ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হজে রুহানিয়্যাত লাভের পূর্বশর্ত

হালাল উপার্জনের সঙ্গে ইখলাসপূর্ণ আমল

হজ মুসলিম ঐতিহ্য। বান্দা ও প্রভুর মাঝে প্রেমময় সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতার ইহলৌকিক নিদর্শন। হজে আছে মানবতার শিক্ষা। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে নিজেকে বিনীতভাবে পেশ করার এবং বান্দা বস্তুজগৎ থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক রবের প্রেমে মজে থাকার তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা। হজ্জে মাবরুর লাভে হাজীদের মেনে চলতে হয় কিছু নিয়মকানুন। নিতে হয় পূর্বপ্রস্তুতি। জানতে হয় হজ সম্পাদনে প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ। নানান মাসায়েল। হজ সম্পাদনে কীভাবে ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা যায় এ এক অভিজ্ঞতা লব্ধ বিষয়। একাধিকবার হজ সম্পাদনকারী অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর, খ্যাতিমান লেখক, বিদগ্ধ আলোচক ড. হাফেজ এবিএম হিজবুল্লাহর সঙ্গে হজ বিষয়ে কথা বলেছেন মুহাম্মদ জাকারিয়া হারুন
হালাল উপার্জনের সঙ্গে ইখলাসপূর্ণ আমল

আলোকিত বাংলাদেশ : হজে যাওয়ার আগে একজন হজযাত্রীর কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার? হজের মধ্যে রুহানিয়্যাত পয়দা করার জন্য আপনার পরামর্শ কী?

ড. হিজবুল্লাহ : হজে যাওয়ার আগে একজন হজযাত্রীকে হজের বিধি-বিধান মাসায়েল ও আহকাম সম্পর্কে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন ধরনের ভুলত্রুটির মুখোমুখি হতে হবে। হজে রুহানিয়্যাত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হলো, হালাল উপার্জনের সঙ্গে ইখলাসপূর্ণ আমল। অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টি প্রাপ্তির অনুভূতি জাগ্রত থাকা।

আলোকিত বাংলাদেশ : হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজের মৌলিক আমলগুলো কী কী?

ড. হিজবুল্লাহ : ওমরার আমল : ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ, হলক বা চুল কাটা। এতে ওমরা হয়ে যাবে। হজের আমল : পাঁচ স্থানে (মিনা, আরাফা, মুজদালিফা, জামারা ও হারাম) ৯ আমল। ১. আট তারিখে হজের জন্য ইহরাম (ফরজ) পরে মিনায় গমন ২. ৯ তারিখে জোহরের সময় থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান (ফরজ) ৩. ৯ তারিখ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় ইশার সময় একসঙ্গে মাগরিবের সালাত আদায় করে রাত যাপন ৪. ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর ফজরের সালাত আদায় করে জোহরের সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপ ৫. যাদের জন্য হজের কোরবানি ওয়াজিব (তামাত্তু ও কিরান হজ আদায়কারী) তারা কোরবানি দেবেন। ৬. মাথার চুল হলক বা ছাঁটার পর হালাল হবেন। ৭. ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ মাগরিবের আগ পর্যন্ত তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ) সম্পন্ন করতে হবে। ৮. আগে সাঈ না করে থাকলে এখন সাঈ করা। ৯. বিদায় তাওয়াফ করা।

আলোকিত বাংলাদেশ : অনেকে মনে করেন, বারবার নফল হজ না করে, সে টাকা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া; এতে দরিদ্রদের উপকার হয় কিংবা অর্থের সাশ্রয় হয়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

ড. হিজবুল্লাহ : কেউ কেউ এমন মন্তব্য করে! যদি তাই হতো তাহলে বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত বক্তব্যের কী ব্যাখ্যা হবে। তোমরা পরপর হজ ও ওমরাহ পালন কর। কেননা হজ ও ওমরাহ দারিদ্র্য ও গোনাহ দূর করে যেমন হাপর লোহার ময়লা দূর করে। (তিরমিজি : ৮১০)। অন্য হাদিসে বর্ণিত, এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহ মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের কাফফারা স্বরূপ। (বোখারি : ১৭৭৩)। এতে প্রমাণিত হয়, বারবার হজ ও ওমরাহ করা যায়। এখানে অর্থ সাশ্রয়ের বিষয়টি অবান্তর। আর গরিব-দুঃখীদের কথা বলছেন? তাদের জন্য জাকাত ও বিভিন্ন ধরনের সদকার কথা বলা আছে। সেগুলো সঠিকভাবে আদায় করে যোগ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছালে অবশ্যই তারা উপকৃত হবে। তাই বলে যাদের একাধিকবার হজ-ওমরা করার সুযোগ আছে তাদের নিষেধ করা ঠিক হবে না। তবে কেউ যদি এমন নিয়তে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বারবার হজ-ওমরাহ থেকে সেই অর্থ বিলিয়ে দেন বা সদকা করেন, এটা তার নিয়ত অনুযায়ী গণ্য হবে। আল্লাহ উত্তম জানেন এবং উত্তম প্রতিদানদাতা।

আলোকিত বাংলাদেশ : হজবিষয়ক বিধিনিষেধ না জানার কারণে হাজীদের কী কী ভুল হয়ে থাকে? এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ড. হিজবুল্লাহ : হজ ও ওমরার হুকুম আহকাম না জানার কারণে হাজী সাহেবদের বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি হয়ে যেতে পারে। যেমন, ইহরাম অবস্থায় আতর, সুগন্ধিযুক্ত তেল ও সাবান ইত্যাদি ব্যবহার করা। ইহরামের কাপড় পরলেই নিয়ত হয় না। বরং নিয়তের পর তালবিয়া পড়লে নিয়ত পূর্ণ হয়। কোরবানির আগে হালাল হয়ে যাওয়া। তাওয়াফে নির্দিষ্ট দোয়াকে জরুরি মনে করা। রমল ও ইজতিবার ক্ষেত্রে ভুল করা ইত্যাদি। যে কোনো আমলের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিজ্ঞ কোনো আলেমকে প্রশ্ন করে জেনে নেয়ার মাঝেই রয়েছে ভুল থেকে মুক্তির উপায়।

আলোকিত বাংলাদেশ : মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা কতটুকু?

ড. হিজবুল্লাহ : বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের রয়েছে অনন্য এক অবদান। হজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি আমলের প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা অনুধাবন করতে পারব এর প্রাণবন্ত আবেদন। সব পুরুষের ইহরামের কাপড় এক ও অভিন্ন। ধবধবে সাদা বস্ত্রে আবৃত এক কাফেলার অভিযাত্রা। নারী-পুরুষ সব মুহরিমের এক আকুতি ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ...।’ এক ঘোষণা। হে রব! আমরা সবাই আপনার বান্দা। আমাদের মাঝে নেই কোনো ভেদাভেদ। কে কোন বর্ণের, কে কোন দেশের, কে কোন ভাষার এদিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ইহরামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সব আমল এক ও অভিন্ন। সবাই আমরা তোমার ইবাদতে মগ্ন। আমরা চাই আপনার সন্তুষ্টি, চাই জান্নাতের আপ্যায়ন। চাই জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এ সব কিছুর শিক্ষা একটাই, হে মানব সন্তান! তোমরা এক স্রষ্টা আল্লাহর সৃষ্টি। তোমাদের মাঝে নেই কোনো ভেদাভেদ। তাঁর কাছে তোমাদের সম্মানের একমাত্র মানদ- তাকওয়া। তোমাদের যে যত বেশি মুত্তাকি হবে, সে হবে তার কাছে তত বেশি সম্মানিত। (হুজুরাত)।

অতএব হে আদম সন্তান, হজ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ধাবিত হও। মানবসেবায় নিজের মেধা ও যোগ্যতা ব্যয় কর। যে যে অবস্থানে আছেন সেখান থেকেই তিনি তার কার্যক্রম পরিচালনা করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবে। এটাই হজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষা। আল্লাহ আমাদে তৌফিক দান করুন। আমিন।

আলোকিত বাংলাদেশ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ড. হিজবুল্লাহ : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত