বৃদ্ধাশ্রম কী? বৃদ্ধাশ্রম হলো, সন্তানদের কাছে অবহেলিত বৃদ্ধ মা-বাবার সন্তান ও স্বজনহীন হয়ে নিরানন্দ জীবনযাপন করে বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়স্থল। বৃদ্ধাশ্রম বাহ্য দৃষ্টিতে মানবিক ব্যবস্থাপনা মনে হলেও এটি একটি ভঙ্গুর সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। যেখানে অকৃতজ্ঞ, দায়িত্বহীন সন্তানের বিশ্রী মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়। আর দুর্বল, অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবার অসহায়ত্ব প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। সুশিক্ষায় শিক্ষিত সন্তান কখনোই গর্ভধারিণী মাকে নিজ গৃহ থেকে দূরে রাখতে পারে না। মায়ের সেবা করার সুযোগকে হাতছাড়া করতে পারে না। বাবার হাড়ভাঙা খাটুনির পারিশ্রমিকে নিজের অস্তিত্ব গড়ার অতীত ভুলে যেতে পারে না।
মাবাবার প্রতি অবহেলা হেতু তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা মায়ের রক্তে-মাংসে বেড়ে ওঠার কথা ভুলে যায়, বাবার কোলেপিঠে মানুষ হওয়ার কথা বিস্মৃত হয়, জাতে বাঙালি হলেও মগজে বিদেশি হয়ে যায়। সভ্য সমাজে ঘৃণিত জীবনাচারকে যারা উত্তরআধুনিক সভ্যতা ভাবে এবং ব্যক্তিজীবনে ধর্মেকর্মে চরম উদাসীন হয়। সর্বোপরি বিদেশিদের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার কালচারকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ ধর্মীয় ও দেশীয় কালচারকে থোড়াই কেয়ার করে যারা, সাধারণত তাদের মা-বাবার আশ্রয় নিজ ঘরে না হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে হয়। যে সন্তান মা-বাবাকে সেবাযত্ন করে খুশি করতে পারল না, সে তো হতভাগা। দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা, নবীজি (সা.) বলেছেন, যে সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা তাদের একজনকে পেয়ে সেবা-যত্ন করে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক। (মুসনাদে আহমাদ : ৭৪৫১)। মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এতে এগিয়ে আছে মনুষ্যত্বহীন এলিট সমাজ। মা-বাবাকে সেবাযত্ন না করে, সম্মান ও শ্রদ্ধার আসন না দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখাটা মোটেই সুস্থ সভ্যতার অংশ নয়, বরং এটি সুস্থ সভ্যতার কপালে কলঙ্কের তিলক!
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানকে যত্নশীল হতে নবী (সা.) বলেছেন, মা-বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর মা-বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি : ১৮৯৯)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে জানিয়ে দিয়েছেন, মা-বাবার প্রতি সন্তানের আচরণ কেমন হবে। তাই তিনি বান্দাদের সম্বোধন করে বলেছেন, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবিদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উহ্’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৩)। যেখানে কোরআন পিতা-মাতার সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলতে বারণ করেছে। কোনো ধরনের কষ্টপূর্ণ আচরণ থেকে নিষেধ করেছে, সেখানে সন্তানরা পিতামাতাকে ঘরবাড়িছাড়া করছে, বিয়ষটি দুঃখজনক। সন্তানের এমন আচরণের দায় ভুক্তভোগী পিতা-মাতা অস্বীকার করতে পারেন না। কারণ তারাই তাদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি। উলুবনে মুক্তার চাষ যেমন আকাশকুসুম, তেমনি ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতীত প্রকৃত শিক্ষিত হওয়াও অসম্ভব। যারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, তারাই পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখে।
পিতা-মাতার চেয়ে আপন কেউ নেই
পৃথিবীতে আসার আগেই সন্তানকে নিয়ে চিন্তিত থাকেন পিতা-মাতা। গর্ভকালীন সীমাহীন যাতনা সহ্য করে দুনিয়ার মুখ দেখান মা। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি মানুষকে পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচারণের আদেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টসহ গর্ভধারণ করেছে এবং কষ্টসহ প্রসব করেছে (সুরা আহকাফ : ১৫)। স্বার্থপর দুনিয়ার সবাই কাছে আসে স্বার্থের জন্য। স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে। লোভাতুর দুনিয়ায় একমাত্র মা-বাবাই স্বার্থহীন। যারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলান সন্তানের তরে। সন্তানকে উন্নত জীবন দিতে ব্যয় করেন জীবন-যৌবন, অর্থ-কড়ি। একজন ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার মাকে কাঁধে নিয়ে দুই কিলোমিটার পথ এমন প্রচণ্ড রোদে বহন করেছি, যাতে গোস্ত রাখলেও রান্না হয়ে যেত। আমি কি তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পেরেছি? তিনি বলেন, হতে পারে প্রসব বেদনার একটি উৎকণ্ঠার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পেরেছ (মাজমাঊজ-জাওয়ায়েদ : ৮:১৪০)।
পাথর কুড়াতে মুক্তা হারানো
অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানরা স্ত্রীর প্ররোচনায় পিতা-মাতার অবাধ্য হয়। তাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার দুঃসাহসিকতা দেখায়। বন্ধু, বান্ধব, স্ত্রী, স্বজন সবাই দুধের মাছি। বসন্তের কোকিল। বসন্ত ফুরালে যাদের দেখা পাওয়া অসম্ভব। পিতা-মাতার জন্য শরয়ি সংগত কারণ থাকলে স্ত্রীকে ত্যাগ করা যাবে; কিন্তু স্ত্রীর জন্য পিতা-মাতাকে ত্যাগ করা যাবে না। স্ত্রীকে আলাদা রাখলেও পিতা-মাতার সার্বিক খোঁজখবর নিতে হবে। তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে হবে। সাহাবি আবু দারদা (রা.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললেন, আমার স্ত্রীকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আমার মা তাকে তালাক দিতে বলেন। আবু দারদা বলেন, আমি তোমাকে স্ত্রী ত্যাগ করতেও বলছি না আবার মায়ের আবাধ্য হতেও বলছি না। বরং আমি তোমাকে একটি হাদিস বলছি, যা আমি নবীজিকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই মা জান্নাতের সর্বোত্তম দরজা। যদি চাও যত্নে রাখ, আর যদি চাও ভেঙে ফেল। (তিরমিজি : ১৯০০)। অন্য হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমার বিবাহে একজন মহিলা ছিল, হজরত ওমর (রা.) তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি বললেন, তাকে তালাক দাও। আমি তালাক দিতে অস্বীকার করলে তিনি নবী (সা.)-কে ওই ঘটনা জানালেন, তিনি আমাকে বললেন, তোমার বাবার অনুসরণ কর এবং তাকে তালাক দাও। (আবু দাউদ : ৫১৩৮)। পৃথিবীতে চলতে গিয়ে অনেক বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে, তাদের ভিড়ে প্রকৃত কল্যাণকামী পিতা-মাতাকে ভুলে যাওয়া যাবে না।
সাহাবি জাবের (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ কর, তাহলে তোমাদের সন্তানরাও তোমাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে। (মাজমাউজ-জাওয়ায়েদ : ৮:১৪১)। একজন ব্যক্তি নবীজিকে বললেন, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, তারাই তোমার জান্নাত, তারাই তোমার জাহান্নাম। (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব : ৩:২৯২)। আখেরাতের সফলতাই জীবনের মূল স্বার্থকতা। আর এই সফলতা আসবে পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে। পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে তাদের সন্তুষ্টি অর্জিত হয় না।
লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব