ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রভুপ্রেমে সিক্ত হৃদয়

জাকারিয়া হারুন
প্রভুপ্রেমে সিক্ত হৃদয়

তাপদাহে অস্থির হয়ে যাই। হয়ে যাই বিচলিত। অসহ্য-অস্থির লাগে। অথচ হাজেরা (আ.) এর নিদারুণ কষ্টের কথা ভাবা যায়! তিনি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সহধর্মিণী। হজরত ইসমাঈল (আ.) এর সম্মানিত মা। তাই তিনি এ উম্মতেরও মা। তিনি কষ্ট সয়েছেন হিমালয়সম।

হজরত ইবরাহিম (আ.) এর বৃদ্ধ বয়সে অনেক দোয়া ও আকাঙ্ক্ষার পরে জন্ম নেয়া একমাত্র সন্তান হজরত ইসমাঈল (আ.)। কে জানত! বহু সাধনা ও আকাঙ্ক্ষার পর জন্ম নেয়া এ সন্তান হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষার কারণ হবে? ধাপে ধাপে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু ইবরাহিম (আ.) এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন সফলভাবে।

প্রথম পরীক্ষা এই ছিল, মহান আল্লাহ হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) কে হুকুম দিলেন, আদরের সন্তান ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে নিয়ে শাম থেকে হিজরত করে হিজাজের মধ্যবর্তী স্থান যা বালুময় ছিল- যেখানে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো মানুষ, প্রাণী এমনকি গাছপালাও ছিল না, সেখানে তাদের আবাস বানানোর। মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হজরত ইবরাহিম (আ.) বিন্দুমাত্র ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন। প্রিয় সন্তান ও প্রেয়সী হজরত হাজেরা (আ.)-কে ধ্বংসাত্মক মরুস্থানে রেখে যান- যা এক সময় তাদের মাধ্যমে ‘উম্মুল কোরা’ হিসেবে আবাদ হয়।

শুধু এটুকুই নয়। এবার হুকুম এলো আরও কঠিন- মা ও ছেলেকে এখানে রেখে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে শাম দেশে চলে যাওয়ার। মহান আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ লক্ষ্য করুন, যে স্থানে এ হুকুম পান সে স্থান থেকেই শাম দেশে রওয়ানা শুরু করেন। এতটুকু সময়ও নষ্ট করেননি যে, হজরত হাজেরা (আ.) এর পাশে বসে একটু সান্ত¡না দেবেন বা এ কথা বলে যাবেন যে, মহান আল্লাহর হুকুমেই এ বিচ্ছেদ। যখন হজরত হাজেরা (আ.) দেখলেন হজরত ইবরাহিম (আ.) ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছেন, তখন তিনি সজোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, আমাদের এ ভয়ঙ্কর জঙ্গলে একা রেখে কোথায় চলে যাচ্ছেন? এ কথা শুনেও মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু ফিরে তাকাননি এক মুহূর্তের জন্য। অতঃপর হজরত হাজেরা (আ.) এর মনে হলো, এ মহান ব্যক্তি মহান আল্লাহর হুকুম ছাড়া আমাদেরকে এ জঙ্গলে একা ফেলে চলে যেতে পারেন না। এবার হজরত হাজেরা (আ.) প্রশ্ন করলেন,

- মহান আল্লাহ কি আপনাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন? মহান আল্লাহর রাহে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া বন্ধু জবাব দিলেন,

- হ্যাঁ। একথা শুনে মহীয়সী নারী হজরত হাজেরা (আ.) বললেন, যদি মহান আল্লাহর হুকুমে চলে যান- তাহলে মহান রব আমাদের কোনো ক্ষতি করবেন না।

এখন এ নির্জন মরু প্রান্তর- যেখানে খাবার-পানি বলতে কিছুই নেই। প্রচণ্ড গরমের উত্তাপ। সব ধরনের কষ্টের উপকরণ এখানে- কিন্তু কে জানত, এ মরু প্রান্তর এক সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দামি স্থানে পরিণত হবে?

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর হৃদয়ে তীব্র টান অনুভব করলেন। পরম আদরের স্ত্রী-পুত্রকে মরুভূমিতে রেখে এসেছেন এরই মধ্যে এক বছর অতিক্রম হয়েছে। এক বছর পর একদিন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি হয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) এলেন স্ত্রী সন্তানকে দেখতে।

শিশু ইসমাঈলের বয়স দেড় বছর। একটু একটু হাঁটে। আধো আধো দু-একটা কথাও বলে। এ অবস্থায় শিশু ইসমাঈলকে দেখে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর হৃদয় ভালোবাসায় শীতল হয়ে যায়। অন্তরাত্মা জুড়িয়ে যায় পরম পুত্রস্নেহে। এক পা-দু পা করে হাঁটছে কলিজার টুকরা ইসমাঈল (আ.)। আবার ধপস করে পড়ে যাচ্ছে মরুবালির ওপর। অপলক চোখে তাকিয়ে তা দেখছেন মহান আল্লাহর বন্ধু। সন্তানের এ বয়সের আধো আধো ডাক হৃদয় নাড়িয়ে দেয়।

এ দৃশ্য দেখে হজরত হাজেরা (আ.) মহাখুশি। এবার সন্তানের মায়ায় ইবরাহিম (আ.) তার সঙ্গেই থাকবেন। এসব ভেবে হজরত হাজেরা (আ.) স্বামী ইবরাহিম (আ.)-কে বললেন- আসুন। সওয়ারি থেকে নেমে আসুন। একটু বিশ্রাম নেন।

এর পরের কাহিনি বড়ই করুণ। হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন, আমার প্রিয়তমা হাজেরা! আজ আমারও ইচ্ছে করছে তোমাদের সঙ্গে থেকে যেতে। কিন্তু আমি নিরুপায়। সওয়ারি থেকে অবতরণ করা যাবে না, মহান আল্লাহর নির্দেশ।

হজরত হাজেরা (আ.)-এর চোখে পানি এসে গেল মহান আল্লাহর নির্দেশ শুনে। কাঁদছিলেন হাজেরা (আ.)। আঁচলে চোখ মুছে বললেন-

- আমার আল্লাহ যা বলেছেন এর ওপর আমি সন্তুষ্ট। আপনি আমায় অনুমতি দেন আমি আপনার পা, মাথা ধুয়ে দিই।

হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন, তবে এটুকুই অনুমতি আছে প্রিয়তমা আমার। পরম ভালোবাসায় হজরত হাজেরা (আ.) স্বামী ইবরাহিম (আ.)-এর হাত, পা ও মাথা জমজমের পানিতে ধুয়ে দিলেন।

সময় হলো বিদায় নেয়ার। ছিঁড়ে যাচ্ছে বুকের পাঁজর। ছলছল করছে হজরত হাজেরা (আ.) এর চোখ যুগল। প্রিয়তম স্বামীকে পেয়েও অতৃপ্তি থেকে গেল। হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার গোলাপ।

চলে যাওয়ার সময় হজরত ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোলে নিয়ে আদর করলেন। বুকে নিলেন। চুমু খেলেন। বিদায় নিলেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন হজরত হাজেরা (আ.)। স্বামীর প্রস্থান দেখছেন। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। তারপরও হাজেরা (আ.) বলছেন, হে আমার প্রভু! তোমার ভালোবাসায় শানিয়ে রেখেছি এ বুক। তোমার প্রেমে সিক্ত হৃদয়। (জাওয়াহেরুল ফিকহ ৬-২৫২)।

লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত