পানি পানে ইসলামি শিষ্টাচার

দীদার মাহদী

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পানি আল্লাহ তায়ালার গুরুত্বপূর্ণ একটি নেয়ামত। কথায় বলে, পানির অপর নাম জীবন। তবে এ কথার প্রতিধ্বনি কোরআনে মেলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?’ (সুরা আম্বিয়া : ৩০)। পৃথিবীর সব কিছুই মূলত পানির ওপর নির্ভরশীল। পানি ছাড়া সবই অচল। পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ পানি আর ১ ভাগ হচ্ছে স্থল। কিন্তু সব পানি আবার খাবার উপযুক্ত না। মোট পানির ৯৭ ভাগ লোনা। মাত্র ৩ ভাগ পানি সুস্বাদু। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে কি তোমরা চিন্তা করেছ? তোমরাই কি তা মেঘ হতে নামিয়ে আন, না আমি তা বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছে করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবুও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৮-৭০)। তীব্র গরমে পানির তেষ্টা পেলে পানির গুরুত্ব খানিকটা বোঝা যায়। ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। পানি পানে ইসলাম দিয়েছে চমৎকার কিছু নির্দেশনা। যাতে পানি পান করাটা স্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি উপকার বয়ে আনে।

ডান হাতে পান করা

জীবনাচারের ক্ষেত্রে কোথায় ডানকে আর কোথায় বামকে প্রাধান্য দিতে হবে ইসলাম তা শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামে যাবতীয় উত্তম কাজে এবং উত্তম স্থানে ডানকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। বাম হাতে পানাহারকে হাদিসের ভাষায় অভিশপ্ত শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। অনেকেই অজ্ঞতা ও অবহেলাবশত ডান হাতের বদলে বাম হাত দিয়ে পানাহার করে, যা হাদিসের শিক্ষার পরিপন্থি, রাসুলের সুন্নতবিরোধী কাজ। ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ শয়তান বাম হাতে পানাহার করে।’ (মুসলিম : ৫১৬২)।

পান করার পর অন্যজনকে দিতে হলে প্রথমে ডান পাশের জনকে দিতে হবে। সেও তার ডান পাশের জনকে দেবে, এভাবেই চলবে। পানীয়ের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) এর সঙ্গে সম্মুখে পানি মেশানো দুধ পেশ করা হলো। তাঁর ডান পাশে ছিল এক বেদুইন ও বাম পাশে ছিলেন আবু বকর (রা.)। নবী (সা.) দুধ পান করলেন। তারপর বেদুইন লোকটিকে তা দিয়ে বললেন, ডানের লোকের অধিকার আগে। এরপর তার ডানের লোকের। (বোখারি : ৫৬১৯)।

বসে পান করা

বসে পানি পান করলে শরীরের বেশি উপকার হয়। বসে পানি পান করলে শরীর ঠিক মতো পানি গ্রহণ করে। এর ফলে কোষেকোষে পানি পৌঁছে যায়। এমনকি বাড়তি পানি শরীরের ক্ষতিকারক পদার্থ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দাঁড়িয়ে পানি পান করলে আর্থ্রাইটিস বাড়ে। কিডনিতে চাপ পড়ে। পেটের সমস্যা এবং ফুসফুসের সমস্যা হয়। তাই প্রতিটি মানুষেরই বসে পানি পান করা উচিত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে পান করতে বারণ করেছেন। (মুসলিম : ৫১৭৩)।

শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ ও শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা

শুধু পানি পানের সময়ই নয়, বরং যে কোনো কিছু খাওয়ার সময় এবং যে কোনো ভালো কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা সুন্নাহ। পানি আল্লাহর অন্যতম সেরা নেয়ামত। তা পানের আগে আল্লাহর নামে শুরু করাটা বরকতপূর্ণ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের কোনো ব্যক্তি খাওয়া শুরু করে তখন যেন সে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে। সে খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে তবে যেন বলে, ‘বিসমিল্লাহ ফী আওয়ালিহি ওয়া আখিরাহু।’ (অর্থ : এর শুরু ও শেষ আল্লাহতায়ালার নামে)। (জামে তিরমিজি : ১৮৫৮)।

খাওয়া শেষে শুকরিয়া আদায় করা বান্দার কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বান্দার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে সন্তুষ্ট হন। আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। নবীজি (সা.) বলেছেন, কোনো কিছু খেয়ে অথবা কিছু পান করে বান্দা আল্লাহতায়ালার প্রশংসা করলে অবশ্যই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হন। (জামে তিরমিজি : ১৮২৬)।

তিন নিঃশ্বাসে পান করা ও পাত্রে শ্বাস না ফেলা

পান করার সময় খেয়াল রাখা যেন পাত্রের মধ্যে নিঃশ্বাস না পড়ে। এ জন্য নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় পানির পাত্র হতে মুখ সরিয়ে নেওয়া। তা ছাড়া অনেক সময় তাড়াহুড়া করে পানি পান করতে গেলে গলায় পানি আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ধীরস্থিরভাবে তিন শ্বাসে পানি পান করতে হবে। পান করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা গ্লাসে শ্বাস ফেলি। পান করতে করতে শ্বাস ফেলার প্রয়োজন হয়। তখন মুখ থেকে পানপাত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত। পাত্রে শ্বাস ফেলাটা ক্ষতিকর। আমরা জানি, আমাদের শ্বাসের সঙ্গে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পাত্রে শ্বাস ফেললে কার্বন ডাই-অক্সাইড পানির সঙ্গে মিশে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাই পান করার সময় শ্বাস ফেলতে হলে মুখ থেকে পানপাত্র সরিয়ে তারপর শ্বাস ফেলব। এমনটাই রাসুল (সা.) তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, পান করার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার নিশ্বাস নিতেন এবং বলতেন, এতে করে ভালোভাবে প্রশান্তি লাভ হয়, তৃষ্ণার্তের কষ্ট লাঘব হয় এবং খুব আরামে গলধকরণ হয়। আনাস (রা.) বলেন, আমিও পান করার সময় তিনবার নিঃশ্বাস নিয়ে থাকি। (মুসলিম : ৫১৮২)।

আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) পানপাত্রের মধ্যে শ্বাস ফেলতে বারণ করেছেন। (মুসলিম : ৫১৮০)।

ভাঙা গ্লাসে পান না করা

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, অনেক সময় মুখে বা মুখের সামনে অনেক ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণুু থাকে। পানি বা খাবারে ফুঁ দেওয়া বা নিঃশ্বাস ফেলার ফলে এ জীবাণু ব্যাকটেরিয়া পানি ও খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আর তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ভাঙা গ্লাসে পানি পান করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। মুখ কেটে যেতে পারে। অবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন পাত্রের ভাঙা স্থান দিয়ে পানি পান করতে এবং পানীয়ের মধ্যে ফুঁ দিতে। (সুনানে আবু দাউদ : ৩৭২২)।

বড় পাত্রে মুখ লাগিয়ে পান না করা

বড় পাত্রে মুখ লাগিয়ে পান করলে গলায় বেশি পানি চলে আসার ভয় থাকে। পোকামাকড় বা ক্ষতিকর কিছু পানিতে থাকারও শঙ্কা থাকে। তাই ছোট পাত্রে পান করা এবং পান করার আগে পানি দেখে পান করা সুন্নাহ। এটাই ইসলামের সভ্যতা ও শিষ্টাচার। ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কলসের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে, জাল্লালায় সওয়ার হতে এবং কোনো প্রাণীকে বেঁধে তির নিক্ষেপ করে হত্যা করতে বারণ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ : ৩৭১৯)।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, দারুলহুদা মডেল

মাদ্রাসা, কোদালপুর