সামাজিক শিষ্টাচার ও চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জন একজন মুসলমানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সেজন্য ইসলামে সামাজিক আদব ও শিষ্টাচারকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানব জীবনে আদব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে, শিষ্টাচার ইসলামের সারবস্তু। একটি আদর্শ সমাজ গঠন এবং পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তো কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে সর্বোত্তম শিষ্টাচারের উপায় ও উপকরণের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা) বলেন, নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়তের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ। (আবু দাউদ -৪৭৭৬)।
সমাজ ও সামাজিকতা কী?
মানুষ সামাজিক জীব। তাই মানুষ একাকী থাকতে পারে না। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। আদম (আ.)-কে প্রথম মানব হিসেবে সৃষ্টি করার পর হাওয়া (আ.)-কেও সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে আদমকে নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে না হয়। গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা মানুষের একটি সহজাত চাহিদা। চাইলেও কেউ একাকী থাকতে পারে না। তাই পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা থাকলে মানুষের জীবন সত্যিকারভাবেই সুন্দর হয়। মানুষের মাঝে নানা গোষ্ঠী ও সমাজ থাকবে।
সেখানেই মানুষ বসবাস করবে। সেই সমাজেই সামাজিকতা ও শিষ্টাচারের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মানুষ, আমি তোমাদের পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের অনেক জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক খোদাভীরু, আল¬াহ তায়ালা সর্বজ্ঞাত ও সর্ববিষয়ে অবগত। (সুরা হুজরাত : ১৩)
দৈনন্দিন জীবনে শিষ্টাচার
মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, পানাহার, বসবাস ও সহবস্থান সমাজ জীবনের মৌলিক চাহিদা। এসব প্রাত্যহিক কাজে শিষ্টাচারের প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুল (সা) এর জীবনচরিতে। ইসলামে সামাজিক বিধান এতটাই পরিপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত যে, মানবসভ্যতায় এর নজির বিরল। নিচে সামাজিক শিষ্টাচারের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো-
পারস্পরিক কথাবার্তায় শিষ্টাচার
সালাম দেয়া
শিষ্টাচার সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রথম আসে পারস্পরিক সম্ভাষণ বা সালামের বিষয়টি। সালাম এক অতুলনীয় সামাজিক বিধান। সালাম মুসলমানের স্বতন্ত্র শিষ্টাচার।
সমাজে চলতে গেলে এক মুসলমানের অন্য মুসলমানের প্রয়োজন হয়। ইসলামে পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্ভব হলে মুছাফাহা করা এবং কুশল বিনিময় করা। আল¬াহ তায়ালা স্বয়ং মোমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদের সালাম করবে। কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দোয়া। (সুরা নুর : ৬১)।
নম্রভাবে কথা বলা
প্রত্যেক জিনিসের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য তার কোমলতা ও নম্রতার মধ্যেই নিহিত থাকে।
পক্ষান্তরে নির্দয়ী ও কঠোর আচরণ সমাজে নিন্দনীয় ও বিকৃত। তাই আল¬াহ রাব্বুল আলামিন কথাবার্তায় মানুষের স্বভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা তার সঙ্গে নম্রভাবে কথা বলো। (সুরা ত্বোয়াহা : ৪৪)। বস্তুত যার অন্তরে কোমলতা, নম্রতা বা দয়ার্দ্রতা নেই, তার কাছ হতে কল্যাণকর কোনো কিছুই আশা করা যায় না। সুতরাং কথাবার্তায় নম্রতা, কোমলতা অর্জন করে কঠোরতা ও রূক্ষতা পরিত্যাগ করা ইসলামি শিষ্টাচার।
চলাফেরায় শিষ্টাচার
নম্রভাবে চলাফেরা করা
আল্লাহতায়ালা এরশাদ করছেন, রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। (সুরা ফুরকান : ৬৩)। গর্বভরে না চলা, অহংকারীর মতো পা না ফেলা। আবার খুব ধীর গতিতেও না চলা। কারণ কোরআনে এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, নিজ চলাফেরায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। (সুরা লোকমান : ১৯)। হাদিসে এসেছে, চলার সময় রাসুলের (সা.) চলার পথ যেন তাঁর ন্যে কুঞ্চিত হতো।
অহঙ্কার করে না চলা
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করছেন, জমিনে দম্ভভরে পদচারণা করো না। (সুরা লোকমান : ১৮)। আত্মাভিমানীদের ধারা অনুসরণ করে অহংকারভাবে বিচরণ না করা।
দৃষ্টিকে অবনত রাখা
চলাফেরার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভদ্রতা হচ্ছে নিজের দৃষ্টিকে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে দূরে রাখা। আল্লাহ বলেন, মোমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকেও নত রাখে। (সুরা নুর : ৩০-৩১)।
আচরণগত শিষ্টাচার
পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করা
আল্লাহ বলেন, ‘এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো ... তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও।’ (সুরা বনি ঈসরাইল : ২৩-২৪)। পিতা-মাতার সঙ্গে সর্বদা সদাচরণ করা, তাদের সামান্যতমও কষ্ট হয় এমন আচরণ থেকে বিরত থাকা এবং তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলা হচ্ছে ইসলামি শিষ্টাচার।
আত্মীয়স্বজনকে দান করা
আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন। (সুরা আন নহল : ৯০)। আত্মীয়স্বজনকে তার প্রাপ্য দান করা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা। অগ্রজ ও দ্বীনি দায়িত্বশীলদের সামনে অগ্রগামী না হওয়া : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহ ও রসুলের সামনে অগ্রণী হয়ো না।’ (সুরা হুজুরাত : ১)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) তার লিখিত তাফসিরে বয়ানুল কোরআনে বলেন, ধর্মীয় আলেম ও মাশায়েখ এবং ইসলামি সংগঠনের আমিরের বেলায়ও এই বিধান কার্যকর। অর্থাৎ তাঁদের সামনে নিজেকে আগ বাড়িয়ে দেয়া, তাঁদের কণ্ঠস্বরের উপর নিজের কণ্ঠ উঁচু করা ইসলামি শরিয়তে নিষিদ্ধ এবং শিষ্টাচারবর্জিত।
উত্তম নামে সম্বোধন করা
আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। (সুর হুজুরাত : ১১)।
কেউ অপছন্দ করেন তার জন্য এমন কোনো নামে ডাকা যাবে না। হাসিমুখে কথা বলা ও রাগ না করা। মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা উচিত। রাসুল (সা.) সর্বদা মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। (বোখারি : ৩০৩৬)।
অফিস ও সহকর্মীদের সঙ্গে শিষ্টাচার
অনেক অফিস-আদালতে কর্তাব্যক্তি ছোটখাটো কোনো কারণে অধীনদের হুমকি-ধমকি দিয়ে দমিয়ে রাখতে পছন্দ করে। ফলে অধঃস্তনদের মনে সবসময় একটি অজানা ভীতি তাড়া করে বেড়ায় কোনো দোষ নেই, অপরাধ নেই, তথাপিও অধীনরা তাদের বড় কর্তাদের ভয়ে সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকে। এতে কর্তাব্যক্তির ভুলের সংশোধন হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই প্রতিষ্ঠানও তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। রাসুল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে ও তাঁর অধীনদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতেন। আল্লাহ রাসুলের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন, সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের উচিত জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ করা। (সুরা আহজাব : ২১)। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠী, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রীসহ ধর্মবর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। এটাই ইসলাম ও মুসলমানিত্বের দাবি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।
ছোটদের স্নেহ করা ও বড়দের সম্মান করা
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান বোঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবুদাউদ : ৪৯৪৩)।
ছোট-বড় প্রত্যেক তার শান ও মান অনুযায়ী সশ্রদ্ধ সম্মান ও স্নেহ করা শিষ্টাচারের অন্যতম দাবি।