প্রাচীন চীনা ঐতিহাসিক উঁর পযধড় এর রচনায় ইসলামের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায়। তাং সম্রাট ঢঁধহুড়হম (৬৮৫-৭৬২) এর আদেশে, ৭২৩ থেকে ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে বইটি রচিত হয়। মহানবীর ইন্তেকালের শতবর্ষ পরে রচিত ভারতীয় পাঁচ রাজ্যে তার ভ্রমণকাহিনিতে পারসিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয়ের উল্লেখ করেন। মহানবীকে উটের রাখাল এবং পারস্যের বিরুদ্ধে বিজয়ী বিদ্রোহী হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি। এ গ্রন্থ রচিত হয় পশ্চিম চীনে কুতায়বা মুসলিমের অভিযানের কাছাকাছি সময়। তখন চীনা রাজা অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ ছিলেন উমাইয়াদের সঙ্গে!
চীনা ঐতিহাসিক লিউ শু (Liu Xu) (৮৮৮-৯৪৭) এর রচিত তাং রাজবংশের প্রথম ক্লাসিক ইতিহাসে ইসলাম ও মহানবীর প্রসঙ্গ উল্লেখিত। ৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত দুই শত অধ্যায়বিশিষ্ট বইটির ইংরেজি অনুবাদ The Old Book of Tang। লিউ শু উল্লেখ করেন মদিনা রাষ্ট্রের নতুন ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কথা, যার সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের নীতি ও নিয়মের কোনো মিল নেই। ইসলাম ধর্মে কোনো মূর্তি নেই। নেই কোনো ছবির ব্যবহার। এটি সম্পূর্ণ আলাদা এক ধর্ম, ভিন্ন এক সংস্কৃতি। এই ধর্ম তৈরি হয় আরবের এক ব্যক্তিত্বের হাতে, যিনি মূলত উটের রাখাল। তার অনুসারীরা তার দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়। তারা তাকে ঘিরে জড়ো হয়। তিনি বিদ্রোহ করে পারস্য জয় করেন।
দেখা যাচ্ছে চীনা কিংবদন্তির সেই চিত্র, যাতে রয়েছে মহানবীর অঙ্কিত ছবির বিবরণ, সেখানে নবীজিকে দেখানো হয়েছে উটের আরোহী হিসেবে, চারদিকে বেদুইন ভক্তরা তাঁর দিকে উন্মুখ হয়ে আছে! Dui chao এর ভাষ্যে মহানবীকে দেখানো হয়েছে উটের রাখাল, একই কাজ করেছেন লিউ শু। লিখিত ভাষ্যগুলো যখন তৈরি হয়, ততক্ষণে ইসলাম এক বিজয়ী সভ্যতা এবং মহানবী (সা.) বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মপ্রবর্তক, যার অনুসারীদের হাতে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর কর্তৃত্ব। চীন সেই কর্তৃত্বকে তখন সমীহ করে চলছে। নিজের সীমানাঞ্চলে মুসলিমদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্চ করছে না। কিছু এলাকা বরং ছেড়ে দিচ্ছে মুসলিমদের ক্রোধের সামনাসামনি না হওয়ার জন্য। এ অবস্থায় মহানবীর পরিচয়দানে কেন উটের রাখাল কথাটা বারবার সামনে আসছে, যা মূলত তার নবুয়তপূর্ব জীবনের কিছু সময়ের অভিজ্ঞতা। সেটা প্রধান চিত্র হয়ে উঠেছে চীনা ঐতিহ্যবাদের কারণে। কারণ, দেখাতে হবে অন্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি কতটা বর্বর, উদ্ভট ও আলাদা। যেন তার স্পর্শদোষ থেকে চীনা মন সুরক্ষিত থাকে। হাজার বছরের চর্চিত এই মানসের নির্দেশে অষ্টাদশ শতকের পশ্চিমী সভ্যতাকে চীনারা বর্বর বলে আখ্যায়িত করেছিল, জাপানি প্রয়োগবাদকে নিন্দা ও প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং পশ্চিমা সভ্যতার স্পর্শ চীনা মৌলিকত্বের ভার্জিনিটি নষ্ট করবে, এই ভয়ে পশ্চিমকে তারা যুগ যুগ ধরে অস্পৃশ্য করে রেখেছিল। এটা করতে পেরেছিল নিজেদের চোখে ও বয়ানে তাকে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যার সহায়তায়। ইসলামের প্রশ্নে এই জিনিসটা লক্ষ্য করব বিশেষভাবে। প্রাথমিক চীনা ভাষ্যগুলো ইসলামকে বয়ানের চেয়ে বরং দেখাতে চায় ইসলাম কতটা অপর, কতটা আলাদা এবং চীনাদের জন্য কতটা অপ্রয়োজনীয়। কারণ ইসলামের উল্লেখমাত্রই দেখানো হচ্ছে উট, মরুভূমি, বেদুইন মানুষ। আর বিদ্রোহী তৎপরতা...
চৈনিক নয়, এমন যে কোনো ধর্ম ও সংস্কৃতির বয়ানে ও তার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে চীন চারটি মূলনীতিকে ভুলে যায় না। প্রথমত, যে কোনো সভ্যতার তুলনায় চীনা সভ্যতার সৃজনশীলতা বেশি, মৌলিকত্বও উজ্জ্বল। চীনা সভ্যতাকে কোনো কালেই অন্য কাউকে অনুসরণ করতে হয়নি। কারো কাছে তাই সে ঋণী নয়। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সৃষ্টিশীল সামর্থ্যে সে স্থায়িত্বের এমন শক্তি লাভ করেছে, যা অন্য সভ্যতায় নেই। মেসোপটেমিয়? সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস-তীরের সভ্যতা কিংবা প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। কিন্তু চায়না সভ্যতা সব প্রতিকূলতা উজিয়ে শুধু টিকে থাকেনি, বরং ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে, প্রসারিত হয়েছে। তৃতীয়ত, একত্ব, এককেন্দ্রিকতা ও সংরক্ষণ এই সভ্যতার বিরল বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একই সঙ্গে সে বিশাল, বিপুল, বহুব্যাপ্ত। আয়তনের বিস্তৃতি, জনসংখ্যার প্রাচুর্য সত্ত্বেও চীনা সভ্যতায় দেশ এক, ভাষা এক, কেন্দ্র এক, ঐতিহ্য এক, কৃষ্টি এক। এখানে ভিন্নমাত্রিক কোনো অংশীদারিত্ব ও উপস্থিতির সম্ভাবনাও টিকে থাকার ন্যায্যতা নেই। চতুর্থত, নীতি ও আচরণ যতই সংরক্ষণবাদী ও কর্তৃত্ববাদী হোক, চীনা সভ্যতাকে দেখাতে হবে মানবিক হিসেবে, বিশ্বপ্রেমিক হিসেবে। সে যদি কোনো নৃশংসতাও করে, তার পেছনে মানবীয় ও বিশ্বকল্যাণী কার্যকারণ রয়েছে। নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাহারায় কাজ করবে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি। সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতির চাহিদার সেবা করতে হবে রাষ্ট্রকে। এর টিকে থাকার ঐতিহাসিক সামর্থ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে দেওয়া যাবে না। পরিস্থিতি যত জটিল হোক, শক্তি প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু মনে রাখেতে হবে চীনের প্রধান শক্তির নাম কৌশল। যেখানে সে শক্তিমান, সেখানে শক্তি প্রয়োগের ধরন হবে এক, যখন সে দুর্বল, তখন শক্তি প্রদর্শনের ধরন হবে ভিন্ন। কিন্তু সব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কম মাত্রার ঝুঁকি নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাত্রার উপকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
উমাইয়া যুগে চীন অপ্রতিহত এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ইসলাম তখন এশিয়ার পরাশক্তি পারসিয়ান সাম্রাজ্যকে অধিকার করেছে। রোমান সাম্রাজ্যকে উচ্ছেদ করেছে এশিয়া থেকে। সে ইউরোপ ও ইউরেশিয়ার সীমানায় মুসলিম বিজয়ের ভয়ে তটস্থ। আফ্রিকা মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের আইবেরিয় উপদ্বীপ মুসলিম কর্তৃত্বে। মধ্য এশিয়া মুসলিম বিজয়ের জোয়ারে ভাসছে। এ পরিস্থিতিতে চীন ছিল ইসলামের বিজয়াভিযানের সবচেয়ে নিকটবর্তী লক্ষ্য।
ইবনে কাসির আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ায় এবং ইবনুল আসির তার আল কামিল ফিততারিখে উল্লেখ করেছেন চীনে কুতাইবার অভিযানের বর্ণনা। ইবনে কাসির জানান, মধ্য এশিয়ার তুর্কি শহরগুলো জয় করে কুতাইবা চীনের সীমান্তে উপনীত হন। চীনা সম্রাটের কাছে প্রেরণ করেন দূত। সম্রাট মুসলিম অভিযানের আতঙ্কে ছিলেন কম্পমান। উপহার হিসেবে তার কাছে পাঠান প্রচুর সম্পদ। এ পরিস্থিতিতে সম্রাট দুর্বল ছিলেন, তা নয়। অত্যন্ত ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণে সৈন্য থাকার পরেও সদাচরণের খাতিরে কুতায়বার সমীপে প্রতিনিধি পাঠান। এবং চীনের আশপাশের সামন্তরাজাগণ কর দিতে থাকেন কুতাইবাকে। ৮৮ হিজরি ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে সাগাদ ও ফারগানায় বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহীরা চীন সম্রাটের ভাগনেকে বানায় নিজেদের অধিনায়ক। দুই লাখ সৈন্যসহ তারা মার্চ করে। কুতায়বা তাদের পরাজিত করে মার্ভে ফিরে আসেন। ৭১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে কুতায়বা যখন মধ্য এশিয়ার তুর্কি শহর সাগাদ অধিকারের চেষ্টা করছেন, তখন মুসলিমদের মোকাবিলায় চীনা সম্রাট নিজের প্রধান অধিনায়কদের প্রেরণ করেন। এমনকি যুদ্ধে অংশ নেন রাজপুত্ররাও। সম্রাটের এক পুত্র সে যুদ্ধে প্রাণ হারান। মুসলিমরা জয়ী হন।
৯৩ হিজরি সনে একই পরিস্থিতি হয় সমরকন্দে। শহরটি অবরোধ করলেন কুতায়বা। স্থানীয়রা ফটক বন্ধ করে সাহায্য কামনা করে চীন সম্রাটের কাছে। ফারগানার রাজার কাছে। সম্রাট পাঠালেন বিশাল এক বাহিনী। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন তার এক পুত্র। কুতায়বা তাদের অগ্রাভিযান থামাতে চালালেন গেরিলা হামলা। মাত্র ৬০০ সৈন্য নিয়ে পুরো চীনা গ্যারিসনগুলোকে তিনি বিধ্বস্ত করেন। সম্রাটের কাছে ফিরে যায় তাদের অসহায় মৃত্যুর সংবাদ। চীনা সম্রাট নিজেদের সীমান্তের বাইরে ছায়াযুদ্ধে খেলছিলেন কুতায়বার সঙ্গে। প্রতিবারই ধরাশায়ী হলেন। এবার কুতায়বা অগ্রসর হয়ে চীনের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র কাশগড়ে অভিযান পরিচালনা করলেন। সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত কৌশলগত এই শহর রাশিয়া, মধ্য এশিয়া ও চীনের সংযোগস্থল ছিল। ফারগানা থেকে পাহাড়ি পথ ধরে মুসলিম সৈন্যরা এগুতে থাকল কাশগড়ের দিকে। সহজেই সম্পন্ন হয় কাশগড় জয়। তারপর কুতায়বা বার্তা পাঠান চীনের সম্রাট সমীপে। আপনাকে বলছি, মুসলিমদের কর্তৃত্ব মেনে নিন। না হয় মুসলিমদের ঘোড়ার খুরের তলে পিষ্ট হয়ে যাবে আপনার সাম্রাজ্য।
চীন সম্রাট এমন হুমকির মোকাবিলায় শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করতেই পারতেন। তখন চীন এশিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শক্তি। অর্থ, অস্ত্র, সৈন্য, যুদ্ধকৌশল, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সবই আছে তাদের। চীন কোনোকালেই এরকম হুমকিকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয় না। কিন্তু সম্রাট চ্যালেঞ্চের পথ অবলম্বন করলেন না। বড় শক্তি বা বড় সম্রাট এর ইগোকে ভুলে গেলেন। তিনি ইতোমধ্যে পরখ করেছেন মুসলিমদের যুদ্ধসক্ষমতা। জেনেছেন তাদের হাতে পারসিক ও রোমান সাম্রাজ্যের কী পরিণতি ঘটেছে। অতএব তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা যাবে; কিন্তু নিজেদের মতো করে শেষ করা যাবে না। বরং হারাতে হবে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা।
লেখক : কবি ও ধর্মীয় গবেষক