কালের চাকা ঘুরে আবারো আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে প্রভুপ্রেমের স্মৃতিবিজড়িত অবিস্মরণীয় মাস ‘জিলহজ’ এই জিলহজ মাসেই বিশ্বের সমগ্র প্রান্তের উম্মতে মুহাম্মদি একত্রিত হন পবিত্র মক্কায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা আদায় করে থাকেন প্রেমময় ইবাদত হজ। এ পবিত্র মাসেই আল্লাহপাকের হাবিব মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন বিদায় হজের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যা বিশ্ব সভ্যতায় চিরস্মরণীয় এক মাইলফলক।
কাবার চত্বর ও মক্কানগরীর পথঘাট
মক্কার অলিগলি এখন তালবিয়ার সুললিত ধ্বনিতে আলোড়িত মুখরিত, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লাশারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নালহামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকালাক।’ অজুত কণ্ঠের সম্মিলিত উচ্চারণে, অপূর্ব তালবিয়ার ভাবগাম্ভীর গুঞ্জরণে হারাম শরিফের চারদিক এখন ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত, বিপুলভাবে স্পন্দিত। চলছে অবিরাম পবিত্র বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, হচ্ছে অনবরত সাফা-মারওয়ার সায়ি। আত্মনিবেদন, আত্মসমর্পণ, মহান আল্লাহর ইচ্ছার সিন্ধুতে আপনাকে বিলীন করে দেয়ার সে এক অপূর্ব দৃশ্য, দিলকাশ মানযার!
বিশ্ব ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব
হজে বিশ্ব ঐক্য ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার সে কী অপূর্ব নজির, চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত! কারো কোনো গর্ব নেই, অহংকার নেই, উলঙ্গ মস্তকে একপ্রস্থ সেলাইবিহীন সফেদ কাপড় পরিধান করে আর একপ্রস্থ গায়ে দিয়ে, একই বেশে একই কালিমা উচ্চারণ করে একই কাবাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে উম্মতে মুহাম্মদির ওইসব আল্লাহভক্ত, খোদাপাগল পুণ্যার্থী। ঐক্যের, একতার সে কী সুমধুর দৃশ্য! সাদাকালোর ভেদাভেদ নেই, আরবে আজমে ব্যবধান নেই, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ফারাক নেই। আহ ঐক্যের সে কী অনবদ্য, অনুপম, হৃদয়জুড়ানো, মনমাতানো চিত্র! বর্ণ, ভাষা, গোত্র, আঞ্চলিকতার সব দেয়াল এখানে টুটে গেছে, বৈষম্যের সব প্রাচীর এখানে ধ্বংস হয়ে গেছে। এক আল্লাহর বান্দা, এক আদমের সন্তান, একই নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত, এক কোরআনের অনুসারী, একই চন্দ্র-সূর্যের স্নিগ্ধ ও গনগনে আলো উপভোগকারী, একই আসমানের নিচের ও জমিনের ওপরের বাসিন্দারা আজ এ পবিত্র হজের বদৌলতে আল্লাহপাকের হারামে এসে একাকার হয়ে গেছে। মহামিলনের, মহা ঐক্যের, মহা সহমর্মিতার, মহা ভ্রাতৃত্বের সে এক অভাবনীয়, অকল্পনীয় অবস্থা! যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য এই যে, আজ মুসলমান বিশ্বের সর্বত্র জালেম কুফরি শক্তির হাতে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অপদস্থ, নিপীড়িত। কিন্তু কী এর কারণ? অথচ এমনটি তো কাম্য ছিল না। কারণ মুসলমানদের রয়েছে ১৫০ কোটি সুদক্ষ জনশক্তির ৩০০ কোটি হাত, আছে প্রায় ৬০-৬৫টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আছে মুসলিম বিশ্বের পেট্রো-ডলার ছাড়াও অফুরন্ত খনিজ সম্পদ, সর্বোপরি মুসলমানের আছে চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থান। কিন্তু এত কিছুর পরও কেন আজ মুসলমানের এ করুণ দশা? কেন আজ তারা সবার উপহাসের পাত্র? কেন নিন্দিত, নিগৃহীত? এর মূল কারণ হলো আজ মুসলমানের মধ্যে ঐক্য নেই, একতা নেই, গায়েব হয়ে গেছে সহানুভূতি, অদৃশ্য হয়ে গেছে মমত্ববোধ। কথাগুলো তিক্ত হলেও এটাই বাস্তব সত্য। অথচ হজের শিক্ষা ছিল- ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (আল-ইমরান ১০৩)। হজের মূল তাৎপর্য তো ছিল ‘নিশ্চয়ই সব মোমিন ভাই ভাই।’ (হুজুরাত ১০)। হজের নসিহত তো ছিল ‘সব মুসলমান এক দেহের ন্যায়’-এর অনুপম মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সব খোদাদ্রোহী, কুফরি, তাগুতিবাদী ও বাতেল শক্তিগুলোর মোকাবিলায় সিসাঢালা প্রাচীর সৃষ্টি করা। কেননা বিদায় হজের ভাষণে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘হে ভ্রাতৃমণ্ডলী, আমার বাণী মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করতে চেষ্টা কর। জেনে রেখো, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সবাই একই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। সমগ্র দুনিয়ার সব মুসলমান একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। স্মরণ রেখো, বাসভূমি ও বর্ণ নির্বিশেষে সব মুসলমান সমান। আজ থেকে বংশগত কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত হলো। পরস্পরের প্রাধান্যের একমাত্র মাপকাঠি হলো, খোদাভীতি বা সৎকর্ম। সে ব্যক্তিই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলিন, যে নিজকার্য দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আর অন্যটি হলো আমার সুন্নাহ।’ (সারসংক্ষেপ)। হজের প্রকৃত উদ্দেশ্য তো ছিল জাতি, গোত্র, বংশ, বর্ণ মর্যাদা পায়ে দলে, এক আল্লাহর বান্দা ও এক রাসুল (সা.)-এর উম্মত হিসেবে ইসলামি ঐক্যের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখা। সুতরাং আসুন; আমরা হজের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করে, মূল চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, পৃথিবীর শান্তি ধ্বংসকারী সব বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি, একটি সুন্দর ভ্রাতৃতুল্য সমাজ গড়ি, একই পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার শপথ গ্রহণ করি। তবেই হবে পৃথিবী সুন্দর। সুশৃঙ্খল ও শান্তিময়।
লেখক : তরুণ আলেম, সাংবাদিক