চীনে সং শাসনামলের মুসলিম বণিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সং বংশ চীনের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রতিপত্তিশালী হয় ৯৬০ সালে। কাইফেং বা বিয়নজিং এ রাজধানী স্থাপন করে শুরু হয় সং সাম্রাজ্যের যাত্রা। যদিও এ সময় মাঞ্চুরিয়া, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চীনের কিছু এলাকায় ভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ছিল, কিন্তু বৃহত্তর চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তা সমস্যা তৈরি করেনি। সং সাম্রাজ্য মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ককে প্রগাঢ় করে তোলে। মুসলিমদের বসবাস আগ থেকেই ছিলো চীনে। এবার বাড়তে থাকল ধীরে ধীরে। সং শাসকরা বিদেশি বাণিজ্যকে শুরু থেকেই প্রণোদনা দিতে থাকতেন। আরব বণিকরা তখন প্রচুর পরিমাণে আসেন চীনে। চীনা গবেষক ঝুফান ঝি দেখিয়েছেন তখনকার মুসলিম নগরগুলোর সঙ্গে চীনা যোগাযোগের চিত্র। এমন বহু শহরের বিবরণ দিয়েছেন তিনি, যেখান থেকে চীনে পণ্য আসত কিংবা চীনের পণ্য যে শহরগুলোতে যেত। শহরগুলো হচ্ছে মা-জিয়া গুও (মক্কা), চেং-বা গুও (জাঞ্জিবার) বাই-পা-লুও গুও (বারবেরা) উ-বা গুও (মিরবাত) নু-ফা (জুফার)। ঝং-লি গুও (মিগিয়ার্টিনিয়?া) ওয়েং-ম্যান গুও (সোহাল হারবার), জি-শি গুও (কিশ) বাই-দা গুও (বাগদাদ) বাই-সি-লুও গুও (বসরা) উ-সি-লি গুও (মসুল)। ঝুফান ঝির বিবরণে উঠে আসে মুসলিম শাসিত রোমান অঞ্চলে বাণিজ্য যোগাযোগের কেন্দ্রগুলো। এশিয়া মাইনরের বিবিধ এলাকার সঙ্গে চীনের বিনিময় ছিল। এদিকে মাগরিব ও দক্ষিণ স্পেনের যে এলাকা শাসন করতেন মু-লান-পি গুও (মুরাবিতুন) শাসকরা, সে এলাকাগুলো চীনের বাণিজ্য অংশীদার ছিল। ১১ শতক থেকে ১২ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীনে যেসব শহর থেকে মুসলিম বণিকদের আগমন অব্যাহত ছিল, সেসব শহর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও ইউরেশিয়া জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে আছে লু-মেই গুও (আরদে রুম), উ-সি-লি গুও (মিশর), ই-জেন-টুও গুও (আলেকজান্দ্রিয়া), কুন-লুন-চেং-কুই গুও (মাদাগাস্কার), মো-জিয়া-লি গুও (আলজেরিয়া), শি-হে (হাদরামাউতের উপকূল), ইয়া-সি-বাও-জিয়ান (ইসফাহান), জিয়া-লি-জি (কিলাত), পি রু য়ে (মাগরিব) ইলু (ইরাক), সিলিয়ান (সিরাফ), বাই লিয়ান (বাহরাইন), জি-জি (মাশহাদ), গান মেই (হরমুজ)। আরব রাজ্যকে চীনারা বলতো দা-শি। মুসলিম শহরগুলো চীনকে প্রধানত কৃষি ও শিল্পজাত নানা দ্রব্য সরবরাহ করত।
সেখানকার আদালতের সঙ্গে চীনা আদালতের যোগাযোগের রেকর্ড পাওয়া যায়। চীনা সাহিত্যে ওয়াই-গুও ঝুয়ান (বিদেশি জাতির জীবনী) গুরুত্বপূর্ণ। দশম শতকের পরে এসব সাহিত্যে বারবার উঠে আসেন মুসলিম বণিকরা। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ চীনের উপকূলগুলো। সং দরবারে মুসলিম রাষ্ট্রের কূটনৈতিক যোগাযোগ যেমন ছিল, তেমনি সং রাজারা প্রতিনিধি পাঠাতেন মুসলিম রাজ্যগুলোতে। বিশেষত সুপরিচিত মুসলিম বণিকদের সঙ্গে তাদের ছিল বিশেষ সখ্য। শুল্ক রাজস্বে তাদের বিশাল অবদানের জন্য সং রাজারা তাদেরকে প্রদান করেন সম্মানসূচক সরকারি খেতাব এবং এক ধরনের পুরস্কার। ১০০৩ সালে সোমালিয়া থেকে চীনে এসেছিলেন আবদুল্লাহ আল সুমালি। চীনা রেকর্ডে তার নাম হলো পো-লু-কিন-সান-মো-নি। তার জীবনী বিবৃত হয়েছে শ্রদ্ধার সঙ্গে। চঁ হলো হলো অনঁ এর চীনা প্রতিশব্দ। আরবদের ডাকনামের শুরুতে আবু বা পিতা কথাটা থাকে। চীনা রেকর্ডে পু-যুক্ত ব্যক্তিত্বদের উল্লেখ নবম শতক থেকে বাড়তে থাকে প্রচুর। ৯০৪ সালে চীন ভ্রমণ করেন পু-হে-লি-লি বা আবু হারিরি, সম্রাট তিয়ানউয় তখন ক্ষমতাসীন হয়েছেন মাত্র। ৯০৬১ সালে চীন ভ্রমণ করেন পু-মি বা আবু মামুন। তখন গান রাজবংশের জিয়নলংয়ের শাসনকাল। এর পরে আরবদের আগমন ও নানামাত্রিক ভূমিকার চিত্র বাড়ে। চীনে দেখা যায় ৯৬২ সালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন লি-ইয়া-মো বা মাহমুদ লি, ৯৭১ সালে লিহে-মো বা মাহমুদ লিহ, ৯৭৫ সালে পু-তুও-হান বা আবু আদ-দোহা), ৯৭৫ সালে পু-ইয়া-তুওলুও বা আবু আদিল), ৯৮৩ সালে, পু-ইয়া-তুও-লি (আবু আদিল) ৯৮৮ সালে, পু-পো-লান বা আবু বাকরান এবং মা-হে-উ বা মাহমুদ, ১০০৮ সালে পু-মৌ-হসি বা আবু মাহদি, ১০১৭ সালে পু-ইয়া-তুও-লুও-হসিহ বা আবু আবদুল্লাহ। আরবীয় বণিক আবু হামিদ (পু-হসি-মি) এবং তার ছেলে আবু আদিল (পু-ইয়া-তুও-লি) ভারত মহাসাগরে বহুবর্ষজীবী দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। তার বিবরণী সংরক্ষণ করেছে চীনা ইতিহাস। আবু আদিল যখন প্রথমবার সং রাজধানীতে এলেন, সম্রাট তাইজং তাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানালেন, সেই ঘটনা আরব বণিকদের গুরুত্বকে তুলে ধরে তখনকার চীনে। ৯৯৭ সালে আবারো আবু আদিলকে দেখা যায় রাজধানীতে। সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিরা তাকে বরণ করছেন। ১০০৪ সালের শরৎকালে আবু হিশাম (পু-জিয়া-জিন) আসেন সং রাজধানীতে। বাণিজ্যিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য প্রথমবার তিনি এলেও ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দে আসেন কূটনৈতিক কারণে। আরব রাজাদের দূত হিসেবে যারা এসেছিলেন, তাদের আলোচনা দীর্ঘ পরিসর দাবি করে। চীনা রাজদরবারে ৯৬১, ৯৭২ ও ৯৯০ সালে পুহেহ-সান বা আবু হাসান এর আগমনের তথ্য রয়েছে। পু-সি-মা-য়িন বা আবু ইসমাইল আসেন ১০৪৯ সালে, পু-মা উ বা আবু মাহমুদ এর আগমনের সময় হলো ১০৬৮ ও ১০৮৬ সাল। আবু মাহমুদ চীনে যে সব মহানুভবতার দৃষ্টান্ত রাখেন, সে জন্য ১০৬৮ সালে তাকে সম্রাটের তরফ থেকে গুই-ডি ল্যাংজিয়াং উপাধি দেওয়া হয়। বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে অবদানের জন্য তার পুত্র পু-শু-কে দেওয়া হয় সম্মানজনক Huaihua
Langjiang খেতাব।
চীনের উপকূলীয় বন্দরগুলোতে আরবদের বহু জনপদ তৈরি হয় একটি শুভেচ্ছার পরিবেশে। চোল, কুইলন, শ্রীবিজয়ায় মুসলিম বসতিগুলো সমৃদ্ধির নমুনা হয়ে ওঠে। ইন্দোচীন উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চম্পা ছিল ভারত মহাসাগর এবং উপকূলীয় চীনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট, এখানে আরবদের বাণিজ্যিক প্রভাব ছিল ব্যাপক। চীনে বসবাসকারী আরবরা চীনের পণ্য সরবরাহ করত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, মধ্য এশিয়ায় এবং আরব বিশ্বে। চীনে আগত মুসলিম বণিকরা প্রধানত ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র পথ ব্যবহার করতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় চীনা সাহিত্যের রেকর্ডে।
দশম শতকে ওয়াং ইউ-চেং ভাষ্য থেকে পরিষ্কার হয় যে, আরব শাসিত অঞ্চল ও চম্পা থেকে চীনে আগমনকারী অসংখ্য লোক মূলত লিপ্ত ছিলেন বাণিজ্যে। তাদের মাধ্যমে যে নতুন বসতি গড়ে উঠেছিল, সেটা অনুমান করা যায়। সং আমলে মুসলিম প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলের বৈদেশিক বাণিজ্য মুসলিমরা নিয়ন্ত্রণ করছিল। রাজনৈতিক কারণেও চীনের সম্রাট বহুসংখ্যক আরব জনগোষ্ঠীকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে আসেন। শ্রী বিজয়া ছিল অভিজাত মুসলিমদের একটি কেন্দ্র। সম্পদশালী ব্যবসায়ীরা সেখানে স্থায়ী আবাসন গড়েন। সুংদের রাজধানীর সঙ্গে তাদের ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। ৯৯২ সালের শীতকালে, গুয়াংজু-এর কর্মকর্তা জানান যে পু-ইয়াতুও-লি (আবু আদিল) গত বছর রাজধানী (কাইফেং) থেকে বাড়ি ফেরার পথে শুনলেন তার দেশে জাভার লোকেরা আক্রমণ করেছে। ফলে তিনি এক বছর গুয়াংজুতে থেকে গেলেন। পরে এবারের বসন্তে যখন তিনি জাহাজে করে চম্পা যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিকূল বাতাসের কবলে পড়লেন। আবার গুয়াংজুতে ফিরে এলেন।
পু-ইয়া-তুও-লি ছিলেন এক আরব বণিক। শ্রীবিজয়াতে তিনি বসবাস করতেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনের মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্যে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
শ্রীবিজয়া ও জাভার যুদ্ধ এবং প্রতিকূল বাতাসের কারণে তিনি দীর্ঘদিন গুয়াংজুতে বসবাস করেন। ১০১২ সালে, উ-সি-হু-লুহুয়া নামে একজন আরব গুয়াংজুতে এসেছিলেন। অনেক দূর থেকে এসে তিনি রাজবংশের সভ্য বিষয়াবলির প্রশংসা করেন।
পারস্য উপসাগরে অবস্থিত জাভা এবং বোর্নিওতে বহু আরবের স্থায়ী নিবাস ছিল। চীন সাগরের নানা দ্বীপ ও উপকূলে বহু আরব বাসিন্দা ছিলেন।
জাভার সহকারী প্রতিনিধি পু-ইয়া-লি বা আবু আলী চীনে এসেছিলেন ৯৯২ সালে। জাভার বাণিজ্যের দেখভাল করতেন বোর্নিওর সহকারী দূত আবু আলী এবং তার গাইড পু-লু-জি বা আব্দুল্লাহ। বোর্নিওতে ৯৭৭ সালে এসেছিল একটি বিদেশি কাফেলা। যাদের সবাই ছিল আরব। মুসলিম ব্যবসায়ীদের আরেকটি কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলের কুইলন এবং মাদ্রাজের চোল বন্দর।
চাল থেকে চীনে যান পু-জিয়া-সিন (আবু কাশিম)। এটি ১০১৫ সালের ঘটনা। ১০৩৩ সালে সেখান থেকে আসেন কূটনীতিক পু-ইয়া-তুও-লি (আবু আদিল)।
নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকে চোলে আরব জনসংখ্যা ছিল প্রচুর। যারা দেশে ও বৈদেশিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তাদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ওমানের কালহাত বন্দর থেকে আগত আবু আলী ও তার বংশধররা এখানকার মন্ত্রিত্ব ও প্রশাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চীনের উপকূলীয় বন্দরগুলো থেকে আরব ব্যবসায়ীরা প্রচুর পরিমাণে ধূপ, হাতির দাঁত ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতেন। ৯৯৩ সালে আরব জাহাজের মালিক পু-হসি-মি। (আবু হামিদ)।
য়াংজুতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। তার ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন লি-ইয়া-উ (মাহমুদ লি)। দা-শি (আরব রাজ্য) থেকে তার দূত সংগ্রহ করেন বিপুল পরিমাণে হাতির দাঁত, এক হাজার আটশত লোবান, বিপুল পরিমাণে লোহার যন্ত্রপাতি, সুতির কাপড় দিয়ে সূচিকর্ম করা, লাল সিল্ক, রঙিন ফুলের নকশাসজ্জিত বিদেশি ব্রোকেডের চারটি বোল্ট, সুন্দর পাড় বোনা সাদা কাপড়ের গাঁট, একটি কাচের বোতল, বিরল ধূপের টুকরো ও একশো বোতল গোলাপজল। ১১৩১ সালে আরবীয় বণিক পু-ইয়া-লি (আবু আলী) বাণিজ্য করতে গুয়াংজুতে আসেন। রাজার প্রতি সম্মান হিসেবে তিনি তাকে উপহার দেন ২০৯টি বড় হাতির দাঁত, পঁয়ত্রিশটি বড় গন্ডারের শিং। সে সময়ের সরকারি দাম অনুযায়ী এর মূল্য ছিল ৫ কোটি ইয়েন। রাজকীয় নানা অনুষ্ঠানে আরব ব্যবসায়ীরা সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতেন নিয়মিতই। সম্রাটের তরফে তারা উচ্চ আসন ও আতিথ্য লাভ করতেন।