পাঁচ ভাষায় পাঠ : বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে পাঁচটি ভাষা শেখানো হয়। সঙ্গত কারণেই পাঁচটি ভাষা কওমি মাদ্রাসায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাষা পাঁচটি হলো- বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি। এর মূল কারণ হলো- কওমি মাদ্রাসায় ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা ও দীক্ষা মনীষী পরম্পরায় অবিকৃত উপস্থাপনায় চর্চিত হয়। ঈমান আকিদা সংরক্ষণ, কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক জীবনযাপন, দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতির অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং মনুষ্যত্ববোধের পূর্ণ বিকাশ ও রবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বাংলাদেশে প্রচলিত কওমি মাদ্রাসাগুলো ভারতের দেওবন্দের দারুল উলুমের রীতিনীতি, আদর্শ ও চেতনার আলোকে পরিচালিত। কোরআন, হাদিস, ফিকহ, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, নবীজীবন, সাহাবাচরিত, যুক্তিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, তাসাউফ, ব্যাকরণ এবং আরবি ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্রসহ একাধিক ভাষাসাহিত্যের পাঠ ও চর্চা কওমি মাদ্রাসার স্বাভাবিক কার্যক্রম। ভারতবর্ষে মুসলমানদের শাসনামলে এক সময় রাষ্ট্রীয় ভাষা ফারসি ছিল। তাই ফারসি ভাষায় এ অঞ্চলের ওলামায়ে কেরাম বহু ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেছেন। ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস লিখেছেন। এছাড়া ভারতবর্ষে হিন্দি ও বাংলাসহ অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি উর্দু ভাষারও ছিল ব্যাপক চর্চা ও ব্যবহারিক প্রয়োগ।
অখণ্ড ভারতে ফারসি ও উর্দু ভাষায় তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, মুসলমানদের ইতিহাস ও ধর্মীয় অবস্থান সম্পর্কিত বহু মৌলিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ৭১-এর স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ব্যাপকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কোরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি এবং ইসলামের মৌলিক উৎসগ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় রচিত। বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে কওমি মাদ্রাসার নীতিনির্ধারক ওলামায়ে কেরাম কওমি মাদ্রাসায় আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি এ পাঁচটি ভাষায় পাঠদানের এক যুগান্তকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাদ্রাসাপড়ুয়া একজন আলেম যেন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে অবিকৃতভাবে স্থানীয় কালচার ও সভ্যতা, ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সত্য তথ্যটিই উপস্থাপনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারে। এ উদ্দেশ্য পূরণে খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োজনমাফিক এ পাঁচটি ভাষার চর্চা আজও অব্যাহত আছে কওমি মাদ্রাসায়।
উর্দু ও ফারসির পাঠ : বিভিন্ন শাসকদের বিশেষত মুসলমানদের অখণ্ড ভারত শাসন, ইংরেজদের জুলুমণ্ডনিপীড়ন এবং ভারতবর্ষের অতীত ও নিকট অতীতের ভৌগোলিক ইতিহাস, সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থানকে নিখুঁতভাবে জানার তাগিদে উর্দু ও ফারসি শেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এছাড়া এ দুটো ভাষায় এশীয় ওলামায়ে কেরাম এ অঞ্চলভিত্তিক জীবন জিজ্ঞাসার নানা সমাধান দিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সে গ্রন্থগুলোর পাঠোদ্ধার করার মতো ভাষা দক্ষতা অর্জন করার জন্য উর্দু ও ফারসির পাঠ গ্রহণ করে থাকে কওমি শিক্ষার্থীরা। চতুর্থ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উর্দু ও ফারসি ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ্যগ্রন্থ হিসেবে পঠিত হয় কওমি মাদ্রাসায়। এভাবে কওমি শিক্ষার্থীরা উর্দু ও ফারসি শেখার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলে।
বাংলা চর্চায় ব্যাপকতা : গত তিন দশক আগেও এ দেশের কওমি মাদ্রাসায় বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা ছিল না। বাংলা ও আরবি সাহিত্যের চেয়েও উর্দু ও ফারসির চর্চা ব্যাপক ছিল। মরমি কবি জালালুদ্দিন রুমির মসনবি, শেখ সাদির গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ ও কারিমা এবং ফরিদ উদ্দিন আত্তারের পান্দনামা কাব্যগ্রন্থগুলো কওমি মাদ্রাসায় ব্যাপকহারে পঠিত ও চর্চিত হতো। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। এ কাব্যগ্রন্থগুলো নীতি-নৈতিকতা, মানবতা এবং আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের বিবিধ পাথেয়সমৃদ্ধ। তাই কওমি মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় এ কাব্যগ্রন্থগুলো ব্যাপক সমাদৃত ও অপরিবর্তনীয়। তবে এখন কওমি মাদ্রাসায় বাংলা ও আরবি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আগের চেয়ে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কওমি মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাষা ও সাহিত্যের এ চর্চাকে দিন দিন আরো গতিশীল করার প্রয়াস পাচ্ছে। কওমি শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সাংবাদিকতা চর্চার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। মূল ধারার সাহিত্য পরিচিতি ও চর্চা ব্যাপকতর হচ্ছে। তবে শুধু সমাজচিত্রের সাহিত্য নয়, মুসলমানিত্বকেও সাহিত্যের নানা শাখায় বিকশিত করার প্রগাঢ় বিশ্বাসকে সাহিত্য সাধনা বলে অভিহিত করে তারা। এ বিশ্বাস ও চেতনা থেকে বাংলা সাহিত্যের চর্চা ব্যাপক হচ্ছে।
প্রতিকূল পরিবেশে বাংলা চর্চা : বাংলা সাহিত্য চর্চার নামে অবৈধ প্রেম পিরিতির রসালো গল্প-উপন্যাস কিংবা অন্য ধর্মের কাহিনীনির্ভর মহাকাব্য চর্চা করে নৈতিকভাবে যেন শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য এককালে কওমি মাদ্রাসায় নির্দিষ্টকিছু বাংলা বই পড়া নিষিদ্ধ ছিল। নবীরাসুলদের জীবনকাহিনী, সাহাবাচরিত কিংবা নৈতিক শিক্ষার যে কোনো বই পড়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হতো। মূল ধারার বাংলা সাহিত্যে হিন্দু ধর্মের চর্চা থাকলেও চর্চা ছিল না ইসলাম ধর্মের। তাই নিরেট ধর্ম শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাহিত্য হিসেবে বাংলাকে আশি-নব্বইর দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হতো না। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাও তখন মাদ্রাসায় ব্যাপক ছিল না। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য সবসময়ই নিবেদিতপ্রাণ কিছু মহান ব্যক্তিত্ব কাজ করে গেছেন সর্বমহলে। কওমি অঙ্গনেও বাংলাকে আগলে ধরে রেখেছেন এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। যারা প্রতিকূল পরিবেশেও বাংলা চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, পুরান ঢাকার জামেয়া লালবাগের সাবেক প্রিন্সিপাল ও শাইখুল হাদিস মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)। তিনি তৎকালীন সাধুভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদও করেছেন বেশ কিছু বই। তিনি ৭১-এর আগেই বাংলা ভাষাকে নিজের প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স থেকে তার রচিত গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হয়। পাকিস্তান আমলেই বাংলা চর্চা করতেন এমন আরেকজন আলেম ও বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হলেন মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী। তিনি কর্মজীবনে ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনা ‘হাদিসের তত্ত্ব ও ইতিহাস’ এবং মিশকাতুল মাসাবিহ এর বঙ্গানুবাদ। মিশকাতুল মাসাবিহ এর অনুবাদগ্রন্থগুলো বাংলাবাজারস্থ এমদাদিয়া লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। অনেক প্রতিকূলতা ও ঝড়ঝাপটা এড়িয়ে বাংলাকে আগলে ধরে পুরো জীবনটাই ব্যয় করেছেন সাহিত্যে সুবাস ছড়াতে মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ.)। তিনি বহু গ্রন্থ রচয়িতা। মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক। বাংলা ভাষায় সীরাত তথা নবীজীবন চর্চার পথিকৃৎ। তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনির অনুবাদ তার কালজয়ী সাহিত্যকর্ম। ‘জীবনের খেলাঘরে’ তার আত্মজীবনীমূলক রচনা। এ গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার গড়া ভাঙার নানা ইতিহাস। সে সময়ে আরেকজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদিস আজিজুল হক (রহ.) বাংলা ভাষায় বোখারি শরিফের অনুবাদ করেন। তিনিই বাংলা ভাষায় বোখারি শরিফের প্রথম অনুবাদক। মাওলানা রুমির মসনবি শরিফেরও তিনি অনুবাদ করেছেন। এছাড়া আরো অনেক আলেম তখন বাংলা চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
তাদের পরে যারা কওমি মাদ্রাসায় নিয়মিত সাহিত্য আসর করতেন, তারা গোপনীয়তা রক্ষা করেই সাহিত্য চর্চা করতেন। কেননা, তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা চর্চা একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। সে সময়ের সাহিত্যপ্রেমী ও সাধকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়াহ (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীনসহ বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু লেখক। কওমি মাদ্রাসায় বাংলা চর্চাকে ব্যাপক করার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনো তারা তাদের এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন এমন দুইজন মহান ব্যক্তি আছেন এ অঙ্গনে। একজন হলেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ আর আরেকজন হলেন আদীব হুজুর খ্যাত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ। এ সময়ের কওমিপড়ুয়া বাংলা সাহিত্যপ্রেমী ও সাহিত্যসাধক যে কেউ কোনো না কোনোভাবে এ দুইজন ব্যক্তির সাহিত্যচেতনার সঙ্গে জড়িত।
বর্তমানে আরবি ও বাংলা চর্চা : কওমি মাদ্রাসায় এখন নিয়মিত বাংলা চর্চা হয়। সাহিত্যের আসর হয়। হয় পাঠপ্রতিক্রিয়া। মিরপুরস্থ দারুর রাশাদ মাদ্রাসায় বিশিষ্ট আলেম লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা লিয়াকত আলীর তত্ত্বাবধানে ভাষা-সাহিত্য সাংবাদিকতা বিষয়ক একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। এছাড়া লেখিয়েদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বাংলা ও আরবি চর্চার ব্যাপারে বিশেষ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম, জাতীয় লেখক পরিষদ, বানানবাড়িসহ বেশ কিছু সংগঠন বাংলা সাহিত্য চর্চাকে ব্যাপক করার পেছনে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। আরবি চর্চাও আগের তুলনায় এখন ব্যাপক হচ্ছে। প্রতিটি মাদ্রাসায় আরবির চর্চা এখন আশাজাগানিয়া। বাংলাদেশে আরবিকে সহজপাঠ্য ও সুখকর সাহিত্যে রূপদান করতে বিশেষভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নবীন-প্রবীণ অনেক আলেম। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মাওলানা সুলতান যওক নদবী, মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ, মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলে বারী (রহ.), মাওলানা সফিউল্লাহ ফুআদ, মাওলানা মুহি উদ্দীন ফারুকী, মাওলানা শফিকুল ইসলাম ইমদাদী রাহাত প্রমুখ।
লেখক: মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী