মধ্যযুগীয় চীনে মুসলিমদের বহুমাত্রিক ভূমিকা

মুসা আল হাফিজ

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু সেনাবাহিনীর উচ্চ পদেই নয়, অভিযাত্রী ও সমুদ্রযাত্রার অধিনায়ক হিসেবেও চীনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর খ্যাতি ছিল। এক্ষেত্রে চীনের ইতিহাসে ঝেং হে (১৩৭১-১৪৩৩ বা ১৪৩৫)-এর নাম রীতিমতো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। একাধারে প্রশাসক, দপ্তরপ্রধান ও পরিব্রাজক, কূটনীতিবিদ ও নৌসেনাপতি হিসেবে তিনি বহুবিধ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৩৭১ সালে দক্ষিণ চীনের য়ুনান অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাইয়্যেদ আজল শামসুদ্দীন ওমরের প্রপৌত্র, যিনি মঙ্গোল সাম্রাজ্যের প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেন এবং ইউয়ান রাজবংশের প্রথম দিকে ইউনানের গভর্নর ছিলেন। তার প্রপিতামহ বায়ান ইউনানের একটি মঙ্গোল গ্যারিসনে অবস্থান করতেন। ঝেং হের দাদার উপাধি ছিলো মা, যার মানে আলহাজ। ঝেং হোর বাবা ছিলেন বিখ্যাত যোদ্ধা। ১৩৮১ সালে মোঙ্গল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৩৭ বা ৩৯ বছর।

ঝেং হে তখন সবেমাত্র বালক। তার নাম তখন মা হে। চীনা সেনাবাহিনী এক যুদ্ধশেষে অন্যান্য বালকের সঙ্গে তাকেও নিয়ে আসে রাজধানীতে। ১৩ বছর বয়সে মা হে সম্রাটের পুত্র ঝু দির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান। তার প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা এবং বীরত্ব ছিল সবার চোখে পড়ার মতো। অচিরেই তিনি শক্তিমান যোদ্ধা এবং রাজপুত্রের প্রিয় অফিসার হয়ে ওঠেন। ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে চেংজু উপাধি ধারণ করে ঝু দি ক্ষমতা ছিনিয়ে আনেন তার ভাগ্নের হাত থেকে। সে জন্য করতে হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মা হে ছিলেন তার প্রধান সহযোগী। ইয়ংলে সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট হয়ে ঝু দি সম্মানিত করতে চাইলেন মা হে কে। তাকে তিনি দিলেন রাজকীয় নতুন উপাধি ঝেং তথা রত্ন, মা হে হয়ে গেলেন ঝেং হে।

প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। সাত ফুট লম্বা। দীর্ঘ হাত, প্রশস্ত বুক, সবল, সুগঠিত সুপুরুষ। সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে পালন করেন দায়িত্ব। তবে অ্যাডমিরাল হিসেবে তার ভূমিকা সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে ইতিহাসে। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে সাতটি সমুদ্রযাত্রা করেন ঝেং হে। এ সময়ে তিনি দক্ষিণ চীন সাগর, ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, লোহিত সাগর এবং আফ্রিকার পূর্বউপকূলীয় সমুদ্র অঞ্চল ভ্রমণ করেন। ১৪০৫ সালের ১১ জুলাই মোট ৩১৭ টি জাহাজ আর ২৮, ০০০ জন সহযোগী নিয়ে তিনি সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। জাহাজগুলো ছিলো বিপুলায়তন। তাদের বিশালতা ছিলো বহরের গর্ব। এর মধ্যে রাজকীয় ৬২টি জাহাজ ছিলো চমকপ্রদ। প্রত্যেকটির ওজন ছিল ৩১০০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ১৪৯২ সালে ব্যবহৃত কলম্বাসের জাহাজের ওজন ছিল ৯১ মেট্রিক টন।

বিশাল এই অভিযাত্রার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো উত্তর ও পশ্চিমের মোঙ্গলদের সতর্ক করা। মাঞ্চুরিয়ান, কোরিয়ান, জাপানি এবং ভিয়েতনামি হুমকির মোকাবিলায় চীনকে তখন ব্যস্ত থাকতে হতো। ঝেংহের বহর জাভা, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড অঞ্চলে শক্তিপ্রদর্শন করে। কিন্তু সম্রাটের লক্ষ্য ছিলো আরো দূরে। তিনি বিদেশি জনগণকেও অবিভূত করতে চাইলেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাইলেন যে, চীন একটি মহান ও শক্তিমান রাষ্ট্র। ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকা অঞ্চল তখন বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এক সুবিধাজনক এলাকা। সেখানে আরবদের প্রভাব ছিল। চীনের মিং সম্রাট অনুসন্ধান করলেন চীনের প্রভাব বৃদ্ধির পথ। ১৪ শতকের শেষ দিকে আরব ও অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে চীনের বৈদেশিক সম্পর্ক বেড়ে যায়। মুসলিম জাহান ও আফ্রিকার সঙ্গে চলমান সেই বাণিজ্যকে নতুন মাত্রা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। ঝেং হে চীনের পক্ষ থেকে এসব অঞ্চলে নিয়ে গেছেন রেশম, স্বর্ণ, রূপা ও চীনামাটির শিল্পকর্ম।

বিনিময়ে নিয়ে আসেন অন্যান্য দেশের তরফে চীনকে দেওয়া ঘোড়া, উটপাখি, জেব্রা, উট ও হাতির দাঁতের অমূল্য সম্ভার। ২৮ বছরের নাবিক জীবনে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে জিং হি ৩৭টি দেশ ভ্রমণ করেন। চীনের একদল মুসলিমসহ পবিত্র মক্কায় তিনি হজ সমাপন করেন। অনুসন্ধানমূলক নৌযাত্রাও তিনি করেন সাগরে সাগরে। নৌপ্রযুক্তি ও সামর্থ্যে সমকালের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন অবিকল্প একজন। তিনি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, রত্ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, উদ্ভিদ, প্রাণী, ওষুধ ইত্যাদি নিয়েও গবেষণা করেন, যা কেবল নেভিগেটরের পরিচয়ের চেয়ে তার প্রতিভাকে বহুমাত্রায় বিস্তৃত করে।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞাচর্চায় মুসলিমদের অভিমুখ চীনের অগ্রগতিতে রাখে অবিস্মরণী ভূমিকা। সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক মনীষার জন্ম দানে চীনা মুসলিম সমাজ বরাবরই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চায় তাদের কৃতিত্বের ইতিহাসও সমৃদ্ধ। চীনা ভ্রামণিক লি নু ছিলেন একজন পলিম্যাথ ও ব্যবসায়ী। হান বংশের এই মনীষী দর্শন চর্চায় সমকালে ছিলেন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব।

তার পিতা লিন লু ১৩৭৬ বা ১৩৮৪ সালের দিকে ইরানের হরমুজ ভ্রমণ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এক মুসলিম রমনীকে বিয়ে করেন তিনি। চীনে ফিরে তাকে নিয়ে ফুজিয়ানের কুয়ানজন এলাকায় বসবাস শুরু করেন। চীনের সম্মানিত ও ঐতিহ্যবাহী বংশের সদস্য ছিলেন লিন। এ বংশের প্রথম পূর্বপুরুষ লি ফুগুয়ান কোয়ানঝোতে বসতি স্থাপন করেন তাং রাজবংশের আমলে, ৮৮৬ সালে। তিনি ছিলেন লিন লু-এর বিশতম পূর্বপুরুষ। লিন যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করেন, তাই বংশীয় উপাধি লি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় এবং তার মাধ্যমে শুরু হয় লিন বংশের ধারা। লিন বংশকে কখনো মেনে নেয়নি লিরা। এই শত্রুতায় শুরুতে নেতৃত্ব দেন লিন লু-এর ভাতিজা লি গুয়াংকি। মুসলিম নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী লিনদেরকে সেমু বংশীয় বলে ঘৃণা করা হতো। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে যারা চীনে আসেন, তাদেরকে বলা হতো সেমু বা বহিরাগত।

সেমুদের মধ্যে ছিল বৌদ্ধ তুর্পান, উইঘুর, টাঙ্গুত এবং তিব্বতিরা। ওংগুদের মতো নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টান উপজাতি; অ্যালান্স; খোয়ারাজমিয়ান এবং কারাখানি মুসলিমদের মধ্য থেকে আগত মধ্য এশিয়ার তুর্কি জনগণ সেমু বলে চিত্রিত হতো। আবার পশ্চিম এশিয়ার আরব, ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকেও সেমু বলে আখ্যা দেওয়া হতো। চীনে তাদের প্রতি ঘৃণা নানা সময়ে বেড়েছে। লি গুয়াংকি সেমু বিদ্বেষে ছিলেন অগ্রণী। ইসলাম কিংবা খ্রিষ্ট-ইহুদি ধর্মের বিশ্বাস ও রীতি-নীতিকে তিনি আক্রমণ করতেন। তারা চীনা/কনফুসিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং তাদের ভাষা প্যাঁচার চিৎকারের মতো, এবং তাদের লিপি কীটের মতো।

তার বিচারে তারা ছিল বর্বর, এদের সম্পর্কে প্রাচীন চীনা গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তার চাচা সেমু সংস্কৃতি এবং ‘অদ্ভুত ও বহিরাগত’ উপলব্ধি দ্বারা ‘প্ররোচিত’ হয়ে জাতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তীব্র শত্রুতার মধ্যেও লিন লু নিজেকে টিকিয়ে রাখেন। তার গুণাবলি ছিল চিত্তাকর্ষক। ৪৬ বছর বয়সে তার ওফাত হয়।

তার পুত্র লি নু সমকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, ন্যায়বিদ ও দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এই বংশে অব্যাহতভাবে মনীষীদের জন্ম হয়েছে এবং মধ্যযুগীয় চীনের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদ লি ঝি (১৫২৭-১৬০২) ছিলেন এ বংশের সন্তান। তিনি মুসলিম ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ নেই, এমন দাবি করেছেন অনেকেই। নব্য-কনফুসিয়ানিস্ট মতবাদের সমালোচক ছিলেন লি ঝি। সমকালিন চীনের নানা গোড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। সরকার তাকে সহ্য করতে পারেনি। কারাগারে পাঠানো হয় তাকে এবং সেখানে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় তার। অনেকের মতে, আত্মহত্যা করেন তিনি। লি ঝির চিন্তাধারার ওপর ইসলামের প্রভাব একটি সুস্পষ্ট বিষয়।

১৯৮০-এর দশকের পরে চীনা এবং পশ্চিমা গবেষকরা লি ঝির চিন্তাধারার ওপর ইসলামের প্রভাবের ভিত্তি খুঁজেছেন বর্ণবাদী অবস্থান থেকে। তাদের বিচারে সেই প্রভাব লুকিয়ে আছে ‘একজন যৌন-চোখী মহিলাকে বিয়ে করা’ লিন নু-এর ইসলাম গ্রহণের মধ্যে। অথচ প্রকৃত প্রভাবটা আরো বড় বিষয়, যার প্রধান দিক হলো ইসলামের দার্শনিক আবেদন। গবেষক ঝাও কিং দাবি করেন, লিন নু এবং লি ঝির মধ্যে ছয় প্রজন্মের ব্যবধান ছিলো। মধ্যপ্রজন্মের পূর্বপুরুষেরা ইসলামে বিশ্বাস করতেন, এটা প্রমাণ করার জন্য কোনও নথিভুক্ত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

লিন পরিবার কনফুসিয় মতবাদের সঙ্গে ইসলামের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছে এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্বের আওতায় তার এমন ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করেছে, যা ইসলাম বা কনফুসীয় মতবাদকে বিব্রত করে না। লি নু কনফুসীয় চিন্তার সঙ্গে ইসলামের আত্মীয়তা স্থাপনের সেই প্রয়াস চালান, আল কিন্দি ও আল ফারাবি যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন গ্রীক দর্শনের সাথে ইসলামের বন্ধন প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে লি নুর সাফল্য ছিল গৌন এবং তার যেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না, তেমনি তার প্রয়াসের পরে উল্লেখযোগ্য কোনো ধারাবাহিকতা জারি ছিল না।

লেখক : গবেষক আলেম