ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোরবানির শিক্ষা

শাহাদাত হোসাইন
কোরবানির শিক্ষা

আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম কোরবানি। কোরবানি শব্দটি কোরবান শব্দমূল থেকে উৎকলিত। যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা। সান্নিধ্যে আসা। উৎসর্গ করা। ব্যাপকার্থে কোরবানি বলা হয়, আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য নিজের প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করা। আদম (আ.) এর ছেলে হাবিল ও কাবিল থেকে কোরবানির ইতিহাস শুরু হয়। আর ইবরাহিম (আ.) প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার দ্বারা, নিজের আল্লাহপ্রেমের চূড়ান্ত প্রমাণ স্থাপন করেন। ইবরাহিম (আ.)-এর এই কাজকে আল্লাহ এতটাই পছন্দ করেন যে, কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের জন্য তা ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেন। কোরবানির ইতিহাসে আল্লাহপ্রেমীদের জন্য রয়েছে উপদেশ। জ্ঞানীদের উচিত কোরবানির ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিজেদের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো।

ত্যাগের শিক্ষা

কোরবানি আমাদেরকে আল্লাহরজন্য আত্মত্যাগ ও নিজ স্বার্থ বিসর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর জন্য নিজ জীবন বা সন্তানের জীবন উৎসর্গ করতে উৎসাহ জোগায়। যেমনটা করেছিলেন ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহর বিধানের সামনে নিজ সন্তানকে কোরবান করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাদের এই ঘটনা আমাদেরকে শেখায় যে, আল্লাহর আদেশকে সকল স্বার্থ এবং স¤পর্কের ওপরে রাখতে হবে এবং আল্লাহর ভালোবাসার জন্য অন্যসব ভালোবাসা বিসর্জন দিতে সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে।

নিয়তের শুদ্ধতা

নিয়তের শুদ্ধতা ও পরিপক্বতা আমল কবুলের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, যা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। আল্লাহ বলেন, আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন এবং মরণ জগৎস্রষ্টা আল্লাহর জন্য (সুরা আনআম : ১৬২)। তাই, ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য করা উচিত। কোনো ইবাদতে যদি মানুষ দেখানো মানসিকতা থাকে তাহলে তা অনর্থক, সাওয়াবহীন হয়ে যায়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি আমার ইবাদত করল এবং তাতে আমার সঙ্গে অন্যকে শরিক করল (মানুষ দেখানোর নিয়তে করল), আমি তাকে এবং তার ইবাদতকে ছেড়ে দেই (মুসলিম : ২৯৮৫)। নবী (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক কাজের সাওয়াব নির্ভর করে ব্যক্তির নিয়তের ওপর (বোখারি : ৫৪)। ইবাদতে নিয়তের শুদ্ধতা ব্যক্তিকে রবের কাছে সম্মানিত ও প্রিয়করে। আর নিয়তের অশুদ্ধতা ছোট-বড় সব ইবাদতকে বিনষ্ট ও বিফল করে।

তাকওয়ার শিক্ষা

কোরবানি থেকে আমরা তাকওয়ার শিক্ষা পাই। মোমিনের জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহভীতি ছাড়া সবকিছু গুরুত্বহীন। তাকওয়া-আল্লাহভীতি ব্যতীত কোটি টাকা খরচ করে কোরবানি দিলেও তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ, আল্লাহ বান্দার তাকওয়া দেখেন। পশুর মোটাতাজা আর গোস্ত দেখেন না।

কোরআনে এসেছে, আল্লাহতায়ালার কাছে তার (কোরবানির) গোস্ত ও রক্ত পৌঁছে না, তবে তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে। (সুরা হজ : ৩৭)।

সাধ্যের সবটুকু আল্লাহপ্রেমে সমর্পণ

কোরবানির ইতিহাস আমাদের জানান দেয় যে, আল্লাহকে পেতে হলে সাধ্যের সবটুকু তাঁর জন্য উৎসর্গ করতে হবে। তাহলেই আল্লাহর পূর্ণ ভালোবাসা পাওয়া যাবে। ইবরাহিম (আ.) তার সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন নিজ সন্তানকে কোরবানি দিয়ে। বদলায় আল্লাহ তাকে আপন বন্ধু বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আজকেও যদি আমরা আল্লাহপ্রেমে সব উজাড় করে দিতে পারি, তাহলে আমরাও আল্লাহর প্রিয়জন বলে বিবেচিত হব।

নিজের প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করা

দুনিয়ায় যত নবী এসেছেন, সবাই আল্লাহপ্রেমে নিজেদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করেছেন। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপন সস্তান ও স্ত্রীকে জনমানবহীন ধু-ধু প্রান্তরে রেখে এসেছিলেন। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য-ই প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে কোরবানি করতে ইতস্তবোধ করেননি। তবে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসে কোনো কাজ করলে আল্লাহতায়ালাও বান্দাকে নিরাশ ও আশাহত করেন না। যার জ্বলন্ত প্রমাণ ইবরাহিম (আ.) এর কোরবানির ঘটনা।

সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথানত করা

আল্লাহর ইচ্ছা পালন থেকে বান্দার জীবনে বড় কোনো ইবাদত হতে পারে না। ইবরাহিম এবং ইসমাঈল দুই নবী সেটাই করে দেখিয়েছেন। বাবা-ছেলে কত শান্তভাবে আল্লাহর জন্য জীবন উৎসর্গের পরামর্শ করেছেন। ইবরাহিম (আ.) ছেলেকে বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী। সে বলল, পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা সম্পন্ন করুন। (সুরা সাফফাত : ১০২)। আল্লাহর হুকুমের সামনে কোরবানি করতে এবং কোরবান থেকে কেউ সামান্যতম কার্পণ্য করেনি। পিতা সন্তানের ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দেয়নি।

ধৈর্য ধারণের শিক্ষা

ধৈর্য ধারণ করা মোমিনের গুণ। সুরা আসরে যে চার শ্রেণির মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ততার বাইরে রাখা হয়েছে তার অন্যতম হলেন, পর¯পরকে ধৈর্যের উপদেশ প্রদানকারী। ইসমাঈলকে যখন আল্লাহর হুকুম কোরবানির কথা জানানো হয়েছিল, তখন তিনি প্রশান্ত চিত্তে উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি আল্লহর হুকুম পালন করুন, ইনশাআল্লাহ! আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সুরা সাফফাত : ১০২)। তার এই উক্তি আমাদের সব ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে।

অধীনদের আল্লাহর হুকুম পালনে আদেশ করা

কোরবানির ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে অধীনদের জানাতে হবে। হুকুম পালনে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেমটা ইবরাহিম (আ.) নিজ সন্তান ইসমাঈলকে করেছিলেন। নবীজি বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকে তার অধীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে (বোখারি : ২৪০৯)। অর্থাৎ রবের আদেশ স¤পর্কে অধিনস্তদের অবগত করা হয়েছে কি-না? তার হুকুম পালনে তাদের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে কি-না? তাদের প্রাপ্য হক আদায় করা হয়েছে কি-না? এ বিষয়ে অভিভাবকরা কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।

সামাজিক সাম্য ও পরামর্শের শিক্ষা

কোরবানি থেকে আমরা সমাজিক সাম্য ও পরামর্শের শিক্ষা পাই। ইবরাহিম (আ.) নিজ সন্তানের ওপর বিধান চাপিয়ে দেননি বরং তাকে আল্লাহর আদেশ স¤পর্কে জ্ঞাত করেছেন যে, আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে কোরবানি করতে, তোমার অভিমত কী? (সুরা সাফফাত : ১০২)। তাকে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছেন এবং তার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। আমাদেরও কর্তব্য পারিবারিক ও সামাজিক কাজে পরামর্শভিত্তিক কাজ করা। জোরপূর্বক নিজের মত অন্যের চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকা। এতে হিতে বিপরীত হয়। আর পরামর্শভিত্তিক আন্তরিকতাপূর্ণ কাজে বরকত হয়।

উৎকৃষ্ট সম্পদ দান করা

কোরআনে আদম (আ.) এর ছেলেদের ব্যাপারে এসেছে, তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত হয়েছিল। আর অন্যজনের গৃহীত হয়নি। (সুরা মায়েদাহ : ২৭)। তাফসিরে তাবারিতে এসেছে, আদমের দুই ছেলের একজন বকরি পালত, অন্যজন কৃষিকাজ করত। বকরি পালনকারী পালের উৎকৃষ্ট বকরিটাকে কোরবানির জন্য নির্ধারণ করেন এবং আল্লাহ তার কোরবানি কবুল করেন। আর কৃষক আবাদের নিকৃষ্ট ফসলকে কোরবানির জন্য বাছাই করেন। যার কারণে তার কোরবানি কবুল হয়নি।

আদেশ পালনে অজুহাতের আশ্রয় না নেওয়া

ইবরাহিম (আ.) এর বিনাবাক্যে প্রিয় সন্তানকে জবেহ করা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহতায়ালার আদেশের সামনে বান্দার কথা বলা অনুচিত। কোনো প্রকার অজুহাত ছাড়াই আল্লাহর আদেশ মেনে নেয়াই বান্দার জন্য কল্যাণকর। মূলত অজুহাত হলো, আদেশ আমান্য করারই একটি দিক। পিতা-পুত্র কেউ রবের আদেশে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলেননি। বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিয়েছেন আল্লাহর বিধান। যার কারণে তারা সফলকাম হয়েছেন দুনিয়া এবং আখেরাতে।

লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব, রংপুর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত