ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অসুস্থতায় মোমেনের করণীয়

শাহাদাত হোসাইন
অসুস্থতায় মোমেনের করণীয়

মোমেনমাত্রই বিশ্বাস করে সুস্থতা-অসুস্থতা, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায় বান্দার কল্যাণকামী। সুস্থতা, অসুস্থতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুঃখণ্ডকষ্ট ও রোগশোক-অসুস্থতা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাদের পরীক্ষা করেন। বান্দা আল্লাহর প্রতি কতটা নির্ভরশীল ও ধৈর্যশীল। কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।’ (সুরা বাকারা:১৫৫)। মোমেন অসুস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসারের কাছে লোকেরা শারীরিক ব্যথার কথা উল্লেখ করলে, একজন গ্রাম্য ব্যক্তি বললেন, আমি কখনো অসুস্থ হইনি। আম্মার (রা.) বলেন, তুমি আমাদের দলভুক্ত নও। মুসলিম মসিবত দ্বারা পরীক্ষিত হবে এবং এর মাধ্যমে গোনাহ মোচন হবে (মুসান্নাফে ইবনু আবি শায়বা : ৩:২৩২)।

অসুস্থতা ঈমানি পরীক্ষা : যার দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আমল যত দৃঢ়, তার ঈমানি পরীক্ষা তত কঠিন হয়।

মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা ও রাসুল। তিনিও রোগাক্রান্ত হয়েছেন। অসুস্থতায় ভুগেছেন। পৃথিবীতে যে আল্লাহর যত প্রিয়, সে তত বিপদগ্রস্ত। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমি নবীজির জ্বরাবস্থায় ঘরে গিয়ে তাঁর কম্বলে হাত দিলে জ্বরের প্রচণ্ডতা আঁচ করে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার জ্বরের প্রচণ্ডতা তো অনেক বেশি! তিনি বললেন, নবীদের সঙ্গে এমনটাই ঘটে, প্রতিদান বৃদ্ধির জন্য তাদের কষ্ট বৃদ্ধি করা হয়। নবীদের পরে সর্বাধিক কষ্ট দেওয়া হয় নেককারদের (সুনানে বায়হাকি : ৩:৩৭২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ব্যক্তিকে তার দ্বীনানুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যদি তার দ্বীন অনমনীয়-দৃঢ় হয়, তাহলে তার পরীক্ষা কঠোর হয়। আর যদি দ্বীন নমনীয় হয়, তাহলে তাকে তার দ্বীনানুযায়ী পরীক্ষা করা হয় (তিরমিজি : ২৩৯৮)।

অসুস্থতা গোনাহ মাফের কারণ : অসুস্থতা মোমেনের জন্য যেমন পরীক্ষা তেমনি নেয়ামতও। অসুস্থতার মধ্যদিয়ে মোমেন বান্দার গোনাহ মাফ করা হয়। আল্লাহতায়ালা মোমেনের কষ্টে মাগফেরাত রেখেছেন। নবীজি বলেন, যখন কোনো মোমেন অসুস্থ হয়, তখন উক্ত অসুস্থতা দ্বারা আল্লাহ সেই মোমেন ব্যক্তির গোনাহ মিটিয়ে দেন (বোখারি : ৫৬৬০)। তাই তো নবীরা নিজেদের অসুখে, অসুস্থতায় বিচলিত না হয়ে বরং খুশি হতেন। নবীজি বলেছেন, তোমরা প্রাচুর্যে যতটা খুশি হও নবীরা বিপদে ততটা খুশি হন (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২৪)। তাই অসুস্থতায় কষ্ট না পেয়ে বরং খুশি ও শুকরিয়া করা উচিত। ধৈর্য ধরে বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া উচিত। কেননা, অসুস্থতার সময় দোয়া করলে সে দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।

স্বল্পকালীন কষ্টে চিরস্থায়ী মুক্তি : পৃথিবীতে মানুষের অসুস্থতা আল্লাহর নেয়ামত ছাড়া আর কিছু নয়। সামান্য অসুখের কষ্ট দিয়ে আল্লাহ মোমেন বান্দাদের জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দেন। মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। নবীজি বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, এটা (অসুস্থতা) আগুন, যা আমি দুনিয়াতে মোমেন বান্দাদের ওপর চাপিয়ে দিই। যাতে আখেরাতের আজাবের অংশ দুনিয়াতেই শেষ হয় (তিরমিজি : ২০৮৮)। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, জ্বর প্রত্যেক মোমেনের জাহান্নামের আগুনের অংশ। অন্যত্র এসেছে নবীজি বলেন, জ্বর জাহান্নামের উত্তপ্ত হাপর। আর তা মোমেনের জাহান্নামের নির্ধারিত অংশ (বায়হাকি : ৯৩৮৬)। অসুস্থতা ব্যক্তিকে পাপমুক্ত করে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো করে। নবীজি বলেছেন, রোগমুক্ত মোমেন আসমান থেকে বর্ষিত বরফ খণ্ডের ন্যায় স্বচ্ছ (তিরমিজি : ২০৮৬)।

দান-সদকা করা : অসুস্থাবস্থায় একজন মোমেনের অধিক পরিমাণে দান-সদকা করা উচিত। এতে রোগ মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। নবীজি বলেছেন, তোমরা অসুস্থদের চিকিৎসা কর সদকার মাধ্যমে। (বায়হাকি : ৩৫৫৭)। অন্যত্র এসেছে, নবীজি বলেন, তোমরা অধিক পরমাণে সদকা কর। কেননা মসিবত সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না (বায়হাকি : ৮০৮৩)।

দোয়ায় গুরুত্ব দেওয়া : মোমেন সর্বদা আল্লাহমুখী হবে। সুখে-দুঃখে, সুস্থতায় ও অসুস্থতায় আল্লাহকে ডাকবে। দোয়া ও প্রার্থনা করবে। কারণ রোগ মুক্তির একমাত্র অধিকারী আল্লাহ। ইবরাহিম (আ.) স্বীয় রবের পরিচয়ে বলেছিলেন, যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই রোগমুক্ত করেন। (সুরা শুয়ারা : ৮০)। নবীজি বলেছেন, আল্লাহর নিকটে ক্ষমা ও সুস্থতা চাও। কেননা ঈমানের পরে সুস্থতার চেয়ে উত্তম বস্তু কাউকে দেওয়া হয়নি। (তিরমিজি : ৩৫৫৮)। অসুস্থ অবস্থায় নিজের কৃতকর্মের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে বেশি বেশি ইস্তেগফার করা একটি উল্লেখযোগ্য ও ফলপ্রসূ আমল।

চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা : অসুস্থতায় চিকিৎসা করা তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরিপন্থি নয়। নবীজি নিজেও চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং উম্মতকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে বলেছেন। হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, হে আল্লাহর বান্দারা তোমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। কেননা আল্লাহ বার্ধক্য ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ রেখেছেন। (ইবনু মাজাহ : ২৭৮৯)।

ধৈর্য ধারণ করা : সর্বোপরি, মোমেন বান্দার উচিত অসুস্থতায় ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর প্রতিদানের আশা রাখা। আল্লাহভীরু, সত্যনিষ্ঠ বান্দার বৈশিষ্ট্য হলো, রোগ-শোক সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ বলেন, যারা অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী, তারাই সত্যাশ্রায়ী, তারাই মুত্তাকি। (সুরা বাকারা : ১৭৭)। স্বর্ণ আগুনে পুরেই নিজেকে খাঁটি করে তেমনি একজন মোমেন বান্দা বিপদাপদ ও অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হয়ে, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠতার প্রমাণ দিয়েই আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়। লেখক: মুহাদ্দিস ও খতিব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত