চীনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিপুল ঐতিহ্যের পথ ধরে বিকশিত হয়। এই বিকাশের অতীত অনেক সমৃদ্ধ। সময়ের ধারায় তা অব্যাহতভাবে বেড়েছে। চীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আগত প্রভাবকে যেমন আত্মস্থ করেছে, তেমনি দূরবর্তী অঞ্চলের সুকৃত ঐশ্বর্যকেও অবলম্বন করেছে। মুসলিম দুনিয়া চীনের প্রতিবেশী ছিল এবং দূরবর্তী অঞ্চলেও চীনকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বহুমাত্রিক বিনিময় জারি রাখতে হতো। সংস্কৃতি এই বিনিময়ের অন্যতম একটি দিক। ইসলামের ধর্মবিশ্বাস চীনে তাই বহুপথ ধরে প্রবেশ করেছে বহুকাল ধরে। চীনের সাংস্কৃতিক নিজস্বতার মধ্যেও মুসলিম জীবনকলা ও আচারপন্থা পরিচিত সামাজিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়।
বিকাশের যৌবনে থাকা মুসলিম সভ্যতার সঙ্গে এই সহাবস্থান চীনকে করেছিল লাভবান। মুসলিম জীবনদৃষ্টি, কৃষ্টি ও সৃষ্টির সুফল চীনের সমাজে এক ধরনের গ্রহিষ্ণু মেজাজের জন্ম দেয়। রাজনৈতিক বিস্তার, বাণিজ্যিক প্রসার, বৈদেশিক সম্পর্ক, বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে বিচারবোধসহ নানা খাতে এই সব প্রভাবের প্রবাহ জারি থেকেছে। এই সময়ের মুসলিম মনীষীদের অবিরল অনুদানের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেছে চীনের ইতিহাস। প্রাচীন লেখকরা মুসলিমদের এই ইতিবাচক ভূমিকাকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি দিয়েছেন।
মুসলিমদের সংখ্যা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব চীনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়ার অবস্থানেই ছিল। ত্রয়োদশ শতকে মার্কো পোলো লিখেছেন, প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশ মুসলমান হয়ে গেছে। ১৪শ’ শতকের অন্য এক ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘তালিফো’র সব অধিবাসী মুসলমান। দক্ষিণ চীন সম্পর্কে ইবনে বতুতা লেখেন- প্রতিটি শহরেই মুসলিম মহল্লা রয়েছে। এসব মহল্লার সব অধিবাসী মুসলমান এবং তারা ভদ্রতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। মুসলমানরা চীনা মহিলাদের বিয়ে করে এবং তাদের সঙ্গে গভীর ও দায়িত্বশীল সম্পর্ক রাখে। এজন্য খুব দ্রুত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে। ১৫শ’ শতকের খ্যাতিমান মুসলিম বণিক আলী আকবর লিখেন, পিকিংয়ে প্রায় ৩০ হাজার মুসলিম পরিবার বাস করে।
মুসলিমদের এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাবাহিকতা বড় বড় চ্যালেঞ্চ মাড়িয়েই অগ্রসর হয়েছে। বহু রক্তপাত ও গণহত্যার ঝড় উজিয়েই তাদেরকে রাখতে হয়েছে নিজস্ব স্বাক্ষর। ১৩৬২ খ্রিষ্টাব্দে ইউয়ান শাসনের অধীনে বেশ কিছু মুসলিম চীনের কোয়ানঝু বন্দরে সরকার কর্তৃক অভিনন্দিত হন। কিন্তু সেখানকার মুসলিমদের একটি অংশ রাজার বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। ১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বক্সি সেনাবাহিনীর প্রধান সাইফুদ্দীন ইসিবক্সি সেনাবিদ্রোহে যুক্ত হন। সাইফুদ্দীন ছিলেন পারস্য থেকে চীনে স্থায়ী হওয়া বিখ্যাত শিয়া সমরনায়ক। ১০ হাজার সৈন্যের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। চার বছর ধরে তিনি ফুজোয়াকে নিজের দখলে রাখেন জিংহুয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। আমিরুদ্দীনও ছিলেন পারসিক সেনাপতি। তিনি জিংহুয়া উপ-প্রদেশের আন্টং এবং সান্দানবাতে অভিযান শুরু করেন এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধে অংশ নেন জিনহুয়াতে। তিনি ইসি বাক্সি সৈন্যদের জিনহুয়ায় যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিলেন। তাকে অভিযুক্ত করা হয় বেসামরিকদের ওপর নিষ্ঠুরতার জন্য। রাজা ঝিঝেংয়ের শাসনামলের ২২তম বর্ষে (১৩৬২ খ্রি.) ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্নি নাউনা কোয়ানঝোতে তিনি অতর্কিত হামলার কবলে পড়েন এবং পরাজিত হন। অবশেষে নিহত হন। কুয়ানঝো ও পুতিয়ানকে তারা দীর্ঘদিন শাসন করেন এবং প্রাদেশিক রাজধানী ফুঝোতেও ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়ে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে। কিন্তু আঞ্চলিক একটি শক্তি হিসেবে তাদের প্রভাব হারিয়ে যায়নি। ১৩৬৬ খ্রিষ্টাব্দে হান কমান্ডার চেন ইউডিং ঝুয়ানকো-পুতিয়ানে চরম আঘাত হানেন। ইউয়ান রাজবংশের অনুগত এ সেনাপতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান তথাকথিত সেমুদের ওপর। যারা মূলত ছিল মুসলমান। চীনা সমাজে সেমু ঘৃণা একটি স্থায়ী ধারাবাহিকতা হয়ে উঠেছিল এবং বারবার তাদের বিরুদ্ধে রুদ্ররোষে বিস্ফোরিত হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। চতুর্দশ ইস্পাহ বিদ্রোহে পারস্যের সেমুদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়। এবং ঘৃণাবাদী চীনারা তখন যাকেই বাগে পেয়েছে, হত্যা করেছে।
কিন্তু মুসলিমরা চীনে শুধু ঘৃণার চোখ দেখেননি। অভ্যর্থনার সংগীতও শুনেছেন। আর এর পেছনে ভূমিকা রেখেছেন তাদের সেই দক্ষতা ও সামর্থ্য, চীনের রাষ্ট্র ও সমাজে যা গোটা মধ্যযুগে ইতিবাচক উদগতি জারি রেখেছিল। ইসলাম সেখানে একটি আবেদনময় দাওয়াহ হিসেবে বিস্তার প্রয়াসী ছিল। ১৭ শতকে দেখা যায় চীনে বসবাসকারী ইহুদিদের একটি গোত্র একই সঙ্গে ইসলামে দীক্ষিত হয়।
১৮শ’ শতকের কিন লং জিঙ্গারিয়ার বিদ্রোহ দমন করার পর সেখানে ১০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসিত করেন। এই ১০ হাজার পরিবারের সবাই পার্শ্ববর্তী মুসলিম জনসবতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়। শানতোং অঞ্চলে এক দুর্ভিক্ষের সময় মুসলমানরা ১০ হাজার চীনা বালককে আশ্রয় দেয় এবং তারা সবাই পরে ইসলামে দীক্ষিত হয়। অন্য একটি দুর্ভিক্ষের সময় কোয়ান তুং অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার চীনা বালক মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং তাদের সবার লালন-পালন করে মুসলিম সমাজ। তারা ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বড় হয়। কিন্তু এসব ঘটনা ছিল অস্বাভাবিক পরিস্থিতিজাত। সাধারণভাবে চীনে মুসলিমদের অনেকেই সার্বক্ষণিক প্রচারকের ভূমিকায় থাকতেন। এই প্রচার ছিল ইতিবাচক এবং প্রভাবশালী। চীনা মুসলিমদের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য একজন গবেষক সাইয়েদ সোলায়মানের মতে, প্রতিবছর এতো মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতো, যাদের সংখ্যা গুনে শেষ করা কঠিন। শত্রুতার উত্তাপের মধ্যেও এই প্রাণশীতল আবহাওয়া তৈরী হত সেবাব্রতী ও কল্যাণী ভূমিকায় মুসলিম প্রচারকদের অগ্রণী চরিত্রের কারণে।
মুসলিমদের পারিবারিক নৈতিকতা ও বন্ধনের দৃঢ়তা ছিল অনন্য। জাতিবিদ্বেষের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিমরা বিপুলভাবে চীনা ভাষা রপ্ত করেন। চীনা নাম ধারণ করেন। স্থানীয়দের সাথে অঙ্গীভূত হন নানাভাবে। এর আবেদন পড়েছিল সমাজের শিক্ষা ও সততাসন্ধানী এমন এক অংশের ওপর, যারা নৈতিকতা ও সম্মানকে শুধু চীনের জিনিস মনে করে না। সাংস্কৃতিক সম্পন্নতা ও চারিত্রিক সাধুতা এমন জিনিস, যা বৈরী বাস্তবতার মধ্যেও প্রীতির উদ্যান রচনা করে। আধুনিকতার ঊষালগ্নে চীনে মুসলিম সভ্যতা এই দ্বিবিধ বাস্তবতার মধ্যে অবস্থান করছিল।
লেখক : গবেষক আলেম