ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মনের পশু জবাই ও কিছু কথা

জাহিদ প্রভাত
মনের পশু জবাই ও কিছু কথা

হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী বল? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, (আপনি) তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন। (সুরা সাফ্ফাত : ১০২)।

ওই আয়াতে মহান আল্লাহর ইচ্ছায়, হজরত ইবরাহিম আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য প্রিয় পুত্র ইসমাঈলের দ্বারস্থ হলেন। প্রিয় পুত্র ইসমাঈল পিতার তরবারির নিচে স্বেচ্ছায় গলা বাড়িয়ে দিয়ে পিতার কাজটা সহজ করে দিলেন। আর মহান আল্লাহ একটা স্বপ্নের পরীক্ষায় নবী ইব্রাহিমের উত্তীর্ণ হতে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।

কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, নৈকট্য লাভ। আর জবাই শব্দের অর্থ প্রাণীবধ, হত্যা, রক্ত প্রবাহিত করা। এখন উৎসর্গের মতো স্রষ্টা নির্ধারিত একটা মহান সিদ্ধান্ত কীভাবে পশু জবাই তথা হত্যায় রূপান্তরিত হলো? কারা করল? এবং তৃতীয় পক্ষের ঠিক করে দেওয়া বয়ান আমরা অন্ধের মতো আঁকড়ে ধরে একটা ধর্মীয় প্রথাকে মনের পশু দমনে অনুবাদ করে নিলাম, কীভাবে নিলাম? আমরা প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করি, আর হিংস্র কোনো কিছু দমন করি। গরু, ছাগল, দুম্বা এগুলোকে আক্ষরিক অর্থে পশু ধরলেও এগুলো তো সবই গৃহপালিত পশু, এগুলোকে বছরজুড়ে আমরা দমন করি না, বরং পরম স্নেহে মমতা দিয়ে লালন-পালন করি। কোরবানি মূলত পশু জবাই করার মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করার নাম, এ থেকে শিক্ষা হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ইবাদতকে খালেস করা এবং তাকওয়া অর্জন করে মনুষ্যত্ব লাভ করা। কোরবানির সরাসরি অর্থ মনের পশু জবাই নয়। এটি ভুল ব্যাখ্যা।

১৩২৭ বঙ্গাব্দে সবুজপত্র পত্রিকায় তরিকুল ইসলাম নামক এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈদুল আজহার পশু কোরবানিকে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তুলনা করে একটা প্রবন্ধ রচনা করেন। তার বয়ানে কোরবানির নিষ্ঠুরতার কর্মযজ্ঞে চারিপাশ বিষাদে ছেয়ে যায়, সেখানে আনন্দ কোথায়? তার লিখিত প্রবন্ধটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নজরে আসে। সেই প্রবন্ধের জবাব হিসেবে তিনি ৭৪ লাইন দীর্ঘ ‘কোরবানি’ কবিতাটি ১৩২৭ বঙ্গাব্দে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা প্রকাশ করে, যা পরবর্তীকালে কবি নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি কোরবানিকে হত্যাযজ্ঞ হিসেবে দেখানোকে প্রত্যাখ্যান করে সত্য-গ্রহ তথা সত্যকে গ্রহণ হিসেবে চিত্রিত করেন।

“ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন” লাইনটি তিনি এ কবিতায় ১৭ বার ব্যবহার করেছেন। পুরো কবিতায় কোরবানির একটি সত্য ঘটনার বয়ান এবং হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতিনীতির চর্চাকে তিনি সুনিপুণভাবে কবিতায় চিত্রিত করেছেন।

“ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।

জোর চাই আর যাচ্না নয়

কোরবানি-দিন আজ না ওই?

বাজ্না কই? সাজ্না কই?”

একই কবিতায় উপরিউক্ত পঙ্ক্তিগুলোতে তিনি আকুতি মিনতি পরিহার করে সবাইকে কোরবানির উৎসবে মেতে উঠতে বলেছেন। তিনি বাজনার ছন্দে সাজতে বলেছেন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোরবানির আলোচনা শুধু ‘কোরবানি’ কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি কোরবানির ওপর আরও কবিতা রচনা করেছেন। তিনি শহীদি ঈদ শিরোনামে কোরবানির ওপর ৯৬টি পঙ্ক্তি বিশিষ্ট একটি কোরাস গান রচনা করেন, যা পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী কবির বিখ্যাত ভাঙ্গার গান কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।

এ কবিতার যে শব্দগুচ্ছগুলো ধার করে আমরা কোরবানির মতো একটি পবিত্র রীতিকে ভুলভাবে অনুবাদ করছি, তা হলো

‘মনের পশুরে কর জবাই’

কিন্তু এ লাইনের পরবর্তী এবং পূর্ববর্তী পঙ্ক্তিগুলো পাঠ করলেই আমরা কোরবানির মতো একটি পবিত্র চর্চাকে ‘মনের পশুরে কর জবাই’ স্লোগানে সীমাবদ্ধ করতাম না। শহীদি ঈদ একটি দীর্ঘ রচনা। কোরবানির ইতিহাস থেকে শুরু করে অনেক কিছু তিনি এ লেখায় আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ লেখার চারটি শব্দকে নিজেদের সুবিধা মতো ব্যবহার করে একটি ঐশ্বরিক চর্চাকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেললাম। খুঁজে দেখিনি কী কারণে, কোন প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহী কবি এ শব্দগুচ্ছকে এ কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। আশা করি নজরুল গবেষকরা সেইদিকে আলোকপাত করবেন।

মনের মধ্যে পশু থাকে না, তবে পশুবৃত্তি বা পাশবিকতা থাকতে পারে। সেই পাশবিকতা দমনের অসংখ্য উপায় আছে। মানবসেবা করা যায়, সিয়াম সাধনা, ধ্যান করা যায়। পশুবৃত্তি রেখে কোরবানি করলে কোরবানি তথা প্রিয় বস্তু উৎসর্গ কবুল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য প্রয়োজন তাকওয়া। যে তাকওয়ার জন্য আল্লাহ হাবিলের পশু কোরবানি কবুল করেছিলেন, আর তাকওয়া না থাকার কারণে কাবিলের ফসল কোরবানি কবুল করেননি। তাকওয়া ছিল বলেই নবী ইব্রাহিম একটি স্বপ্নকে স্রষ্টার আদেশ হিসেবে শিরোধার্য করেছেন। গরু, ছাগলের মতো নিরীহ পশুকে হিংস্র পশু হিসেবে উপস্থাপন করাও এক ধরনের অবিচার। তাই কোরবানিকে স্রষ্টার জন্য প্রিয় বস্তু উৎসর্গ এবং স্রষ্টার সন্তুষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি। মনের পশু জবাই করতে গিয়ে নিরীহ প্রাণীদের হিংস্র পশু হিসেবে চিত্রিত না করি।

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত