মুসলিম সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র মসজিদ। মসজিদ ছাড়া মুসলিম সমাজ কল্পনা করা যায় না। মসজিদ শিআরে ইসলাম তথা ইসলামের নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত। কোনো অঞ্চলে মসজিদ থাকার অর্থ হলো সেখানে মুসলমানদের অস্তিত্ব আছে। মসজিদকে আদর্শ ইসলামি সমাজের হৃৎপি-ও বলা যায়।
মসজিদে সালাত আদায় ছাড়াও উল্লেখযোগ্য কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যেগুলো আদর্শ মানুষ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
মক্তব
এটি দেশের প্রতিটি মসজিদে পরিচালিত একটি শিশুশিক্ষা কার্যক্রম। মুসলিম শিশু-কিশোরদের কোরআনের প্রাথমিক শিক্ষা এখানে দেওয়া হয়। দেশের সিংহভাগ মুসলিম এই মক্তবের শিক্ষার্থী। বর্তমানে বিশুদ্ধ কোরআন পাঠক অধিকাংশ মসজিদের ইমাম হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিশুদ্ধ কোরআনের পাঠ শিখতে পারছে অনায়াসেই। কচিমনে কোরআনের প্রভাব পড়ছে এসব শিক্ষার্থীর। ভবিষ্যতে সমাজে সততার সঙ্গে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে এটি। মক্তবে উস্তাদ শুধু কোরআনের আরবি পাঠ পড়িয়েই ক্ষান্ত হন না। সালাত ও মৌলিক মাসআলাও শেখান তিনি। নীতি-নৈতিকতার পাঠও পায় এই মক্তব থেকে। যার ফলে আদর্শ মানুষ তৈরীতে এর অবদান অনস্বীকার্য। মসজিদের ইমাম হলেন ইসলামি সমাজের নেতা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গুণিজন। আদর্শবান ও সৎ ব্যক্তিত্ব। নীতিবান সুনাগরিক। এমন শ্রেষ্ঠ মানুষের কাছে কোরআনের পাঠ নিয়ে শিশু-কিশোররা ইমামের মত নম্র, ভদ্র, সুশীল ও আদর্শবান হতে শেখে।
জুমার খুতবা
মসজিদে শুক্রবার দিন জুমার নামাজের আগে ইমাম সাহেব মুসল্লিদের উদ্দেশে উপদেশমূলক ও জাতিগঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। বছরে বায়ান্নটি জুমায় বায়ান্নটি বিষয়ে আলোচনা হয়। দুর্নীতি ও সামাজিক অবক্ষয়রোধে জুমার বয়ান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভালো কাজে আগ্রহ ও মন্দ কাজে অনীহা সৃষ্টিকরণে জুমার বয়ানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। জুমার বয়ান সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি ব্যক্তিগঠনে খুবই ফলপ্রসূ। জুমার মিম্বর থেকে উচ্চারিত হয় সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সুদ, ঘুষ, জেনা-ব্যভিচার, অবিচার, হত্যা, সন্ত্রাস, জুলুম ও সব অনিয়ম বর্জনের বিশেষ আহ্বান। মুসল্লিরা এ বয়ান থেকে শুদ্ধতার পাঠ নেয়।
তালিম
বহু মসজিদে নিয়মিত গোল হালকায় মৌখিক আলোচনার মাধ্যমে বা কিতাব পাঠের মাধ্যমে শুচি শুদ্ধতার তালিম হয়। কোরআন ও হাদিসের পাঠ হয়। এসব তালিমে আত্মপরিশুদ্ধির বার্তা থাকে। মানবিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার মন্ত্র থাকে। নিয়মিত মুসল্লি হওয়ার সবক থাকে। নিয়মতান্ত্রিক সালাত আদায়কারী ব্যক্তি অন্যায় করতে পারে না। কোরআন বলছে, ‘নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৫)।
তালিমে আদর্শ মানুষের গল্প শোনানো হয়। যুগে যুগে সমাজশুদ্ধতায় ও বিনির্মাণে যারা অবদান রেখেছেন তাদের গল্প ও বীরত্বগাথা শুনে মুসল্লিরা সৎ পথে ধাবিত হওয়ার প্রেরণা পান। আল্লাহপ্রিয় মনীষীদের কর্মস্পৃহার কথা ও সফল জীবনের গল্প শুনে তাদের জীবনী থেকে উৎসাহ ও প্রেরণা নিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার প্রেরণা ও চেতনায় উজ্জীবিত হয় মুসল্লিরা। মসজিদ থেকে এভাবে প্রতিনিয়ত আদর্শ মানুষ হওয়ার সুবাসিত বাতাস ছড়িয়ে পড়ে সমাজের অলিগলিতে।
সালাত কার্যক্রম
জামাতের সঙ্গে সব মুসল্লি সালাত আদায় করা মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রধান কাজ। পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে যখন সবাই মসজিদে সমবেত হয় এতে করে বেশ কিছু সুফল মুসল্লিরা ভোগ করে থাকেন, যা একজন আদর্শ মানুষের মৌলিক গুণ বিকাশে প্রেরণা জোগায়।
ভ্রাতৃত্ববোধ
সালাতকে কেন্দ্র করে সমাজের মুসলিম পুরুষরা মসজিদে জমায়েত হন। হিংসা, বিদ্বেষ ও অহমিকা ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায় সবাই। এতে করে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। সৌহার্দ্র, সম্প্রীতির সমাবেশ ঘটে, যা একজন আদর্শ মানুষের গুণ ও বৈশিষ্ট্য।
নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পাঠ
মুসল্লিরা এক ইমামের পেছনে সুশৃঙ্খলভাবে ও সময়মতো ধারাবাহিকভাবে নামাজ আদায় করে থাকেন। এ বিশেষ গুণটি নিয়মিত মসজিদে আসার কারণেই শিক্ষা লাভ করেন মুসল্লিরা, যা অন্যান্য কাজে তাদের বিশেষ সহায়তা প্রদান করে থাকে। ফলে তারা সময়জ্ঞান ও শৃঙ্খলাবোধে অনুপ্রাণিত ও অভ্যস্ত হয়ে জীবন গঠনে উদ্যোগী ও তৎপর হয়ে ওঠে।
মসজিদভিত্তিক পাঠাগার ও গণশিক্ষা
প্রায় মসজিদে পাঠাগার ও গণশিক্ষার কার্যক্রম বিদ্যমান আছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এগুলোও আদর্শ মানুষ তৈরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
মাদ্রাসা আদর্শ মানুষের কারখানা
আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এ দেশের মাদ্রাসাগুলো। কোরআনিক শিক্ষা মানুষকে সুন্দর, মার্জিত ও আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে তোলে। শিক্ষা নিয়ে একটি চমৎকার প্রবাদ আছে। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। সুশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ অমানবিক ও দুর্নীতিপরায়ণ হয় না। সৎ ও সুনাগরিক গঠনে এ সুশিক্ষাই দিচ্ছে যাচ্ছে এ দেশের মাদরাসাগুলো। একজন জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিও যদি ধর্মীয় শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে, তখন সে সুদক্ষ ও শিক্ষিত নাগরিক হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যাপক কাজ করতে পারবে। তখন প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড প্রবচনটির প্রয়োগ হবে। অন্যথায় এটি মুদ্রিত অক্ষরের একটি মুখরোচক বাক্যই থেকে যাবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
মাদ্রাসা শিক্ষার পেছনে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন একনিষ্ঠ দক্ষ ও আদর্শ শিক্ষকরা। নামেমাত্র বেতন নিয়ে তারা কোরআনের এ মহান খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন তারা। দেশে দুটি ধারার মাদ্রাসা বিদ্যমান। একটি কওমি মাদ্রাসা। অন্যটি সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা। দু’ধরনের মাদরাসায়ই নীতিসমৃদ্ধ পাঠের শিক্ষা ও চর্চা বিদ্যমান। মাদ্রাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যই হলো সত্যবাদী, সৎ ও নৈতিক চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক গড়ে তোলা। দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, মাদ্রাসা পড়ুয়াদের মধ্যে নব্বই পার্সেন্টই সৎ, দক্ষ ও যোগ্যতার সঙ্গে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। তারা আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে আদর্শিক এক অনন্য উচ্চতায় সমাসীন হয়। তাদের অধিকাংশই সততার জীবনযাপন করে। কোনো আলেম তার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে শোনা যায়নি। কিন্তু জেনারেলে উচ্চ শিক্ষিত এমন অনেক লোক আছেন, যারা তাদের মূল্যবান নেয়ামত মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন, যা প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার বিষফল ও নৈতিক পদস্খলন।
দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার এক দুর্দমনীয় চেতনা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কওমি ধারার শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়, যা মূলত ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে হাজার হাজার আলেম শহীদ হওয়ার পর যুদ্ধে সাময়িক কৌশলী বিরতি এবং পরবর্তী প্রজন্মকে দীনমুখী করার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ চেতনায় আত্মপ্রকাশিত কওমি মাদ্রাসার সূতিকাগার হলো ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ। এর ত্যাগ ও আদর্শের ইতিহাস সুদীর্ঘ। আদর্শ মানুষ তৈরির কারখানা মাদ্রাসাগুলো যুগে যুগে এ জাতিকে ক্ষণজন্মা মহামনীষী উপহার দিয়েছে। নামোল্লেখ করলে আলাদা নিবন্ধ করতে হবে। মোটাদাগে হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.), মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহি (রহ.), মাওলানা কাসেম নানুতবি (রহ.), মাহমুদুদুল হাসান দেওবন্দি, হোসাইন আহমদ মাদানিসহ অসংখ্য বিদ্বানের হাত ধরে আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর এই প্রতিষ্ঠানগুলো কালক্রমে আদর্শিক ও সুস্থ চেতনা বিলিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
মসজিদ-মাদ্রাসা এ দেশের মানুষের মন ও মননে বাস করা আদর্শিক চেতনায় পরিপুষ্ট দুটি ভিন্ন ধাঁচের অথচ পরিপূরক প্রতিষ্ঠান, যা আদর্শ মানুষ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে নীরবে নিরন্তর।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, দারুল হুদা মডেল
মাদ্রাসা, কোদালপুর