ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সভ্যতার মানদণ্ড

মুহাম্মাদ ইনায়েতুল্লাহ
সভ্যতার মানদণ্ড

মানুষ মাত্রই উন্নতির প্রয়াসী। সে উন্নতি যখন সম্মিলিত প্রয়াসে সুসংগঠিত আকারে আমাদের সামনে হাজির হয়, তখন সেটাকেই আমরা সভ্যতা বলি। সমাজবদ্ধ প্রাণী হিসেবে মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসের এই নজির পৃথিবীর নানা প্রান্তে আজও টিকে আছে। মানুষের এই সুসংগঠিত, সম্মিলিত প্রয়াস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষুদ্রাংশের পছন্দে তৈরি। বৃহত্তর অংশ যেখানে হুকুমের দাস। ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভূত প্রক্রিয়া ইতিহাসের পটভূমিকায় বহু সভ্যতার বিকাশ ঘটালেও এবং অজড় অক্ষয় বহু কীর্তির জন্ম দিলেও তা কতটা মানবিক ছিল সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সভ্যতা হিসেবে কোনো কিছু পরিচিতি পাওয়ার জন্য আজ হয়তো তাদের রেখে যাওয়া বৈষয়িক উন্নতির প্রমাণগুলোই আমাদের একমাত্র ভরসা, কেননা শোষিতের রোদনধ্বনি আপন ঘরকেই যখন ভেদ করে না তখন ইতিহাসের আশ্রয়ে তার চিহ্ন টিকে থাকার তো কোনো জো নেই।

অথচ সভ্য হওয়ার জন্য মানুষের মানবিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। যে অমানবিক, তাকে মানুষ রূপেই যখন আমরা গণ্য করি না তখন তাকে ‘সভ্য’রূপে গণ্য করি কী করে! হোক না সে যতই বৈষয়িক বৈভবের অধিকারী, সমাজের যত ওপর তলাতেই হোক না তার বসবাস। সুতরাং বৈষয়িক সংগতির বিচারে এই যে সভ্যতার বিচার এটি কি নিতান্তই আমাদের কল্পনা নাকি শক্তির সামনে নতজানুতার চিরকালীন প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ?

পৃথিবীতে যখনই ক্ষমতা সমাজের ক্ষুদ্রাংশে কেন্দ্রীভূত হয়েছে তখন তা কিছু লোকের স্বার্থকে গরীয়ান মহীয়ান করে তোলার জন্য সর্বরকম কর্মকৌশল তৈরি করেছে। অতীত-সভ্যতায় ক্ষমতাধরেরা কখনও কখনও সাধ ও সাধ্যের সীমারেখা ভেদ করে নিজেদের বিচিত্র সব সাধ-আহ্লাদ পূরণে মানুষকে করেছে আপন ইচ্ছার দাসানুদাস। সেসব কীর্তিও সভ্যতার মুখোশ পরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনরূপে আমাদের সামনে টিকে আছে।

জগৎ-সংসারে অসহায় অভাবী নিরন্ন লোকদের প্রাচুর্য বর্তমানেও আছে, অতীতেও ছিল। মানবিকতার ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজের অসহায় দরিদ্র নিরন্ন মানুষকে প্রাচুর্যের অংশ বিলিয়ে দিলে, তাদেরও সমাজের সমৃদ্ধিতে শামিল করে নিলে কালজয়ী কীর্তি ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়ার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসে। মূলত এ কারণেই নিকট অতীতের জমিদারদের বাহারি রূপের আলিশান দালান-কোঠার ভগ্নাবশেষ স্থানে স্থানে চোখে পড়লেও, অতীতের হাতেমতায়িদের তেমন কোনো কীর্তি চোখে পড়ে না। উপকরণ ও প্রযুক্তির বিপুল বৈভব উন্নতির পরও বর্তমানে আয়তনে-নৈপুণ্যে সেসবের অনুরূপ খুবই বিরল। জাঁকজমকপূর্ণ অতীত-সভ্যতার নিদর্শনগুলো কি নিকট অতীতের এসব জমিদারদেরই উন্নততর অতীত-বিভীষিকা?

সভ্যতার পরিচয়ে যদি মানবিকতাকেই বিবেচনায় আনতে হয়, তাহলে অতীতের যে লোকটি নিজের সর্বস্ব সকলের তরে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে, করেনি নিজের জন্য কিছুই, যাওয়ার বেলায় শূন্য হস্তে বুক ভরা তৃপ্তি নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে; তাকেই আনতে হবে ‘অতীত-সভ্যতা’র নিদর্শনরূপে। যে সমাজের লোকেরা সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্নে সম্পদের সুষ্ঠু প্রবাহ সমাজে প্রবহমান রাখতে গিয়ে অমর কোনো চিহ্ন ভবিষ্যতের জন্য দুনিয়ার বুকে রেখে যাওয়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করেছেন, অতীত সভ্যতার নিদর্শনরূপে তাদেরই দৃষ্টান্তে আনতে হবে। যে বাদশাহরা, ফোরাতের তিরেও যদি একটি প্রাণী অভুক্ত থেকে মারা যায়, কেয়ামতের কঠিন বিচারে আল্লাহর কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে- এ কথা বলে অর্ধ জাহানের বাদশাহি পেয়েও খেজুরের চাটাইকেই রাজপ্রাসাদরূপে গ্রহণ করেছেন; তাদেরই আনতে হবে সভ্যতার সর্বোন্নত নিদর্শনরূপে। তাদের রেখে যাওয়া নিদর্শন যত সামান্যই হোক আর যত ক্ষুদ্রই হোক আর যত ভঙ্গুরই হোক না কেন। মানবিকতার হিসাব-নিকাশটা পাশে রেখে যত আলীশান নিদর্শনকেই আমরা অতীত সভ্যতা হিসেবে গণ্য করি না কেন, তা ‘মুখোশধারী সভ্যতা’র অধিক কোনো কিছু গণ্য হবে না।

বর্তমান সময়কে আমরা বলছি আধুনিক সভ্যতা, কখনও বলছি আধুনিক সভ্যতার শীর্ষ চূড়া, কখনও বা উত্তর আধুনিক। আমরা এ আধুনিক সভ্যতায় কতদূর অগ্রসর হলাম, কতটা এগুতে পারলাম; এ বিচার-বিবেচনা নির্ভর করছে অতীত সভ্যতাগুলোকে কীভাবে আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করছি, যাচাই-বাছাই করছি; তার ওপর। কারণ অতীতের রেখাপথ ধরেই তো আমরা ভবিষ্যতের পথে সামনে হাঁটি।

লেখক : গবেষক ও মুহাদ্দিস

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত