ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক

হাদিসশাস্ত্রের এক অবিসংবাদিত নক্ষত্র

ইসমাঈল সিদ্দিকী
হাদিসশাস্ত্রের এক অবিসংবাদিত নক্ষত্র

আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক। জ্ঞানের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইতিহাসের পাতায় অন্তহীন আলো ছড়ানো এক মহান ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানের সাগরে অহর্নিশ ডুবে থাকার যে প্রেরণা তার এক বিস্ময়জাগানিয়া চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় তার জীবনীতে। একটি হাদিসের জন্য কিংবা একটি সনদ যাচাইয়ের জন্য যিনি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতেন সমকালীন সব জ্ঞানের শহরে। কখনো অনাহারে, কখনো অর্ধাহারে, স্রেফ ইলমের জন্য ঘুরে বেড়াতেন দেশ থেকে দেশান্তরে। কোথাও বা পিচ্ছিল, কোথাও বা পঙ্কিল, কোথাও বা বন্ধুর পথ। তবু তিনি দমে যাননি কখনোই। হৃদয়ের গভীরে জ্ঞানের যে নহর বয়ে বেড়িয়েছিলেন, সেই নহরের অমৃত সুধা মানুষকে পান করাতে তিনি ছুটে গেছেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

আবু উসামা রহ. বলেন, ‘আমার জানামতে আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারকের মতো আর কেউ ইলমের জন্য এতো বেশি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াননি।’ (তাযকিরাতুল হুফফায: ১/২৫৪)।

হাদিসশাস্ত্রে তার অবদান : ইলমের সব শাখায় অগাধ পাণ্ডিত্য থাকলেও হাদিসশাস্ত্রে তিনি নিঃসন্দেহে এক প্রবাদপুরুষ ছিলেন। জীবনী লেখকরা হাদিসশাস্ত্রে তার বিজ্ঞতা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আবু উসামা রহ. বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের চেয়ে অধিক ইলম অন্বেষী ব্যক্তি আর কাউকে দেখিনি। মানুষের মাঝে আমিরুল মোমেনিনের মর্যাদা যেমন, মুহাদ্দিসগণের মাঝে তিনি তেমন’। (তারিখু দিমাশক, তাহকিক, বৈরূত: দারুল ফিকর, ৩২/৪০৭, ৪২৫)।

তার সম্পর্কে ইমাম ইজলি (রহ.) বলেন, খোরাসানের আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক ছিলেন হাদিসশাস্ত্রের একজন সমাদৃত ও নির্ভরযোগ্য ইমাম। ইলমের সকল শাখায় তার সমান দক্ষতা ছিলো। (তারিখু বাগদাদ : ১০/ ১৫৫)।

যাদের পরশে ধন্য তিনি : আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) এর শিক্ষকের সংখ্যা অগণিত। আব্বাস ইবনে মুসআব (রহ.) বর্ণনা করেন, আমি ইবরাহীম ইবনে ইসহাক (রহ.) এর সূত্রে জেনেছি, আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.) বলেছেন, আমি প্রায় চার হাজার মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদিস শিখেছি। তাদের মধ্যে এক হাজার জনের সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছি। এরপর আব্বাস ইবনু মুসআব বলেন, এই হাজারের মধ্য থেকে আটশ’ জনের হাদিস আমার ভাগ্যে জুটেছে। (তাযকিরাতুল হুফফাজ: পৃষ্ঠা ৯৫)।

তার উস্তাযদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা, সুলাইমান আত তাইমি, ইমাম শুবা, ইমাম সাওরি, ইবনু জুরাইজ, হিশাম ইবনে ওরওয়া, লাইস ইবনু সাদ, ইকরামা ইবনু আম্মার রহিমাহুমুল্লাহ অন্যতম। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৮/৩৮০)।

খ্যাতিমান শিষ্যবৃন্দ : তার ছাত্রসংখ্যা এতো বেশি যে, গুনে শেষ করা যাবে না। কারণ অগণিত মুহাদ্দিস তার সূত্রে হাদিস বর্ণনা করে গেছেন। যে সব বিখ্যাত মুহাদ্দিস তার সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যে ইমাম মা’মার, ইমাম আবু ইসহাক আল ফাজারি, হিব্বান ইবনে মুসা, ইয়াহইয়া ইবনু আদম, আব্দুর রাজ্জাক ইবনে হাম্মাম, মাককি ইবনু ইবরাহীম রহিমাহুমুল্লাহ অন্যতম। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৮/৩৮০)।

আকিদা ও বিশ্বাস : দ্বীনের মৌলিক আকিদা তথা বিশ্বাসে তিনি ছিলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদায় বিশ্বাসী। তার জ্ঞান-গবেষণায় ইসলামের বিশুদ্ধ চিন্তাধারা বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দ্বীনের পূর্ণ রূপ রেখা বিমূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে। সাহাবিদের ব্যাপারে তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এর সহযোগী ও সাথিবর্গের প্রতি ভালোবাসা দ্বীনের অংশ। তিনি আরো বলেন, যার মাঝে দুটি গুণ থাকবে, সে আখিরাতে মুক্তি লাভ করবে। এক: সত্যবাদিতা দুই: সাহাবিদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।

যেমন ছিলেন তিনি : সালাফদের মধ্যে ইবনুল মোবারক (রহ.) এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব- যার মাঝে সকল প্রকার প্রশংসনীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছে। যিনি জায়গা করে নিয়েছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের হৃদয়ে। ইসমাঈল ইবনু আইয়াশ (রহ.) বলেন, পৃথিবীতে আজ আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারকের মতো কেউ নেই। মহান আল্লাহ তাকে সব ধরনের ইতিবাচক গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।

(তারিখে বাগদাদ: ১০/১৫৭)। তিনি সফরে কিংবা হজের উদ্দেশে বের হলে এক উট বোঝাই খাবার নিয়ে বের হতেন। এই সম্পূর্ণ খাবার সফরসঙ্গীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু নিজে দিনের পর দিন সিয়াম পালন করতেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১০/ ১৭৮)।

তার অমৃত বাণী : মুমিনদের জন্য সবচেয়ে পরিতৃপ্তির বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। কিন্তু দুনিয়াপ্রেমীরা আজীবন এই তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকে। (হিলয়াতুল আউলিয়া: ৮/ ১৬৭)। সনদ (হাদিসের রাবি পরম্পরা) দ্বীনের অংশ, যদি সনদ না থাকত তাহলে যার যা ইচ্ছা সে তাই বলত (দ্বীনের বিষয়ে)। (মুকাদ্দামায়ে মুসলিম)। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান লাভ করার চেয়ে মহৎ কাজ আর নেই। অপরদিকে দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্য ইলম অন্বেষণ করার চেয়ে জঘন্য কাজ আর দ্বিতীয়টা নেই। (আল আদাবুশ শরইয়্যাহ: ২/ ২২৭)। এই মহান মনীষী আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) ১০ রমজান ১৮৩ হিজরিতে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ফোরাত নদীর তীরে হাইত নামক গ্রামে সমাহিত হন। (তাবাকাতুল কুবরা:৭/৩৪২)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত