মিং আমল : মুসলিম সংস্কৃতি, প্রতিভা ও চীনা মানস

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চীনে মিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। মঙ্গোল বিজেতা কুবলাই খান প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান রাজবংশের প্রায় এক শতাব্দীর শাসন প্লেগ, ঘন ঘন প্রাকৃতিক, দুর্যোগ, গণঅসন্তোষ আর ১৩৪০সালে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহে জেরবার হয়। চীনের তৎকালীন জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় প্লেগে। ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক বেইজিংয়ে রাজধানী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান ইউয়ান রাজবংশ ঘোষণা করেন। মঙ্গোল আক্রমণের ফলে এ রাজবংশের জন্ম হয়। ঝিন রাজবংশকে পরাজিত করে মঙ্গোলরা চীনে শাসন বিস্তার করে। বিজয়ী মোঙ্গলদের এক অংশ স্তেপ অঞ্চলে যাযাবর জীবনকে পছন্দ করে। কিন্তু প্রধান অংশটি চীনা সমাজে মিশে যায় এবং চীনা রীতিনীতিও গ্রহণ করে। সাম্রাজ্য যখন আপন যৌবনে, তখনই যুদ্ধ, দুর্যোগ ও অঘটনের ঘনঘটা তাকে বিধ্বস্ত করতে থাকে। চীনের কোনো কোনো জাতীয়তাবাদী সূত্র দাবি করে, মঙ্গলদের আগ্রাসনের আগে চীনের জনসংখ্যা ছিল ১২০ মিলিয়ন। ১২৭৯ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর চীনের জনসংখ্যা ছিল ৬০ মিলিয়নের মতো। ইউয়ানদের উৎখাত করে মিং রাজবংশ। এটা ১৩৪৮ সালের ঘটনা। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে মুসলিমদের ছিলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ল্যান ইউ (মৃত্যু-১৩৯৩ খ্রি.) ছিলেন মিং রাজবংশের প্রথম দিকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনীতিক। সাম্রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন তিনি। ডিংগুয়ান প্রদেশের আনহুইতে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম হয় তার।

বর্তমান মিয়ানইয়াংয়ের চারপাশে মিয়ানঝো জয় করেন তিনি। ইউয়ান রাজবংশের বিরুদ্ধে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ইউয়ানদের বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে যখন সেনাপতি জু-দা ইয়ানমেন গীরিপথ থেকে ফিরে আসেন, তখন তিনি আরো অগ্রসর হন সাহসিকতার সঙ্গে। এবং মাউন্ট লুয়ান ও তুলা নদীর তীরে অল্পসংখ্যক সৈন্য দিয়ে ইউয়ান সেনাদের পরাজিত করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তিব্বত জয় করেন। যার ফলে সম্রাট তাকে বিপুল জমি ও জায়গির দেন এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রিয় খেতাবে ভূষিত করেন। তার উপাধি হয় ইয়ংচ্যাংয়ের মার্কুস! ১৩৮১ সালে দক্ষিণাঞ্চল বিজয় এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি অধিকতরো সম্মান লাভ করেন এবং তার মেয়েকে দেওয়া হয় সম্মানজনক প্রিন্সেস উপাধি। ১৩৮৭ সালে তিনি উত্তর ইউয়ানের লিওয়াডংয়ের নাহচুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। নাহচু পরাজিত হন তার কাছে। ১৩৮৮ সালে সম্রাট হংউ তাকে জেনারেল ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর ল্যান ইউ ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে যাত্রা করেন উত্তর ইউয়ানের শাসক উসখাল খানের মোকাবিলায়। অভিযানে তিনি খানকে পরাজিত করেন এবং বন্দি করে নিয়ে আসেন খানের পরিবারের ১০০ জনেরও বেশি সদস্য, ৭ লাখ ৭ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক, ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি গবাদিপশু। খানের রাজকীয় সিলমোহর, দামি জিনিসপত্রও নিয়ে আসেন সেনাপতি। খান কারাকোরামে পালানোর চেষ্টা করেও প্রাণে রক্ষা পাননি। এ কৃতিত্বের ফলে সম্রাট তাকে আরো বেশি সম্মানিত করেন। ১৩৯২ সালে ল্যান ইউ বিদ্রোহী জেনারেল ইউয়েলুটিমুয়েরকে চূর্ণ করেন, তার পুত্রকে বন্দি করেন। এরপর তিনি ক্রউন প্রিন্স ঝু বিয়াও এর শিক্ষক মনোনীত হন। কিন্তু বিপুল অর্জন ও পদমর্যাদা তাকে দাম্ভিক করে তোলেছিল। সম্রাট তার অপ্রতিহত ক্ষমতাকে এক সময় হুমকি বিবেচনা করেন। ১৩৯৩ সালে বিদ্রোহের প্রস্তুতির অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আরো ১৫ হাজার মানুষকে। ঐতিহাসিকভাবে এ ঘটনা ল্যান ইউ নামে পরিচিত। কিন্তু ল্যান ইউ-এর মৃত্যুই সম্রাটের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল।

মুইং (১৩৪৫-১৩৯২) ছিলেন মিং রাজবংশের একজন রাজনীতিবিদ ও জেনারেল। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হংউ তাঁকে পালকপুত্র বলে অভিহিত করতেন। যদিও এ উপাধি ছিল নিছক প্রতীকী। মিং সাম্রাজ্যের প্রতি বিশ্বস্ততার পুরস্কার স্বরূপ তাকে উয়ানান প্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। মুইং এবং তার পরবর্তী বংশধররা মিং সাম্রাজ্যের সুরক্ষায় কাজ করেন। যুগযুগ ধরে তারা রাজনীতি ও সামরিকতায় ছিলেন রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৬৫০ দশকের শেষের দিকে মুইংয়ের বংশধর মু তিয়ানবো ছিলেন দক্ষিণ মিংয়ের শেষ সম্রাট ইয়ংলির অন্যতম উপদেষ্টা। পলাতক সম্রাটকে তিনি বার্মায়ও সঙ্গ দিয়েছিলেন।

চীনা মুসলমানদের মধ্যে মু উপাধিটিও প্রচলিত এবং মনে করা হয় মু দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মুহাম্মদ। জোনাথন নিমান লিপম্যান লিখেছেন, মুইং হচ্ছেন এমন জেনারেলদের একজন, যাদেরকে দ্ব্যর্থহীনভাবে মুসলিম বলে দাবি করেন চীনা মুসলিম পণ্ডিতরা।

হুই জনগোষ্ঠীর সদস্য এই সেনানায়ক অনেকের বিচারে মুসলিম নন। কিন্তু ঐতিহাসিক লি কিংশেং দেখান মু ইং নিয়মিত ভেড়ার মাংস খেতেন, তার স্ত্রী ছিলেন মুসলিম এবং জিনিং এলাকায় তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা প্রমাণ করে তিনি একজন মুসলিম ছিলেন।

মিং সেনাপতি হু দাহাই (মৃত্যু : ১৩৬২) যে মুসলিম ছিলেন, এতে কারো কোনো ভিন্নমত নেই। চীনা ইতিহাসে তিনি পিনয়িন নামেও বিখ্যাত। মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠায় সম্রাট ঝু ইউয়ানঝাং (হংউ সম্রাট)-কে তিনি সহযোগিতা করেন বিপুলভাবে। তিনি সমগ্র জিয়াংনান অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ঝু ইউয়ানঝাংয়ের রাজধানীকে সমৃদ্ধ করার জন্য ঝেজিয়াং থেকে বেশ কিছু সুপরিচিত পণ্ডিত এবং কর্মকর্তাকে পাঠান করেন। যাদের মধ্যে ছিলেন লিউ বোয়েন, সং লিয়ান, ইয়েচেন এবং ঝাং ই। হুর সৈন্যরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিল, এবং হু একবার বলেছিলেন “আমার যোদ্ধারা হয়তো লিখতে জানে না। তবে তারা কেবল তিনটি কর্তব্য জানে : হত্যা করবেন না, নারী ও মেয়েদের লঙ্ঘন করবেন না এবং কুঁড়েঘর বা খামারবাড়ি পুড়িয়ে দেবেন না। আনহুই অঞ্চলে মিং সাম্রাজ্যের অভিযানে তিনি বিরল সাফল্যের উদাহরণ রেখেছিলেন। প্রতিপক্ষ ‘মিয়াও’ রাজবংশের অনেক সেনাপতিকে তিনি বন্দি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিয়াউরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে শেষ করতে সচেষ্ট হয়।”

১৩৬২ সালের গোড়ার দিকে, মিয়াও সর্দার জিয়াং ইং, লিউ ঝেন এবং লি ফু ইয়ানঝোতের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আক্রমণের শিকার হন তিনি। এতে শহীদ হন হু। এর পর মিয়াওদের আক্রমণে তার ছেলে হু গুয়ানঝু এবং গেং জাইচেং শাহাদাতবরণ করেন। চীনের সামরিকতা ও যুদ্ধনীতিতে তাঁর প্রভাব যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান থেকেছে। তবে মিং সাম্রাজ্যের সামরিকতায় সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছেন মুসলিম সেনাপতি ইয়ানহেং বা চ্যাং য়ুচান (১৩৩০-১৩৬৯)।

রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট ঝু ইউয়ানঝাংয়ের অনুসারী ছিলেন তিনি এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। তাকে প্রকৃতপক্ষে মিং সাম্রাজ্যের স্থপতি বলা হয়। ১৩৫৫ সালে চীনে মঙ্গোল বিরোধী বিদ্রোহে তার ভূমিকা নজিরবিহীন। মিং সাম্রাজ্য তাই তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে বরাবরই। সাম্রাজ্যে তাকে দেওয়া হয় ‘য়ুয়ানশুইয়াই’ বা মার্শাল র‌্যাংক। বহু যুদ্ধ ও নৈরাজ্য মোকাবেলায় তাঁর সাফল্য কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। যুদ্ধে সাহসিকতা এবং শক্তিশালী পরাক্রমের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। তার ডাক নাম ছিল ‘চ্যাং হানড্রেড-থাউজেন্ড’। কারণ তিনি একাই এক লক্ষ সৈন্যের বাহিনীর সমান বীরত্বপূর্ণ ছিলেন। মনোমুগ্ধকর চেহারা এবং দুর্দান্ত শক্তিসহ একজন অটল মানুষ ছিলেন তিনি। ১৩৬৯ সালে বর্তমানের জুয়ানহুয়া প্রদেশের হেবেই শহরের পূর্বে নানজিংয়ে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে মিং সম্রাট শোকে অভিভূত হয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন। চ্যাং ইউচুনের তিন পুত্রও ছিলেন বিখ্যাত। তারা হলেন চ্যাং মাও, চ্যাং সেং এবং চ্যাং সেন। ঐতিহাসিক তান তা সেন এবং ডরুসি, গ্ল্যাডনিও চ্যাং ইয়ানকে হুই বা মুসলিম হিসেবে শনাক্ত করেন।

কুবলাই খানের ইউয়ান রাজবংশের ভিত্তিমূল চীনে ছিল না। মোঙ্গল বংশসূত্র থেকে আগত এ শাসকরা চীনকে যখন স্থিতিশীলতা দিতে পারছিলেন না, বিদেশিদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয় প্রচণ্ড। মুসলিম আগমনেও এর প্রভাব পড়ে। আরবদের আগমন অনেকটা বন্ধ হতে থাকে। তবুও নানা সূত্রে মুসলিমদের আগমনের একটি ক্ষীণ ধারা অব্যাহত ছিল। ভিনদেশি আতঙ্ক একদিকে ধূমায়িত হচ্ছিল চীনে, অপরদিকে কনফুসিয় দর্শন নতুন অবয়ব নিয়ে পুনরোজ্জীবিত হচ্ছিল। ইসলামের সাংস্কৃতিক প্রভাব এ সময়ে নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। সাগর তীরের এলাকাগুলোতে মুসলিম প্রভাব কমতে থাকে। কিন্তু তাতেও মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূমিকা কমেনি। কারণ ইসলাম কেবল সমুদ্রপথ দিয়েই চীনে প্রবেশ করেনি। পারস্য উপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে গুয়াংজু ও দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের অন্যান্য বন্দরে যাতায়াতকারী মুসলিম বণিকরা চীনের অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছিলেন দুই শতাধিক বছর ধরে। এর পাশাপাশি মধ্য এশিয়া হয়ে বোখারা, সমরখন্দ এবং উত্তর-পশ্চিম চীনের চাংআন (জিয়ান) টার্মিনাল এবং বেইজিংয়ের বাণিজ্য পথে মুসলিমদের শুধু যাতায়াত ছিল না, সেখানে মুসলিম বসতিগুলো চীনা সমাজের স্থায়ী অংশ হয়ে উঠেছে। মুসলিম গ্রামগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম উপস্থিতি স্থিতিশীল হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়ে, এতিমের প্রতিপালন, দত্তক গ্রহণ ইত্যাদি যেমন অব্যাহত ছিল, তেমনি ইসলামের মহান আদর্শ দিয়ে চীনা অধিবাসীদের আত্তিকরণের ধারা অব্যাহত ছিল। গুরুত্বপূর্ণ শহর ক্যান্টন, কুনমিং, সাংহাই, বেইজিং, ইউনান ও জিংজিয়াংয়ে মুসলিম উপস্থিতি ছিলো দৃষ্টিগ্রাহ্য ও ধারাবাহিক বাস্তবতা। সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও নগরজীবনে মুসলিমদের সক্রিয়তা কোনো বিদেশি আবহ তৈরি করত না।

লেখক : গবেষক আলেম