ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চীনে সাহাবিদের আগমন

মুসা আল হাফিজ
চীনে সাহাবিদের আগমন

নবীযুগে চীনে সাহাবাদের গমন নিছক কিংবদন্তি হলেও বিবিধ সূত্রে সাহাবাযুগে গমনের ধূসর উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে ওসমান (রা.) এর পক্ষ থেকে চীনে প্রতিনিধি প্রেরণের বর্ণনাটি অন্যতম। আবদুল ফজল ইজ্জতি তার The Spread of Islam গ্রন্থে উল্লেখ করেন, চীনের সঙ্গে ইসলামের পরিচয় ঘটে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে। তখন সাদ ইবনে ওয়াক্কাস সম্রাট গাওজংয়ের কাছে এসেছিলেন খলিফা উসমান (রা.)-এর দূত হিসেবে। কোনো কোনো সূত্র দাবি করে চীনে এসেছিলেন আবু ওক্কাস মালিক ইবনে ওহাইব (রা.) তিনি রাসুল (সা.)-এর মামা ছিলেন। তিনি সা’দ বিন আবু ওক্কাসের পিতা আবু ওক্কাস। চীনা লেখক চ্যাংশন লংয়ের মতে এই সাহাবির নাম ইবনে হামজা। চীনা লেখক বদর উদ্দীন এর মতে সাহাবির নাম হলো সাদ ওক্কাল এবং হামেদ বদায়ুনীর সফরনামায় নামটি লিখিত হয়েছে আবদুর রহমান ওকাজ বা ওক্কাজ, চীনে মসজিদের ফলকে এ নামই পাঠ করেছেন হামিদ। বস্তুত ওক্কাসকে তিনি ভুল করে ওকাজ বা ওক্কাজ লিখে থাকবেন। চীনা কিংবদন্তির সূত্রে মুহাম্মদ জায়তুন তার আস স্বীন ওয়াল আরব গ্রন্থে লেখেন, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) তিন সঙ্গী নিয়ে চীনে আসেন। আরব সূত্রে যাদের নাম পাওয়া যায় না।

চীনারা সাদকে ওয়াক্কাস বাবা বা প্রথম বাবা বলে অভিহিত করত। তার অন্য তিন সঙ্গীকে দ্বিতীয় বাবা, তৃতীয় বাবা ও চতুর্থ বাবা বলে অভিহিত করত। চীনের ইতিহাসে এই দলকে হুই হুই বলে অভিহিত করা হয়। তারা বসবাস করতেন ক্যান্টনে।

চীনের পুরোনো রেকর্ডপত্রে ওই সব আরবের অবস্থান জানা যায়, যারা আরব পয়গম্বরের পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামের সঙ্গে চীনের সম্পর্কবিষয়ক প্রাথমিক চীনা উৎসগুলো আরব সূত্রগুলোর সঙ্গে খুব কমই সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে কাজ করেছে নানা কিংবদন্তি, যা ধারাবাহিকভাবে নানা গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ঐতিহাসিক Liu Sanjie (আনুমানিক ১৬৩০-১৭১০) তার Huihui Yuanlai বা The Origins of Muslims গ্রন্থে দাবি করেন মহানবী (সা.) এর সঙ্গে চীনা শাসকের সরাসরি সম্পর্কের কথা। কিংবদন্তিকে অবলম্বন করে তিনি জানান, তাং রাজবংশের সম্রাট তাইজং (৫৯৮-৬৪৯) মহানবী (সা.) এর সমীপে একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। কারণ তিনি অনুসন্ধানের মাধ্যমে মহানবী (সা.) এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছিলেন। অনুসন্ধান শুরু হয় একটি স্বপ্নের ফলে। তিনি দেখেন, তার সোনার প্রাসাদের ছাদ ভেঙে পড়েছে। তিনি বিধ্বস্ত হতে যাচ্ছিলেন। তাকে রক্ষা করেন সবুজ পোশাক ও পাগড়ি পরা ডাগর চোখবিশিষ্ট অনুপম এক মানুষ। কিংবা স্বপ্নে রাজাকে একটি হিংস্র শিকারি প্রাণী আক্রমণ করল। তখন পাগড়ি পরা মহান মানুষ একাই তাকে রক্ষা করলেন। মন্ত্রীদের কাছে তিনি স্বপ্নটি ব্যক্ত করেন এবং জানতে চান, কে হতে পারেন সেই মহামানব? তারা জানালেন তিনি হতে পারেন আরবের নবী। এর পর সম্রাট অধিকতর অবগতি অর্জন করে নবীজির সমীপে একটি মিশন পাঠান। সময় তখন নবম হিজরি। প্রতিনিধি দল মহানবীকে আমন্ত্রণ করেন চীনে সফরের জন্য। কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নিজের জনকয়েক সাহাবিকে তিনি চীনে প্রেরণ করেন। হান লেখকরা তাদের কিতাবগুলোতে প্রথম দিকের মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে চীনের সংযুক্তিকে গৌরব দিতে চেয়েছেন গল্পটির আশ্রয়ে। এর মাধ্যমে শেষ অবধি চীনা সভ্যতার গুরুত্বকে নির্দেশ করতে চেয়েছেন তারা।

চীনে ইসলামের প্রাথমিক আগমনের প্রশ্নে চীনা বক্তব্য নিজস্ব একটি খাতে প্রবাহিত। এমনকি চীনের প্রতিনিধি দল নবীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। তিনি সাহাবিদের পাঠালেন। কিন্তু কোনো আরব বিবরণীতে এর সমর্থন নেই। যদিও মহানবী (সা.) এর সমীপে যত অঞ্চল ও গোত্রের যত প্রতিনিধি দল আগমন করেছেন, সবার বিবরণী সিরাত, মাগাযি ও হাদিসের গ্রন্থাবলি সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু চীনা সূত্রগুলো ইসলামের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে নিজের মতো করে বলে যাচ্ছে। ইসলামের প্রাথমিক ও পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিক সূত্রগুলো কী বলছে, সেদিকে খুব একটা তাকানোর দরকার নেই! এর মানে এই নয় যে, চীনা বিবরণীগুলোকে আমরা মূল্য দেব না, বরং এসব বিবরণী নিজস্ব মেজাজে অনমনীয় এবং অন্যান্য আকর ভাষ্যের প্রতি বেখেয়াল!

Liu Sanjie লিখেন, প্রতিনিধি দলের এক সদস্য নবীজির এক প্রতিচিত্র অঙ্কন করেন। সম্রাট এই প্রতিচিত্রকে আদালতে ঝুলিয়ে রাখতেন। পরবর্তী সময়ে যখন ইসলামের শিক্ষা প্রচারের জন্য প্রতিনিধি দলসহ সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) চীনে এলেন, তখন এই প্রতিচিত্র তার চোখে পড়ল। তিনি জানালেন, এটি মহানবীর শিক্ষার পরিপন্থি। সম্রাট তখন প্রতিচিত্র ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে মহানবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

আরব কোনো ঐতিহাসিক এমন বর্ণনাকে উল্লেখ না করলেও সুলায়মান আত তাজিরের ভ্রমণ বিবরণীতে এর ইশারা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক মাসউদি তার বিখ্যাত মুরুজুয জাহাব গ্রন্থে একে উল্লেখ করেছেন। মাসউদি লেখেন ইবনে ওয়াহাব আল কুরাশি ২৫৭ হিজরিতে বাণিজ্যের জন্য যখন চীনে গেলেন, তখন তিনি সেই প্রতিকৃতি দেখার সুযোগ পান। নাছোড় অনুরোধে রাজা তাকে সেই সুযোগ দিয়েছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন সম্মানিত এবং নবীর বংশধর। রাজা তাকে দেখান অঙ্কনকারীর কল্পিত সেই ছবি, যাতে দেখানো হয়েছে মহানবী (সা.) উটে আরোহণরত। অনুসারীরা তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। রাজার কাছে ছিল আরও বহু কল্পিত ছবি; আদম, নুহ, ইবরাহিম, মুসা এবং ইসা (আ.)-এর। এ বর্ণনা প্রমাণ করে না যে, মহানবী (সা.)-এর প্রকৃত ছবি ছিল সেটা। কিংবা চীনা প্রতিনিধি ঠিকই মহানবী (সা.) এর ছবি এঁকেছিলেন কিংবা সেটা রাজার সংরক্ষণে ছিল। বরং চীনা রাজার কাছে এসব কল্পিত ছবি খ্রিষ্টানদের মাধ্যমে পৌঁছে থাকবে। তারা নবীদের ছবি অঙ্কন পছন্দ করে। নিজেদের বিশিষ্ট মঠগুলোতে এমন ছবি তারা অঙ্কন করে রাখত। যুবায়ের ইবনে মুতইম সিরিয়ার একটি মঠে দেখেছিলেন অন্যান্য নবীদের নামে চিহ্নিত ছবির পাশাপাশি মহানবীর নামেও অঙ্কিত ছবি তাতে রাখা হয়েছে।

সাদ (রা.) এর বক্তব্যে সম্রাটের আদালতে প্রদর্শিত মহানবী (সা.)-এর ছবিকে মুছে ফেলার তথ্য একদিকে, অপরদিকে ওহাব আল কুরাশির দেখা ছবি। উভয়টি দুই চিত্ররূপ হতে পারে। চীনা রাজত্ব শ্রদ্ধার জায়গা থেকে নিজেদের অঙ্কিত ছবি আদালত থেকে মুছে ফেলছে। আবার নিজেদের সংগ্রহের সমৃদ্ধিকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যেতে অন্যের অঙ্কিত একই ব্যক্তিত্বের কল্পিত ছবি সংরক্ষণ করছে বিচারশালায়। মহানবীর শিক্ষার প্রাখর্য তখন দুই শতাব্দীর

পথ পেরিয়েছে। মুসলিমদের নানা অংশের জীবনেও বহু মলিনতা, বহু বিকৃতি বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু মুসলিম সভ্যতা তখন পৃথিবীর চালক সভ্যতা। তাকে চীন তখন নিজস্ব উপায়ে অধ্যয়ন করছে।

ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের প্রাথমিক যুগে সম্রাট তাইজং ক্যান্টন শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যাকে তিনি খুয়াই চেং নামে অভিহিত করেন, যার অর্থ হলো প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা। আরবিতে এর নাম ছিল শওকুন নবী বা নবীর অভিপ্রায়। স্থানীয়রা একে খানফুহ বলে অভিহিত করতেন।

চীনা লোকশ্রুতি হলো, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ক্যান্টনেই মৃত্যুবরণ করেন। দস্যুর আক্রমণে দলবলসহ তিনি শহীদ হন। চীনা জনগণ এ জন্য খুবই শোকাহত হয় এবং তাঁদের স্মৃতিরক্ষায় যত্নশীল হয়। তার মাজার রয়েছে চীনের ক্যান্টনে। আরবি ও ম্যান্ডারিন ভাষায় সেখানে লেখা আছে রওজাতু আবি ওয়াক্কাস বা আবু ওয়াক্কাসের কবরস্থান। ক্যান্টনের ঐতিহাসিক মসজিদকেও আবু ওয়াক্কাস (রা.)-এর স্মৃতির সঙ্গে একাকার মনে করা হয়। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মার্বেল ফলক। লেখা আছে- এটি চীনের প্রথম মসজিদ, যা আমাদের সর্দার ওয়াক্কাস তৈরি করেছিলেন। আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন, তিনি আল্লাহর রাসুলের আদেশে ইসলাম শেখানোর জন্য এখানে প্রবেশ করেছিলেন। ফলকটিতে কোনো সন-তারিখের উল্লেখ নেই। তবে সাধারণভাবে দাবি করা হয় যে, ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল এ মসজিদের নির্মাণকাজ।

তবে এ কবর কি আসলেই সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের (রা.)? মসজিদ কি আসলেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত? সাম্প্রতিক গবেষণায় বারবার প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে। আরব

ঐতিহাসিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে লেখেন, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের (রা.) ইন্তেকাল হয় মদিনায়, তাঁর কবরস্থান রয়েছে জান্নাতুল বাকিতে। তাহলে ক্যান্টনে কবরটি আসলে কার? চীনা গবেষক, ওং লিংগুই তার দ্য কমপ্লিট স্টোরি অব ইসলাম ইন চায়না গ্রন্থে দেখান, আধুনিক চীনে মুসলিমদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে এ বিষয়ক বয়ানেও ভিন্নতা এসেছে।

চীনের অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিত এখন মনে করেন যে, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস নামে অন্য একজন ব্যক্তি চীনে ইসলামের প্রসারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যখন চীনারা তাকে সম্মান জানাতে চেয়েছিল, তখন তারা মহান সাহাবির নামের সঙ্গে তার মিল লক্ষ্য করে উভয়কে একাকার করে ফেলে।

আহমদ আল আসিরি তার মুওজিযুত তারিখিল ইসলামি গ্রন্থে এই মতামতকে সমর্থন করেছেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে স্পষ্ট করেন যে, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের পরিবারের একজন ব্যক্তি অল্প বয়সে এসেছিলেন চীনে। সম্ভবত তার নাম ছিল ওয়াক্কাস বা আবু ওয়াক্কাস। ক্যান্টনে যে মাজার আছে, সেটা তারই। এ মতামত অনেকটা বাস্তবতার কাছাকাছি। কারণ চীনে ইসলামের প্রচারক হিসেবে আবু ওয়াক্কাসের উল্লেখ শুধু কিংবদন্তি নয়, এটি ইতিহাসও বটে।

বিশ্বমঞ্চে মুসলিম সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু বাস্তবতায় ইসলাম সম্পর্কিত চীনা ভাষ্যগুলো বিবর্তিত হলেও চীনা পণ্ডিত লি জিয়ানবাদ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন, চীনে ইসলামের প্রবেশ ঘটেছে মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায়।

লেখক : কবি ও ধর্মীয় গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত