সমকামিতার অপরাধে লুত জাতির ধ্বংস
মো. আলী আশরাফ খান
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মহান আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, একমাত্র তাঁরই ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য। তাঁর দেখানো পথে নিজেদের পরিচালিত করার জন্য। কিন্তু মানুষ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ও বিপর্যয় ডেকে আনে। গভীর এক ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। ইহকাল ও পরকাল হারিয়ে বরণ করে নেয় মহাক্ষতিকে। অভিশপ্ত হয়ে দোজখে গমন করে অনন্তকালের জন্য। তেমনি ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ্যযোগ্য এক জাতি ‘লুত’ তথা ‘সুদুম’। যে জাতি সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নিয়ম লঙ্ঘন করে অনৈতিকতায় মত্ত হয়েছিল। তারা চরম হীন ও লজ্জাকর কর্মে লিপ্ত হয়ে মানুষ নামের সংজ্ঞা হতে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। তারা ইতিহাসের এমনই একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছিল-যাদের ধ্বংসের দৃষ্টান্ত পুরো মানব জাতির জন্য এক চরম শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
লুতের (আ.) পারচয়
লুত একজন নবীর নাম। তিনি ছিলেন ইবরাহিমের (আ.) ভাতিজা হারানের পুত্র। আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দার (লুত) প্রতি বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আপন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নবুয়ত দান করেন। তার শৈশবকাল কেটেছে ইবরাহিম (আ.)-এর ছত্রছায়ায়। লুত (আ.)-কে ইবরাহিম (আ.)-ই লালন-পালন করেন। এজন্যই লুত (আ.) এবং বিবি সাবাহ দ্বীনে ইবরাহিমের প্রথম মুসলিম বা আনুগত্যকারীদের অন্যতম। ইবরাহিম (আ.) এর প্রায় প্রতিটি সফরে লুত (আ.) এবং তার স্ত্রী সফরসঙ্গী থাকতেন। ইবরাহিম (আ.) যখন হিজরত করে মিশর গেলেন তখনও লুত (আ.) এবং তার স্ত্রী সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তী সময় লুত (আ.) মিসর থেকে হিজরত করে পূর্ব জর্দানের সুদুম (সোডম) ও আরা অঞ্চলে চলে যান। ইবরাহিম (আ.) চলে যান ফিলিস্তিনে। সেখানে অবস্থান করেন এবং ইসলাম প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। ইবরাহিম (আ.)-এর সময়কালেই লুত (আ.) নবুয়তের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এ সময়কাল থেকেই লুত (আ.)-এর সময়কাল নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়
লুত (আ.)-এর জাতি ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী এক স্থানে বসবাস করত। যে স্থানটি বর্তমানে ট্রন্সজর্দান বা ধুমজর্দান। বর্তমান যে সাগরকে মৃত সাগর বা ডেডসি বলা হয়। অপরদিকে জানা যায়, ‘সুদুম’ ব্যতীত এ অঞ্চলে আরো চারটি বড় বড় শহর ছিল। প্রতিটি শহরের মাঝখানে বড় বড় সুদৃশ্য বাগান ছিল। ‘ওদুন’ নামে যে এলাকা ছিল, তারই আশপাশে ছিল ‘সুদুম’ এবং ‘আমুরা’ নামক এলাকা। জানা যায়, এখন যেখানে সমুদ্র, সেখানে ইতিহাসের কোনো এক সময়ে ছিল বিশাল মরুভূমি। কালক্রমে সেই মরুভূমি প্রকৃতির খেয়ালে শহরে রূপান্তরিত হয়। তারপর আবার আসমানি গজবের ফলে সাগরতলে বিলীন হয়ে যায় এ অঞ্চলটি। দৃশ্যমান মৃত সাগর জর্ডান ও ইসরাইল সীমান্তে অবস্থিত। এ বিস্ময়কর সাগরটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিচু জায়গায় অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ মি. নিচু, অতি লবণাক্ততা- যা ২৪০ ভাগ। স্বাভাবিক লবণাক্ততার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। এই পানিতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড ও বিষাক্ত পদার্থের কারণে কোনো প্রাণী বাঁচে না বলেই এটিকে মৃত সাগর বলা হয়। এর পানির আপেক্ষিক ঘনত্ব এত বেশি যে, যাতে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিলেও কেউ ডোবে না। এ হ্রদে লবণ জমে অনেক অদৃশ্যমান পিলার সৃষ্টি হয়েছে। আর এই স্থানেই একসময় লুত (আ.)-এর জাতি বাস করত। চালাত চরম হীন কর্মকাণ্ড। যার ফলে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নির্ধারিত হয় এবং এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সে এলাকা সমুদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। গবেষকদের ধারণা, ভূমিকম্পে ইটালির পম্পেই নগরী যেমন শত শত মিটার নিচে চলে গেছে, ঠিক তেমনি লুত (আ.)-এর জাতি ভূমিকম্পে শত শত মিটার মাটির নিচে চলে গেছে এবং সে এলাকা সমুদ্রের তলদেশে নিমজ্জিত রয়েছে।
অপরাধ ও শাস্তি
আল্লাহতায়ালা ‘সুদুম’ ও ‘আমুরার’কে সবুজ শ্যামল ও বেশ উর্বরতা দান করেছিলেন। ওই দুই এলাকায় উর্বরতার পাশাপাশি পানির সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। যার ফলে নানা রকম শস্যে ভরপুর ছিল স্থান দুটি। এককথায়, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী, জীবনের সব রকমের উপকরণের প্রাচুর্যই তাদের দান করেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু লুত (আ.)-এর জাতি প্রকৃতির কাছ থেকে এত কিছু পেয়েও তাদের মন ভরেনি, তারা বেপরোয়া জীবনযাপন শুরু করে। এমন কোনো হীনকর্ম নেই যে, যা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। সমাজজীবনে ওই জাতি যারপরনাই জুলুমণ্ডঅত্যাচার, মারামারি, নির্লজ্জতা ও কুকর্ম করেছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিনই বটে। সে সময় তারা এমন একটি অপরাধ অবিষ্কার করেছিল, যা তখন পর্যন্ত কোনো জাতির লোকের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। আর সেই জঘন্যতম অপরাধ হলো সমকামিতা। পরিভাষায়, পুরুষ বিপরীত লিঙ্গ নারীর সঙ্গে বৈধ প্রক্রিয়ায় যৌনতায় লিপ্ত না হয়ে পুরুষ পুরুষের পায়ুপথে সঙ্গম করাকে সমকামিতা বলে। এটা অত্যন্ত ঘৃণিত ও পাপের কাজ। আর এ ঘৃণিত কাজটি সর্বপ্রথম পৃথিবীতি সংঘটিত করেছে লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়।
পুরুষরা নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া না করে পুরুষে পুরুষে রতিক্রিয়া করাই ছিল তাদের চরম নেশা। আর এই জঘন্য অপকর্ম তারা প্রকাশ্যে করে বেশি আনন্দ লাভ করত। যত সুন্দরী নারীই হোক না কেন, নারীদের ত্যাগ করে তারা পুরুষের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মহাব্যস্ত হয়ে উঠত।
ঘৃণিত যৌনতায় লিপ্ত হয়ে এমন এক পর্যায়ে লুত তথা সুদুম জাতি পৌঁছে ছিল যে, আসমানি গজব তাদের ওপর অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘আর লুতকে আমি নবী বানিয়ে প্রেরণ করেছি। তারপর স্মরণ করো যখন সে নিজ জাতির লোকদের বলল, তোমরা কি এতদূর নির্লজ্জ হয়ে গিয়েছ যে, তোমরা এমন সব নির্লজ্জতার কাজ করছ, যা তোমাদের আগে পৃথিবীর কেউ করেনি। তোমরা স্ত্রী লোকদের ত্যাগ করে পুরুষদের দ্বারা নিজেদের যৌন ইচ্ছা পূরণ করে নিচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে তোমরা একেবারেই সীমা লঙ্ঘকারী জাতি। কিন্তু তার জাতির লোকদের জবাব এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, বের করে দাও এই লোকদের, তাদের নিজেদের জনপদ হতে, এরা নিজেদের বড় পবিত্র বলে দাবি করে। শেষ পর্যন্ত লুত ও তার ঘরের লোকদের তার স্ত্রী ব্যতীত যে পছন্দের লোকদের সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল, বেছে বের করে নিলাম। সেই জাতির লোকদের ওপর এক প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। এর পর দেখ, ওদের সেই অপরাধী লোকদের কী পরিণাম হলো।’ (সুরা আরাফ : ৮০-৮৪)। এ ছাড়াও লুত (আ.)-এর জাতির অনেক অপরাধের কথাই কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। সেসব আপরাধের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ ছিল সমকামিতা। আর এ কারণেই তাদের ওপর আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন এমন গজব নাজিল করেছিলেন যে, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এই ঘৃণ্য ও কদর্যপূর্ণ কাজের ফলেই সুদুম জাতির লোকজন পৃথিবীতে স্থায়ী কুখ্যাতি লাভ করে।
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, সমমৈথুন একান্তই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ। আর এটি কারোই আজ অজানা নয়। মহান আল্লাহপাক সমগ্র জীব জাতির মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষের পার্থক্য রেখেছেন। আর এই ধারা শুধু বংশ রক্ষার উদ্দেশ্যেই নয়, মানবজাতির ক্ষেত্রে এর পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে- যা স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে পরিবার গঠন অতঃপর ক্রমশ এর ভিত্তিতে গড়ে উঠবে সমাজ-সভ্যতা। এ ক্ষেত্রে লুত জাতি শুধু নির্লজ্জ নৈতিকতা বিবর্জিত ও চরিত্রহীন-ই ছিল না, তাদের এত অধঃপতন হয়েছিল যে, এই ঘৃণ্য কাজকে তারা কোনো অপরাধ বলেই মনে করত না। এবং এই কাজ যারা ঘৃণা করত তাদেরই ওই জাতির লোকজন ঘৃণা করত।
শুধু তাই নয়, নানা ধরনের নির্যাতনের পাশাপাশি অস্তিত্বও বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাদের। লুত (আ.) এবং তার আদর্শ যারা গ্রহণ করেছিল তাদের ওই সমাজের লোকজন সে সমাজ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ছিল বদ্ধপরিকর। লুত (আ.)-এর স্ত্রী সুদুম জাতিরই মেয়ে ছিল।
সে ছিল সুদুম জাতির যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সমর্থক। এ কারণেই আল্লাহপাক লুত (আ.)-কে আজাব অবতীর্ণ হওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘এই স্ত্রীকে তোমাদের সঙ্গে গ্রহণ করো না, সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত কর্মকাণ্ডের সমর্থক।’ আজাব আসার আগে লুত (আ.)-কে ও তার ঈমানদার সঙ্গীদের ওই এলাকা থেকে হিজরত করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। পরিশেষে বলা যায়, সমকামি নারী-পুরুষ তাদের ঘৃণিত কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহর শাস্তি ও গজবকে টেনে আনে। সুশৃঙ্খল সমাজকে ভঙ্গুর আর সভ্য পৃথিবীকে অসভ্যতায় নিমজ্জিত করে। সমকামিতা পাপ ও ঘৃণিত। রুচিশীল বোদ্ধামহলে তা কখনো গৃহীত হতে পারে না।
লেখক : কবি ও সমাজকর্মী, গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা