ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সংকট উত্তরণে মুসলিম সভ্যতা

মুহাম্মাদ ইনায়েতুল্লাহ
সংকট উত্তরণে মুসলিম সভ্যতা

জনজীবনের আপৎকালীন মুহূর্তে সংকট উত্তরণে করণীয় কী? সমাজ-সভ্যতা বা কোনো গোষ্ঠীবিশেষের এক্ষেত্রে কর্মপন্থা কী হবে? ইসলামি সামাজিকতা, মুসলিম সভ্যতা ও নববি আদর্শে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ইসলামি সভ্যতায় জাগতিক সুখ ও আনন্দ আত্মকেন্দ্রিক নয়, সার্বজনীন। সবার কল্যাণে অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক মহৎ শিক্ষা রয়েছে নববি আদর্শে। এ আদর্শ মানবতার মূর্ত প্রতীক। আদর্শিক সমাজ ও সভ্যতার পরিশীলিত প্রতিচ্ছবি। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শ অনুসরণ করে পথ চললে সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবতা পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হবে। সহমর্মিতায় ভরে ওঠবে পৃথিবী। সুন্দর ও সুখময় হবে জনজীবন। ছন্দময় হবে চলার গতি। অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, বিপদে এগিয়ে আসা মুসলিম সভ্যতা ও নববি আদর্শে উজ্জীবিত প্রাত্যহিক জীবনাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) এর নির্দেশিত কর্মপন্থা রয়েছে এবং তার জীবনের বহু ঘটনা জনকল্যাণে ব্যথিত-হৃদয়ের সহমর্মিতাকে সমুজ্জল করে রেখেছে। নবীযুগের এমনই একটি ঘটনা-

একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে বসেছিলেন। বাইরে তপ্ত লু হাওয়া। সূর্য তখন মধ্য গগনে। কুফরের তপ্ত আবহে ঈমানের সুশীতল পরশ পেতে উদগ্রীব সাহাবিরা। তারা এভাবে মসজিদে এসে প্রায়ই জড়ো হন। ঈমান নিয়ে আলোচনা করেন। নবীজির সাহচর্যে, সংস্পর্শে ঈমানকে শানিত করে ঘরে ফিরেন। এমন একজন সাহাবি হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশিষ্ট সাহাবি। ছিলেন সুদর্শন এবং সেইসঙ্গে নিজ গোত্রের সর্দার। হজরত ওমর (রা.) তাকে বলতেন, এই উম্মতের ইউসুফ! তিনি বলেন, আমরা যখন দ্বি-প্রহরের এমন একটি সময়ে মসজিদে নববিতে বসেছিলাম, তখন একদল লোকের আগমন ঘটে। লোকগুলোর প্রায় সবাই মুযার গোত্রের। তাদের গলায় তরবারি ঝোলানো। ভুখা-নাঙ্গা শরীর। মোটা ডোরাকাটা পশমী চাদরে কোনরকমে নিজেদের তারা ঢেকে রেখেছেন। তাদের এই দুর্ভিক্ষপীড়িত করুণ অবস্থা দেখে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারক বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। উঠে ঘরে যান। সম্ভবত খাবার কিছু আছে কি না দেখার জন্য কিন্তু পাননি কিছুই। ফিরে এসে হজরত বিলাল (রা.)কে জোহরের আজান দিতে আদেশ দেন। নামাজ শেষে উপস্থিত সাহাবিদের লক্ষ্য করে কোরআনের নিম্নোক্ত দুটি আয়াত পাঠ করেন-

‘হে মানুষ সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে একজন (হজরত আদম আলাইহিস সাল্লাম) থেকে সৃষ্টি করেছেন (এ প্রক্রিয়ায় যে, ) তাঁর থেকে সৃষ্টি করেছেন তার একজন স্ত্রী (মা হাওয়াকে)। এরপর এই উভয়জন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অগণিত নারী ও পুরুষ। তোমরা ভয় কর আল্লাহকে, যার দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরের নিকট কোনো কিছু দাবি কর এবং ভয় কর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাকে।

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখেন।’ (সুরা নিসা:১)। ‘হে মানুষ সকল! তোমরা ভয় কর আল্লাহকে। প্রত্যেকেরই উচিত এটা দেখে নেওয়া যে, সে তার পরকালের সঞ্চয়রূপে দুনিয়া থেকে কী পাঠাচ্ছে? ভয় কর আল্লাহকে, নিশ্চয়ই তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত।’(সুরা হাশর:১৮)।

এরপর নবীজি (সা.) বললেন, প্রত্যেকেরই উচিত দানের হাত প্রসারিত করা। দিনার, দিরহাম, গম, খেজুর যার যা আছে তা-ই দান করা। এমনকি বলে দিলেন- যদি তা খেজুরের একটি টুকরাও হয়। দানের প্রতি মর্মস্পর্শী এই আহ্বান শুনে এক আনসারি সাহাবি একটি থলে নিয়ে এলেন, থলেটি ওজনে এতই ভারি ছিল যে, তিনি টেনে আনতে পারছিলেন না। এরপর একে একে অন্যরাও দানে স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে এলেন। দেখতে দেখতেই খাবার ও কাপড়ের দুটি স্তূপ হয়ে গেল। তা দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মলিন চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বর্ণনাকারী সাহাবী জারির ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, নবীজির চেহারায় খুশির স্বর্ণালি আভা যেন ঝলকাতে লাগল।

আজকের এ দানের মহৎ ধারার সূচনাটি যে আনসারি সাহাবির হাত ধরে সূচিত হলো, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রশংসা করলেন।

বললেন, যে ইসলামে সুন্দর কোনো ধারার সূচনা করবে, সে তার কাজের প্রতিদান পাবে। এবং এ ধারা অনুসরণ করে আরো যত মানুষ কাজটি করবে তাদের সবার প্রতিদানও এ ব্যক্তি পাবে। অথচ তাদের প্রতিদান দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুমাত্র কম দেওয়া হবে না। অনুরূপভাবে কেউ যদি ইসলামে কোনো মন্দ ধারার সূচনা করে, এর ফলও সে ভোগ করবে। এবং আরো যত মানুষ তাকে অনুসরণ করে এ পথে চলবে তাদের পাপের বোঝাও এ ব্যক্তি বহন করবে। অথচ তাদের বোঝা বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বিমর্ষ হওয়া আমাদের দুঃখীজনের দুঃখে ব্যথিত হতে শেখায়। মানুষের দুঃখ ঘোচানোয় যে অপার্থিব দ্যোতি নবীজীর চেহরায় সেদিন ভেসে উঠেছিল, কোনো রাসুলপ্রেমীকে মানব-প্রেমে উৎসর্গপ্রাণ বানাতে এ-ই যথেষ্ট। মানুষের দুঃখ ঘোচানোর এই যে পুণ্য, এর প্রথম সারিতে নিজেকে রাখতে পারলে, সে ছোট্ট পুণ্যটিই ক্রমান্বয়ে পুণ্যের মহীরুহে পরিণত হয়। এই ঘটনা আমাদের আরো শিক্ষা দেয়, সামান্য কিছু দিয়ে হলেও সংকট সমাধানে উচিত সবার অংশ নেওয়া। সব অংশীজনকে নিয়েই তা সমাধা করা। ইসলামের এ মর্মবাণী আমরা কর্মে ধারণ করলে দুঃখী লোকের সংখ্যা সমাজে কমে যাবে। সমাজ হবে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যে পূর্ণ এক শান্তির নীড়।

(সূত্র : মুসলিম : ১০১৭)।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুহাম্মদপুর, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত