শরীয়তপুরের নাগেরপাড়ায় জিনের মসজিদ ধ্বংসের পথে
দীদার মাহদী
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মহান আল্লাহর অপার সৃষ্টি রহস্যের অন্যতম বিস্ময় জিন জাতি। জিন শব্দের অর্থ গোপন, গোপনীয়, গুপ্ত। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত ‘জিনের অস্তিত্ব’ অস্বীকার করা ঈমানের পরিপন্থি। পবিত্র কোরআনে এসেছে ‘আমি (আল্লাহ) জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধু আমারই ইবাদত করার জন্য।’ (সুরা : জারিয়াত : ৫৬)।
কোরআনের একটি সুরার নাম ‘জিন’। পবিত্র কাবাঘরের অদূরে অবস্থিত ‘মসজিদে জিন’, এখানেই জিনরা প্রিয় নবী (সা.)-এর কণ্ঠে পবিত্র কোরআন শুনে তাঁর প্রতি ঈমান আনে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘অতঃপর তারা (নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল) আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শুনেছি, যা সঠিক ও নির্ভুল পথ প্রদর্শন করে। তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি।’ (সুরা জিন : ১-২)।
পবিত্র মদিনার পার্শ্ববর্তী ‘ওয়াদিউল জিন’ নামক স্থানেও প্রিয় নবী (সা.) জিনদের ঈমান-ইসলামের পথে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সুলাইমান (আ.) জীনদের সাহায্যে মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেছিলেন।
বাংলাদেশেও কিংবদন্তি ও লোকায়ত ভাবনায় জিন মসজিদের সন্ধান মেলে। যদিও এর সত্যতা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
শুনে অবাকই হওয়ার মতো অবস্থা। জিনের মসজিদ। জিনের তৈরি মসজিদ বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাই যে কেউ শুনলে তা দেখতে আসে। আর এই লোকশ্রুতির জিনের মসজিদটি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের শিবপুরের তালুকদার বাড়িতে অবস্থিত।
এ মসজিদ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় একজন প্রবীণ জানান, এটা মূলত মোগল আমলের তৈরি মসজিদ। বহু পুরোনো এবং ব্যতিক্রমী হওয়ায় মানুষ একে জিনের তৈরি মসজিদ মনে করে। কাছাকাছি এমন কোনো নির্মাণশৈলী নেই। তাছাড়া বহু গল্পও তৈরি হয়েছে এই মসজিদকে ঘিরে। যার ফলে ধীরে ধীরে জিনের মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে মসজিদটি।
মোগল স্থাপত্য পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্য। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা মোগল আমলের মসজিদগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে জীনের মসজিদ খ্যাত এই মসজিদটি মোগল স্থাপত্যই মনে হবে। কোনো নামফলক না থাকায় এর স্থাপন সাল জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, এটি চার থেকে সাড়ে চারশত বছর পুরোনো হবে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ কাঠা জমির ওপর স্থাপিত চতুর্ভুজ আকৃতির মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের ভেতরে তিনটি কাতার বা সারি রয়েছে। প্রতি কাতারে ১০ জন করে মোট ৩০ জন মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদের সামনে সাড়ে চারশত বছরের পুরোনো একটি পাকা মাঠ রয়েছে। মুসল্লিসংখ্যা কাতারের ধারণ ক্ষমতার বেশি হলে মাঠটিতে নামাজ পড়েন অনেকে। মসজিদের আঙিনাঘেঁষা একটি পুকুর আছে। মুসল্লিদের অজুর জন্য এতে একটি সান বাঁধানো ঘাট রয়েছে।
জনশ্রুতি আছে, মসজিদটির জায়গায় পানি ছিল। এক রাতে রাতারাতি জিনেরা মাটি ভরাট করে তৈরি করে এই নান্দনিক মসজিদটি। নির্মাণকাজ তখনও শেষ হয়নি। ভোররাতের দিকে এক ব্যক্তি ওদিকে মাছ ধরার জন্য এলে জিনেরা কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যায়। তাই কিছু নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রয়ে যায়।
জিনের মসজিদে নামাজ পড়তে ভয় করে না? এমন প্রশ্নে একজন মুসল্লি বলেন, শুনেছি মসজিদটি নির্মাণের পর প্রায় পঞ্চাশ বছর কেউ নামাজে আসেনি। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মসজিদের আশপাশ আবাদ হয়। এর পর নামাজ চালু হয়। কিন্তু তখনও মসজিদের আশপাশে অপরিচিত কণ্ঠ শোনা যেত। অচেনা লোকদের যাতায়াতও ছিল। জিনকে নামাজ পড়তেও দেখেছে অনেকে। তবে এখন আর এরকম কিছু দেখা যায় না। তাই এখন আর ডরভয় করে না। আমরা স্বাভাবিকভাবে নির্ভয়ে নামাজ পড়ছি।
প্রচণ্ড গরমেও মসজিদটির ভেতরে বেশ ঠান্ডা। মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, শীতের সময় মসজিদের ভেতরে উষ্ণতা অনুভব হয়। ঠিক যেন নাতিশীতোষ্ণ।
কালপরিক্রমায় কয়েকশ’ বছরের পুরোনো মসজিদটির ডিজাইন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে নান্দনিক সৌন্দর্য ম্লান হওয়ার পথে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কোনো উদ্যোগ নিলে ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে আরও কয়েকশ’ বছর টিকে থাকত।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, দারুলহুদা মডেল মাদ্রাসা, কোদালপুর