ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চীনা সভ্যতায় মুসলিমদের ভূমিকা ও প্রভাব

মুসা আল হাফিজ
চীনা সভ্যতায় মুসলিমদের ভূমিকা ও প্রভাব

সপ্তম শতক থেকে শুরু। ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে মুসলিম জাহাজগুলো চীনে প্রবেশ করেছে। মরুভূমি, পর্বতশ্রেণি ও বিস্তর অরণ্য অতিক্রম করে স্থলপথে আসা মুসলিমদের জন্যও চীনের প্রাচীর বাঁধা হতে পারেনি। চীনের অধিবাসীরা গেছেন বাইরে; পারস্যে, আরবে, মধ্য এশিয়ায়। গ্রহণ করেছেন ইসলাম, দেশে এসে পালন করেছেন প্রচারকের ভূমিকা। চীনের বিপুল সংখ্যক মানুষ মুসলিমদের সঙ্গে দীর্ঘ সহাবস্থানে মুগ্ধ হয়েছে ইসলামে, গ্রহণ করেছে ইসলাম। এভাবে দীর্ঘ পরিক্রমায় ইসলাম চীনা সমাজের অনস্বীকার্য অংশে পরিণত হতে থাকে। এই পথে কয়েকটি মাইলফলক রয়েছে। (ক) অষ্টম শতকে আন লু শানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ দমনে তাং বাহিনীকে আরব সেনাদের সহায়তা ও মুখ্য ভূমিকা এবং চীনে তাদের স্থায়ী অবস্থান। (খ) নবম শতকের শুরুতে চীনের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার। বিশেষত যখন তিব্বতীদের সঙ্গে আব্বাসী ও সমরকন্দি সেনারা তাংদের সঙ্গে সমঝোতা করে। তারাই বসবাস শুরু করে ইউনান প্রদেশে। (গ) ত্রয়োদশ শতকে মোঘল বিজয়ীদের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক আরব ও তাতার মুসলিমদের চীনে প্রবেশ এবং চীনের প্রধান নগর ও শহরসমূহে স্থায়ী বসতি স্থাপন। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদিতে মুসলিমদের গভীর ও প্রবল প্রভাব। ক্যন্টন, চুয়াংচৌ, হাঙচাউ, ইয়াংচৌ ইত্যাদিতে ইসলামের প্রভাবের দৃঢ়ভিত্তি লাভ, যা কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপ ৬১৮ থেকে ৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ। দ্বিতীয় ধাপ ৯৬০ থেকে ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ। তৃতীয় ধাপ ১২৮০ থেকে ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দ। (ঘ) উপকূলীয় শহরগুলোতে আরব ও ইরানি মুসলিমদের বসতি নির্মাণ। সেখানে ছিল উন্নত জীবনযাত্রা, বাণিজ্যকেন্দ্র, শিক্ষাগার, মসজিদ। যে মুসলিমরা উত্তর চীন এবং উত্তর-পূর্ব প্রদেশে বসবাস করতেন, তারা প্রধানত ছিলেন হুই যোদ্ধাদের বংশধর। দ্বাদশ শতক থেকে তারা চীনের প্রতিরক্ষায় কাজ করে এসেছেন। উভয় দিকের মুসলিম বসতিগুলো চীনা জনজীবনে মিথস্ক্রিয়া সম্পন্ন করে আন্তঃবিবাহের মাধ্যমে। চীনা রীতিনীতি গ্রহণে মুসলিম সমাজ কমই বাছবিচার করেছে। (ঙ) তাঙসুঙের আমল থেকে মানচু শাসনামল অবধি সময়কাল ৬৫১ থেকে ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। একে চীনা মুসলিমদের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সরকার, সমাজ ও বাস্তবতার সঙ্গে সুন্দর ও ধারাবাহিক সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজ স্থিতিশীল থেকেছে তখন। ধনী ও সমৃদ্ধ একটি অংশের ব্যাপক অগ্রগতি হয়। ইউয়ান মিঙের সময় বহু মুসলিম নেতা সরকারি উচ্চ পদে সমাসীন ছিলেন। তবে অধিকাংশ লোক ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালন কাজে নিয়োজিত। যদিও তারা একটি সুখী জীবনযাপন করেছিল। দীর্ঘ এই সময়কালে মুসলিমদের পক্ষে ইতিবাচক আবহাওয়া ছিলো বটে। মুসলিমরা এর মধ্যে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট জীবন পার করছিলেন। চীনা সমাজে ইসলামের দাওয়াত ও গতিশীল বিকাশ নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ ছিলো কম। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও আনুকূল্য পেয়ে সুখি অনুভব করাটা কৃত্রিম এক বাস্তবতা। কারণ তা সময় বদলালে ভিন্নরূপ নিতে পারে। হলোও সেটা। মিঙ রাজবংশের পতনের পরে দেখা গেল প্রচণ্ড জেনোফোবিয়া। যার প্রধান শিকার ছিলো মুসলিমরা। সামাজিক বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন তাদের দিকে তেড়ে এলো। মানচু ও হান সরকার প্রথমে প্রশাসন থেকে খেদালো মুসলিমদের। আয়ের খাতগুলোকে সঙ্কোচিত করল এবং তাদের বিরুদ্ধে বিস্তার করল ঘৃণা। রাজনৈতিক দমননীতি তীব্র হয়ে উঠল। মুসলিমরা তখন ছিলেন প্রতিবাদী। বিক্ষুব্ধ। ১৬৪৮ থেকে নিয়ে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সেনসি, কানসু, ইউনান ও সিনকিয়াং প্রদেশে মুসলিমরা কমপক্ষে দশটি বিদ্রোহ করেন। কয়েকটি গণহত্যার শিকার হয় মুসলিম সমাজ। ব্যাপক উচ্ছেদ, বিতাড়ন ও বঞ্চনা ধারাবাহিক ব্যাপারে পরিণত হয়। প্রতিকূল পরিবেশ অনেক সময় আসল বিষয়ে মনোযোগী করে। তখন মুসলিম সাধক, দাঈ ও উলামার অনেকেই দাওয়াতি প্রয়াসে মনোযোগ বাড়ান। যে হানরা ইসলামের উচ্ছেদে নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই ইসলামে দীক্ষিত হন। প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে চীনের মুসলিম সমাজ নিজেদের পথ খুঁজে নেয়। চীনা সংস্কৃতির প্রতি ছাড় দেবার মাত্রা আরো বাড়ে। প্রতিক্রিয়া জানানোর চেয়ে ইতিবাচক ভূমিকায় লিপ্ত থাকাটা তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। ধীরে ধীরে আবারো ইসলামের প্রসার লক্ষ্য করা যায়। যদিও ঘৃণার স্রোত থামছিল না, তবুও মুসলিম সমাজ সতেরো শতকের শুরুতে অনেকগুলো ইহুদি বসতিকে ইসলামে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়। ১৮ শতকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুসলিমদের তরফে সংঘটিত জিঙ্গারিয়া বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এর পরে সেখানকার মুসলিমদের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ হাজার হান পরিবারকে এই এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল প্রতিবেশী মুসলিমদের উন্নত সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রভাবে তারা সবাই মুসলমান হয়ে গেল। চীনের জনগণের করাল দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা হয় ১৯০৭ সালে। মুসলিম অঞ্চলগুলো ছিল এর অন্যতম শিকার। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল দ্বিতীয় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। এ সময় প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০০ মানুষ খাদ্য অভাবে অনাহারে মারা যায়। মুসলিমরা তখন নিজেদের ক্ষুধা, অনাহার ও মৃত্যুর মধ্যেও সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করেন। শানতোং অঞ্চলে দশ হাজার বালক মুসলিমদের দ্বারা আশ্রিত হয়। তাদের সবাই পরে মুসলমান হয়ে যান। কুয়ান তোং অঞ্চলে দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ হাজার চীনা বালক ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের একটি আদমশুমারি অনুযায়ী, চীনে মুসলমানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি। চীনে আধুনিকতার উত্থান ও বিকাশের মুখে চীনা মুসলিম জনগোষ্ঠী নতুন বাস্তবতার মুখোমুখী হয়। কিন্তু ততক্ষণে তারা সেখানে পার করেছে হাজার বছরের অধিক পথপরিক্রমা। পথ চলার এই ধারায় চীনা সমাজ ও সভ্যতায় গভীরভাবে তারা খুদাই করে ফেলে নিজেদের কিছু প্রভাব ও অবদান। যেমন-

(১) চীনা সাম্রাজ্য কর ব্যবস্থার সংস্কারে মুসলিমদের অভিজ্ঞতা ও ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। বিদেশি বণিকদের উপর আরোপিত শুল্ক রাজস্ব সংগ্রহ এবং বাণিজ্যিক ও আর্থিক বিষয় সম্পর্কিত সংগঠন ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হয় মধ্যযুগীয় চীন।

(২) মুসলিমরা ইসলামিক স্থাপনা, মসজিদ ও স্কুলে আধুনিক পাথরের নির্মাণকলার প্রয়োগ করেন। চীনে এর বিস্তার ঘটে। ইসলামি মেজাজের তোরণ, সজ্জা এবং গম্বুজ নির্মাণের প্রভাব চীনা স্থাপত্যে প্রবেশ করে।

(৩) চীনা সম্রাটদের শাসনামলে অনেক চীনা মুসলমান নৌবিদ্যা, সমরবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, ডাক্তারি, সার্জারি, গণিত, ভূগোল, অর্থনীতি ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিল। মুসলমানরা চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরি, চীনা সিরামিক, স্পিনিং, বুনন এবং রঞ্জনবিদ্যার নানা দিক রপ্ত করে উপকৃত হন। অপরদিকে তারা চীনে নিয়ে আসেন নিজেদের চর্চিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ঔষধ, ফার্মেসি, গণিত, স্থাপত্য এবং যন্ত্রনির্মাণকলা। মুসলিমরা চীনে নিয়ে যান অনেক পণ্য, আবার সেখান থেকে অনেক সামগ্রী আমদানি করে ইসলামি বিশ্বের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

(৪) মুসলমানদের প্রাচীন ইতিহাসজুড়ে চীনা সভ্যতার উপর একটি দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট প্রভাব ছিল, কারণ চীনা সাম্রাজ্যের পুরো সময়কালে রাষ্ট্রের উন্নয়নের সব দিকগুলোতে চীনা মুসলমানরা স্পষ্ট অবদান রেখে চলছিল। আধুনিক যুগে সেই অংশগ্রহণ কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিচালিত জাতিগত বৈষম্যের ফলে হ্রাস পেয়েছে।

(৫) বহুরাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক বিনিময় ব্যবস্থার বিকাশে মুসলিমদের ভূমিকা ছিল অগ্রপথিকের। ইরানি, তুর্কি আরব ও চীনাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বহুমাত্রিক। প্রাথমিক পর্যায়ে তা প্রয়োজনের বিনিময়ের উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়। তারপরে এটি স্বার্থের বিনিময়ে বিকশিত হয়। অবশেষে সংস্কৃতি এবং ধারণার বিনিময়ে পরিণত হয়েছিল। সমন্বিত সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিনিময় বিশেষ করে সেইসব জায়গায় অধিক মাত্রায় ঘটে, যেখানে দুই দেশের সীমান্ত একত্রিত হয়েছে।

লেখক: কবি ও গবেষক আলেম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত