চৈনিক শব্দে মুসলিম নামের সূচনা

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মিং বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট হংওউ মুসলিম সেনাপতিদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলেও ইসলামের সাংস্কৃতিক প্রভাবকে সহায়তা করেননি। মিংরা চৈনিকতা চেয়েছিলেন মুসলিম সংস্কৃতিতেও। বাণিজ্যের চেয়ে কৃষির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতেন হংওউ। এ বংশের পূর্বপুরুষরা কৃষক ছিলেন। মিং আমলে চীনের কৃষি নতুন মাত্রায় বিকশিত হয় এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে মনোযোগ কমে আসে। তবুও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারা একেবারে থেমে যায়নি। আবার সমগ্র সাম্রাজ্যজুড়ে গড়ে ওঠে ছোট ছোট নগর-বাণিজ্যকেন্দ্র। মুসলিম বণিকরা নতুন এই নগরায়ন ও বাণিজ্য-পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে থাকেন। চীনে জেগে ওঠা জেনোফোবিয়ার মধ্যে ইসলামের প্রচারকরা নতুন ভূমিকা নেন। চার ধারে চৈনিকীকরণের চাপ বেড়েই চলছিল। মুসলিমরা তখন নিজেদের পরিচয় হিসেবে চীনা নাম গ্রহণ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে চীনা সমাজে মুসলিম পরিচয়ের কিছু চিহ্ন ও ধ্বনি পরিচিত হতে থাকে। এটা অবশ্য পূর্ব থেকেই চলে আসছিল।

চীনা জাতীয়তাবাদ নামকে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এর মধ্যে চীনকে দেখতে চায়। বিশেষত ইউয়ান আমলের শেষ দিকে এই উদ্দীপনা বাড়তে থাকে। তখন আরব নামের বদলে মুসলিমদের মধ্যে চীনা নাম গ্রহণের ধারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ইউয়ান রাজবংশের একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সাই দিয়াঞ্চি ঝাঁসিডিং। তার পাঁচ ছেলে ছিল নাসুরাতদিন, হাসান, হুক্সিন, শান সুডিং এবং মা সুডিং। এ রাজবংশের আরেক বিখ্যাত মুসলিম হলেন বারমারুদ্দিন। তার চীনা নাম ছিল লু ঝিদাও। মুসলিমদের মধ্যে তখন থেকে উপাধি হিসেবে হু, মা, সা, শা, ডিং, শেম, মু ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়।

ইউয়ান আমলে পিংঝাং এর কর্মকর্তা ছিলেন বিখ্যাত মুসলিম মা বালাসা। সম্রাট তাকে উপাধি দেন দাবুহুয়া। তার বংশধররা পরবর্তী সময়ে উপাধি হিসেবে দা কথাটা নিজেদের নামে যুক্ত করতেন। আবার অনেক মুসলমানের নামের সঙ্গে উপাধি হিসেবে যুক্ত করা হতো নিজেদের পূর্বপুরুষের জন্মভিটের পরিচয়। যেমন হুই মুসলমানদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রচলিত কিছু উপাধি হলো ‘মি’, ‘আন’ এবং ‘শি’। মি বলতে বুঝায় পশ্চিম অঞ্চলের মি দেশ বা আজকের উজবেকিস্তান। আনসি বা আন বলতে বুঝাতো আজকের ইরানি মালভূমির উত্তর-পূর্ব অংশ। শিউ বা শি বলতে বুঝাতো আজকের সমরকন্দ এলাকা। ইউয়ান রাজবংশে, ‘দা শিমান’ ছিল ইসলামি শাস্ত্রের শিক্ষকের উপাধি। ‘হা দে’ এবং ‘গাজুই’ ছিল যথাক্রমে ইউয়ান রাজবংশ এবং মিং এবং কিং রাজবংশের ধর্মীয় বিচারকদের উপাধি।

মিং রাজবংশের হুই মুসলমানদের মধ্যে (শান) মাও নামে এক প্রশাসক ছিলেন। হুবেই প্রদেশের জননিরাপত্তার দায়িত্বশীল ছিলেন তিনি। মিং রাজবংশের সম্রাট ইংজং তার উপাধি জানতেন না, তাই তিনি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তাকে শান বলে অভিহিত করেন। পরবর্তী সময়ে এই উপাধি স্থায়ী রূপ পায় এবং বংশীয় ঐতিহ্যে প্রবাহিত হয়। চীনা মুসলিমদের বিপুল ব্যবহৃত হুই নামটি মূলত এসেছে হুই জাতীয়তা থেকে। মিং আমল থেকে হুই মুসলমানরা নিজেদের নামে সরাসরি চীনা শব্দ বা ইঙ্গিত ব্যবহার করতে শুরু করেন।

ইসলামের নবী-ওলিদের নাম চারটি বর্গে তখন বিভাজিত হয়। সেগুলো হচ্ছে লিয়েশেং, কিনশেং, দাশেং এবং জিনসেং। মুসলিম প্রতীকে পরিণত হয় কিছু ধ্বনি। যেমন মা বলতে মুহাম্মদ, হা বলতে হাসান, হু বলতে হুসাইন, সাআ বলতে সাঈদ ইত্যাদি। মুসলিমদের ছিল জ্ঞানগত ও নৈতিক দক্ষতা, যা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের প্রয়োজনীয়তার যুক্তি তৈরি করত। মিং রাজবংশে নানা ক্ষেত্রে দেশের পুনর্গঠন ছিল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এতে মুসলিমদের সামর্থ্যকে কাজে লাগানো ছিল একটি সহজ ও ফলপ্রসূ উপায়। ফলে দেখা গেল সেনাবাহিনী, অর্থনীতি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মুসলিম মেধার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। একই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ছিল মুসলিম সংস্কৃতির বিশেষ চরিত্র দান, যা চীনা ঐতিহ্য, মেজাজ ও জাতীয়তাকে প্রতিফলিত করবে।