ১২৭০ সালে পোলিশ পদার্থ বিজ্ঞানী উইটেলো এ গ্রন্থটিকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে। বইটি সাত খণ্ডে বিভক্ত। পাশ্চাত্যের অনেক বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক কাজের ভিত্তি হলো এ গ্রন্থটি। বুক অব অপটিকস চশমা, ক্যামেরা, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ, রেটিনার অস্ত্রোপচার এবং রোবটিক দৃষ্টিশক্তির মতো পশ্চিমা প্রযুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। গণিত শাস্ত্রে তার ৬৭টি গ্রন্থের কথা জানা যায়। এর মধ্যে জ্যামিতিবিষয়ক গ্রন্থই ২৬টি। তিনি ১০৩৯ বা ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
৯. উমর খৈয়াম
তার পূর্ণ নাম হলো- উমর ইবনে ইবরাহিম আল খৈয়াম। তিনি গণিত শাস্ত্রে অনবদ্য অবদান রাখেন। উমর খৈয়ামের সর্বাধিক অবদান হলো এলজেবরা বা বীজগণিত। তিনি সর্বপ্রথম এলজেবরার সমীকরণগুলোর শ্রেণি বিন্যাসের উদ্যোগ নেন। জ্যামিতিক সমস্যার সমাধানে বীজগণিত এবং বীজগাণিতিক সমস্যার সমাধানে জ্যামিতি ব্যবহারের বিষ্ময়কর পদ্ধতি তার আবিষ্কার। বীজগণিতের ওপর রচিত তার গ্রন্থের নাম ‘ফি আল জাবের’। ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ শীর্ষক বীজগাণিতিক প্রক্রিয়ার উদ্ভাবক তিনি। তবে ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’-এর আবিষ্কারক হিসেবে বিজ্ঞানী নিউটন প্রসিদ্ধ। অথচ নিউটনের আবির্ভাবের কয়েক শতাব্দী আগে উমর খৈয়াম তা আবিষ্কার সম্পন্ন করেন। তিনি ১১২৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১০. নাসিরুদ্দিন তুসি
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলিম গণিতবিদ নাসিরুদ্দিন তুসি। ত্রিকোণমিতিকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ত্রিকোণমিতিকে পৃথক করেন। এ বিষয়ে তার রচিত গ্রন্থের নাম কিতাবু শাকলোল কাত্তার। গণিত বিষয়ে তার বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ হলো, কিতাবুল হান্দাসা, জামিউল হিসাব বিত তাখতো ওয়াত্তুরাব। তাহরিরুল উসুল ইত্যাদি।